(সম্পাদিত সংস্করণ)
আমাদের বাংলাদেশে যে কে ঐতিহাসিক, মিথলজিক্যাল আর কে যে লিজেন্ডারি ফিগার এটা যেমন বুঝা খুব মুশকিল, ঠিক তেমনিই কোনটা যে গল্প আর কোনটা যে লিজেন্ড বা মিথ সেটা বুঝা আর এক একাডেমিক কসরতের ব্যাপার। যেমন ধরেন কয়েকদিন আগে মারা গেলেন সিরাজুল আলম খান নামের বাম ঘরানার এক সময়ের প্রতাপশালী রাজনৈতিক নেতা; তাকে দেখি টকশোতে অনেকেই বলছেন সে বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তী। এরকম অনেক নেতাকেও তার দলের নেতা কর্মীরা বলে থাকেন কিংবদন্তী চিরঞ্জীব নেতা। দেবত্ব আরোপিত কিংবদন্তী, মৃত্যুঞ্জয়ী এবং চিরঞ্জীব নেতারা ইতিমধ্যেই চিরদিনের জন্য মৃত্যুবরন বা পটল তুলেছেন এবং তারা আর কক্ষনই ক্ষমতার মসনদে বসতে পারবেনা। মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়ে কেউ মরে গেলে সে আবার অমর, চিরঞ্জীব হয় কী করে? যে জন্ম, মৃত্য, রোগ-শোককে জয় করে বেঁচে থাকতে পারে না তাকে আবার কিভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী বলা যায়? যে নিজের জন্ম নিজে দিতে পারে না বা যাকে অন্যজন জন্ম দেয় সে আবার চিরন্তন হয় কি করে?
বলতে পারেন এটা ফিগারেটিভলি বা রুপকভাবে বলা হয়; হ্যাঁ যদি সেটা বলা হয়েও থাকে তবে সেটাও কনফিউজিং কারন যে মরে যায় সে তাঁর সকল কারিশমা, যোগ্যতা এবং ভাল খারাপ সবকিছুই তাঁর সাথে নিয়ে যায় এবং এই প্রাণহীন বস্তু আর কোন ক্ষমতা, শক্তি বা সাম্রাজ্যের চর্চাই করতে পারেনা বরং তাঁর কাজকে আমরা যারা বেঁচে থাকি তারা দয়া করে বাঁচিয়ে রাখি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অমরত্ব এবং অলৌকিকত্ব প্রদান করি । যে প্রকৃত মৃত্যুঞ্জয়ী এবং চিরঞ্জীব, হায়াত-মওত-জন্ম-ব্যাধি-ক্ষমতা-যশ-খ্যাতি – এসবই তাঁর গোলাম এবং, মানুষের ষড়যন্ত্র কক্ষনই তাঁকে স্পর্ষ করতে পারে না; তাঁর নাম এবং প্রশংসিত কাজের মুল্যায়ন আমাদের বেঁচে থাকা মানুষের দয়া দাক্ষিন্যের উপর নির্ভর করে না; আমরাই তাঁর দয়ার কাঙ্গাল এবং আমাদের কোন সাহায্য ছাড়াই সে মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকে এবং প্রভুত্ব করে ধর্ম, বর্ন, সময় এবং স্থানভেদে; সবাই মরে গেলেও মৃত্যুকে পদদলিত করে সে বেঁচে থাকে চিরন্তন হয়ে অনন্তকাল ধরে – সেইতো মৃত্যুহীন, অমর, চিরঞ্জীব এবং মৃত্যুঞ্জয়ী। যায় হোক, কাউকে কিংবদন্তী বানিয়ে ফেলা মানে হলো একজন বাস্তব মানুষকে হয় অর্ধেক মিথ্যা বানিয়ে ফেলা অথবা সম্পূর্ন দেবতা বানিয়ে ফেলা। কালের আবর্তনে বর্তমানের এই কিংবদন্তী লোকগুলোই হয়ত হয়ে যাবে মিথলজিক্যাল বা পৌরাণিক চরিত্র ! স্টোরি বা গল্প, লিজেন্ড এবং মিথের ব্যাখ্যা আমি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই করব। তাঁর আগে আসুন আমরা একটু দেখি এই মিথ বা ফিকশনগুলো আমাদের দেশে কারা এবং কিভাবে তৈরি করে।
একাডেমিক বিষয়গুলো যখন সুবিধাবাদী, ক্ষমতালিপ্সু, স্বার্থপর আর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা ব্যবহার করে তখন তারা খুব সহজেই তাদের নেতাদেরকে খোদার আসনে বা তাঁর চাইতেও বড় আসনে বসিয়ে দেয়; একেবারে দেবতা বানিয়ে ফেলে। বাংলাদেশে এখন প্রতিটা জেলা -উপজেলাতেই পাওয়া যাবে রাজনীতির কিংবদন্তী, অমর নেতা এবং মৃত্যুঞ্জয়ী চিরঞ্জীব চরিত্র বা ফিগার । আগেই বলেছি কোন কোন ক্ষেত্রে এসব চরিত্র খোদাকেও ছড়িয়ে গেছে্। প্রশ্ন হলো এগুলো করলে সমস্যা কি? দেখুন একটি জাতি যদি সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো না বলতে পারে; বিড়ালকে বিড়াল না ভেবে তাকে বাঘ বা সিংহ মনে করে এবং প্রকৃত নায়ককে দুর্জন আর খলনায়ককে বীর বানিয়ে ফেলে, সে জাতি তৃষ্ণা মেটানোর জন্য মরীচিকার পানির জন্য ছুটতেই থাকবে আর দিনশেষে পানির পরিবর্তে পাবে কেবলমাত্র উত্তপ্ত বালির তাপ; পানি আর পান করতে হবে না। নেতাদের দেবত্বরোপ কোন দল বা সমাজকে বড় করে না; বরং তাদের মিথ্যা অহংবোধ এবং সংকোচিত দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রকাশ করে যা দেখে অন্যরা বিদ্রুপ করে কারণ দেবত্বরোপকারীরা কখনই নিজের দলের সীমাবদ্ধ দেওয়ালের বাহিরে যেতে পারেনা; দীর্ঘদিন ধরে আবদ্ধ পানির মতই এরা দুর্গন্ধময়; যুগে যুগে এসব ভন্ড অত্যাচারী চাটুকারদের মৃত্যুর পরেই তাদের তৈরী করা খোদার মিথ্যা বাহাদুরী ধরা পড়েছে এবং কালক্রমে এর শোচনীয় মৃত্যু ঘটেছে। ক্রুসেড থেকে শুরু করে শেষ সিরিয়া যুদ্ধ পর্যন্ত ইউরোপের অনেক বড় বড় নেতারা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা এমনকি আমাদের এশিয়া মহাদেশের মানচিত্র পরিবর্তনে বিশাল ভুমিকা রেখেছেন; আবার সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং দর্শনের ক্ষেত্রেও মানুষের চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে কিন্ত আপনি কাউকেই লিজেন্ডারী, অমর বা কিংবদন্তী চিরঞ্জীব উপাধি দেওয়া হয়েছে এটা দেখাতে পারবেন না । যেমন ধরুন, হেনরি -২, কুইন এলিজাবেথ, শেক্সপিয়ার, ডারউইন, কাল মার্ক্স, আব্রাহিম লিংকন, উইনস্টিন চার্চিল এমন অনেকে। ইউরোপিয়ানরা এমন নয় যে তাঁরা তাদের নায়কদের যথার্থ সম্মান করতে জানেনা; তাঁরা লিজেন্ডকে লিজেন্ডের জায়গায় আর মিথকে মিথের জায়গাতেই রাখে। আর যুদ্ধ, রাজনীতি এবং ইতিহাসের সাথে ফিকশন, মিথ বা লিজেন্ডের সুস্পষ্ট পার্থক্যের ফলে মোটামুটিভাবে তাঁরা নিজেরা এসবের বিশুদ্ধ চর্চা এবং অধ্যয়ন করতে পারে।
স্টোরি বা গল্প, লিজেন্ড এবং মিথের মধ্যে পার্থক্য আছে । গল্প সত্য, মিথ্যা অথবা উভয়ের মিশ্রন হলেও কিছু গল্প পুরো একশ ভাগই বাস্তব বা সত্য হতে পারে; এটা এই আলোচনায় দেখান হবে। যাই হোক, যারা তাদের পীর সাহেব বা নেতা/নেত্রীকে কিংবদন্তী বানান বা খোদার আসনে বসান, এ সবের সমালোচনা করেন এবং এগুলো নিয়ে ভাবেন তাঁদের এই পার্থক্যগুলো জানা দরকার। যদিও সময় এবং জাতিভেদে এসবের সংজ্ঞার কিছু তারতম্য হতে পারে তবুও কিছু কমন বিষয় আছে যেগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড বা আদর্শ ধরে সবাকেই এই সাহিত্যিক ফর্ম, রীতি বা জানরার বয়ান তৈরি করতে হয়। মনে রাখতে হবে যে আপনার দলের দার্শনিক এবং রাজনৈতিক চিন্তা দিয়ে অন্যদল, দেশ বা দর্শনকে চালানো যাবে না। আপনার সংকুচিত একপেশে চিন্তা অন্যের উপর জোর করে ততক্ষন চাপাতে পারবেন যতক্ষন প্রতিপক্ষ আপনার চেয়ে দুর্বল; শক্তিশালী প্রতিপক্ষের উপর কক্ষনই আপনি আপনার মিথ্যা অহংবোধ বা ধারনা চাপিয়ে দিতে পারবেন না। যে কোন চরিত্রের সত্য বা বাস্তব উপস্থাপনাই সেই চরিত্রকে দৃঢ়, মহান এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলে। যে কোন চরিত্রকে দেবত্ব আরোপের অর্থই হল চরিত্রকে মিথ্যাভাবে উপস্থাপন যাকে মহান করার জন্য উত্তরোত্তর আরও্র অনেক মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় যা মানুষ বা দর্শকের কাছে ক্রমান্বয়ে খুবই সহজবোধ্য এবং সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।একটা রাজনৈতিক, সাহিত্যিক বা দার্শনিক চরিত্র তখনই অবাস্তব হয়ে উঠে যখন তাকে তার প্রাপ্ত বা যোগ্য জায়গা থেকে উপরে স্থান দেওয়া হয় । এটা করতে গিয়ে যোগ্যদের বঞ্চিত করতে হয়, মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়, প্রতিপক্ষকে নির্যাতন করতে হয়, নতুন কাল্পনিক ন্যারেটিভ তৈরি করতে হয় এবং সর্বপরি তার ব্যাপারে অনেক মিথ তৈরিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে হয়। আর তার ফল যা হবার তাই হয়। বিভ্রান্ত হয় জাতি; ইতিহাস হয় বিকৃত; সাহিত্য হয় একপেশে; বিরোধী মত হয় রহিত; জ্ঞান এবং সমালোচনার ক্ষেত্র হয় বালুময় অনর্বর আর প্রজন্ম হয় মেধাহীন, কুপমন্ডক এবং সেবাদাস। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন মনে করেন কোন একজন বড়, প্রভাবশালী জাতীয় রাজনীতিক নেতা যার প্রাপ্ত স্থান হল রাজনীতি এবং ইতিহাস, কিন্তু তাকে আপনি বাংলা/ইংরেজী, সাহিত্য, ভাষা, দর্শন, বিজ্ঞা্ন, শিক্ষা, ধর্ম এবং, স্থাপত্য, – সব বিষয়ে বিশেষ ব্যাক্তিত্ব হিসাবে উপস্থাপন করছেন । আপনার বিল্ডিং এর দশটা রুমের প্রত্যেকটিতেই যদি একজনের কিছু দখল থাকে তাহলে অন্যরা এখানে বসবাস করবে কি করে? সব জায়গায় স্পেস দিয়ে আপনি কাউকে অমর কিংবদন্তী করতে চাচ্ছেন, কিন্তু এর ফল কি হচ্ছে? প্রজন্মের ইতিহাস, সাহিত্য আর দর্শনের জ্ঞান এক জায়গায় সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে; ইতিহাসকে এডজাস্ট করতে গিয়ে অন্য ঘটনা এবং নেতাকে বাদ দিতে হচ্ছে বা খাট করতে হচ্ছে – প্রজন্ম যা শিখছে তা হল একপেশে, খন্ডিত, হিংসা বিদ্বেষের কাহিনী। এভাবেই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে একসময় একটি জাতি হয়ে যায় প্যারালাইজড, দেউলিয়া এবং অন্যের গোলাম যার নিজস্ব স্বকীয়তা বলে কিছু থাকে না। কাজেই কাউকে মৃত্যুহীন, অমর, কিংবদন্তী টাইটেল দেবার আগে একটু চিন্তা ভাবনা এবং সেই সাথে পড়াশুনা করা দরকার।
আসুন একটু পড়ে ফেলি। সম্প্রতি ইংল্যান্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং লন্ডনের এক ব্যারিস্টার এক আলোচনায় উপরের প্রসংগ এমনভাবে এনেছেন যে একজন কোরানে বর্ণিত ঘটনাগুলোকে বলছেন গল্প এবং অন্যজন এগুলোকে বলছেন স্টোরি, লিজেন্ড এবং মিথ। ব্যারিস্টার সাহেব বলার চেষ্টা করছেন যে এগুলো সত্য গল্প কিন্তু প্রফেসর সাহেব এর কথা হল কোরআনে আল্লাহ এসব গল্প, লিজেন্ড এবং মিথ বলেছেন মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্য। কোরানে বর্ণিত ঘটনাগুলো কি আসলে গল্প বা মিথ বা লিজেন্ড?
প্রথমেই আসি মিথ বলতে কি বুঝি? তাহলে, একটা মিথলজিক্যাল ক্যারেক্টার দিয়ে শুরু করি। হোমারের ট্রয় নগরি ধবংস হয়েছিল সুন্দরী হেলেনের কারনে। তো সে কেমন সুন্দরী ছিল। তাঁর চোখ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দুরী চোখাওয়ালা মেয়ের চোখ; নাক ছিল সবচেয়ে সুন্দুরী নাকওয়ালীর নাক, স্তন ছিল সবচেয়ে সুন্দুরী স্তনওয়ালার স্তন – এভাবেই তাঁর গোটা শরীর বানানো হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দুরীদের সবচেয়ে সুন্দর অংশগুলো দিয়ে। মিথ হলো সম্পুর্নটাই মেইড আপ (made-up) বা বানানো গল্প । সাধারনভাবে বিশ্বাসযোগ্য হলেও এটা মিথ্যা। যদি আপনি প্রাচীন দেব-দেবীর গল্পে মিথ্যা ঘটনাগুলোকে সুচারুরূপে সাজাতে, তাঁদের মধ্যে সংযোগ করতে এবং তা এমনভাবে উপস্থাপন করতে পারেন যে তা সত্য বলে মনে হয় এবং আপনার গল্পে একটা ইউনিভার্সেল টিচিং বা সার্বজনীন শিক্ষা থাকে তবে তা হবে একটা স্বার্থক মিথ । মনে রাখবেন নিরেট সত্য বা সত্য ঘটনার মাধ্যমে আপনি কখনই মিথ্যা শেখাতে পারবেন না কিন্তু নিরেট মিথ্যা বা মিথ্যা ঘটনার মাধ্যমে একটা সত্য উপস্থাপন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে আমরা প্রচুর গ্রীক এবং হিন্দু মিথের উদাহরন দিতে পারবো যেগুলো পুরোটাই মিথ্যা, কাল্পনিক এবং অবাস্তব অথচ এগুলো খুবই আর্টিস্টিক বা সুনিপনভাবে বানানো হয়েছে যার মাধ্যমে পাঠককে একটি মোরাল বা আদর্শের মেসেজ দেওয়া হয়েছে।
এখন, প্রশ্ন হল লিজেন্ড কি? লিজেন্ড হল এমন এক লোককাহিনী, উপাখ্যান বা গল্প যা অনেক আগে থেকে লোকজন বিশ্বাস করে আসছে এবং তা আংশিকভাবে সত্য হতে পারে কিন্তু তা সত্য বলে প্রমান করা সম্ভব না বা যার সত্যতা নিরূপণ করা দুরূহ – এটাই হল লিজেন্ডের মুল সংজ্ঞা বা ধারনা। যেমন অনেকেই বলেন যে আমাদের উপমহাদেশে রাম, সীতা, হনুমান দিয়ে যে গল্প বা কাহিনী নির্মিত হয়েছে সেই রামায়নের রাম হল লিজেন্ডারি চরিত্রের উদাহরন; অবশ্য অনেকে এটাকে মিথলজিক্যাল ফিগারও বলে থাকেন । বর্তমানে বিখ্যাত বা গুরুত্বপুর্ন কোন ব্যক্তি যে কিনা কোন একটি বিষয়ে অসামান্য অবদান রেখেছেন তাকেও ঐ বিষয়ের বা সময়ের লিজেন্ড বলা হয় – এই ক্ষেত্রে ‘কিংবদন্তী’ শব্দটি ব্যবহার না করে অন্য কিছু করা উচিত কারণ কিংবদন্তী হল এমন কেউ যে কিনা ইতিহাস এবং কল্পনার সংমিশ্রনে মিশ্রিত এক চরিত্র। আমরা অনেক সময় বলি উনি নাট্যজগতের লিজেন্ড বা ফিল্ম-ইন্ড্রাস্ট্রিতে তিনি এক লিজেন্ডারী ফিগার। পার্টিকুলার বা বিশেষ একটি বিষয়ে একজনের ব্যাতিক্রমধর্মী অবদান থাকতে পারে এবং সেটাতে কারও লিজেন্ডারী হতে হয়ত দোষের কিছু নেই; কিন্তু সমস্যা হয় তখন যখন আমরা দেখি একই বিষয়ে অনেক লিজেন্ডারী ফিগারের ছড়াছড়ি অথবা চাটার দলেরা তাদের নেতাকে অনেক বিষয়ে লিজেন্ডারী ফিগার খেতাব দিয়ে খোদার থেকেও সম্মানী এবং ক্ষমতাবান বানিয়ে ফেলে। তাহলে গল্প কি? গল্প হলো বিভিন্ন ঘটনার বিন্যাস যা সত্যও হতে পারে মিথ্যাও হতে পারে। ফিকশন হলো সম্পুর্নটাই কল্পকাহিনী যেখানে বাস্তব বা সত্যের লেশ মাত্র নেই কিন্তু গল্পে সত্য থাকতে পারে যদিও এ সত্যের ব্যাপারে কোনই নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না। এটাকে যদি অনেকটা ‘দি বেনেফিট ওফ দি ডাউটের’ মত করেও মনে করি তবুও এটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না যে কোন একটি গল্প ১০০% সত্য ।
মুলতঃ একটি গল্প গল্প হবার শর্ত এটা নয় যে এটাকে ১০০% সত্য হতে হবে, বরং ১০০% মিথ্যা হয়েও তা ভাল গল্প হতে পারে যদি তা গল্পের শর্তসমুহ পালন করে। মূলতঃ যে কোন সত্য অথবা মিথ্যা গল্পে চরিত্র এবং ঘটনা বর্ননা বা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ইমেজ বা কল্পচিত্র আবশ্যক যা একজন গল্পকারকে মিথ্যা কল্পনার সাহায্যেই করতে হয়। মিথ্যা কল্পনার মাধ্যমে, সত্য অথবা মিথ্যা চরিত্র এবং ঘটনাকে যে গল্পকার সত্যের যত কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে তাঁর গল্প হয় ততটা সুন্দর, স্বার্থক এবং গ্রহনযোগ্য। একজন গল্পকারের কাজ হল আনন্দের মাধ্যমে সত্যগুলো চিত্রিত করা যা আমাদের জীবনের রিপ্রেজেন্টেশন বা প্রতিনিধিত্ব করে এবং যার মাধ্যমে একজন পাঠক জীবনের অর্থ খুজে পায়। অনেক গল্পেই আনন্দ থাকে কিন্ত মানবজীবনের কোন সত্যকে চিত্রিত করা হয়না এবং এর মাধ্যমে পাঠক জীবন সম্বন্ধে মিথ্যা ও ভুল ধারণা পায়; এগুলো কক্ষনই ভাল এবং স্বার্থক গল্প নয়।
এখন মিলিয়ন পাউন্ড প্রশ্ন হলোঃ আমরা সাধারণত মিথ, লিজেন্ড, ফিকশন বা গল্প বলতে যা বুঝি বা বুঝাই আর পবিত্র কোরআনে গল্প বলতে যা বুঝাই তা কি এক নাকি ভিন্ন? এই দুইয়ের মধ্যে যে ব্যাপক পার্থক্য আছে তা অনেক বড় পন্ডিত ব্যাক্তিরাও বুঝেন না এবং তাঁরা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কর্তৃক বর্ণিত গল্প এবং আমাদের মানুষ কর্তৃক বানানো গল্প, লিজেন্ড এবং মিথকে এক করে ফেলেন। ঠিক এমনটাই হয়েছে এই প্রফেসরের ক্ষেত্রে। আর মৃত্যুঞ্জয়ী কিংবদন্তী তৈরিতে আমরাইবা পিছিয়ে কিসে?মিথ তৈরী হয় সম্পুর্নটাই মিথ্যা বিশ্বাস বা ধারনার উপর; আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিশ্চয়ই মিথ্যা বিশ্বাস বা ধারনাভিত্তিক কোন কিছু কক্ষনই বলেননা। তিনি মিথ্যা, সন্দেহ এবং ধারণা থেকে সম্পুর্ন মুক্ত। অন্যদিকে লিজেন্ডকে আমরা আংশিক সত্য ধরে নিলেও তার অর্ধেক মিথ্যা বা মেইড আপ। এটা কি ভাবা যায় যে আল্লাহ গাফুরুর রাহীম কোন ঘটনা বা চরিত্রের ব্যাপারে আংশিক সত্য এবং আংশিক মিথ্যা বলবেন? গল্প সত্যও হতে পারে – এটা হলো একটা সম্ভবনা; আবার এই সত্যকে তুলে ধরার জন্য মিথ্যা কল্পচিত্রের সাহায্য অবধারিত; সুতরাং কোনভাবেই একটা গল্প মিথ্যা থেকে মুক্ত নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিশ্চয়ই মিথ্যা কল্পচিত্রের সাহায্যে সত্য গল্প বলবেন না। কোরআনে বর্নিত সকল ঘটনা (events), চরিত্র (characters), সময়, স্থান, প্রেক্ষাপট (setting), চিত্র (image), কনফ্লিক্ট (conflict) এবং দৃষ্টিভঙ্গি (point of view) একেবারে নিরেট ১০০% সত্য এবং এর মধ্যে জাররা পরিমান মিথ্যে নেই।সুতরাং কোরআনের গল্পগুলোকে আমাদের সাধারন গল্পগুলোর সাথে একাকার করা যাবে না। অন্য গল্পগুলো কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা তা হয়ত গল্পকার ভাল বলতে পারবেন কিন্তু এ কথা কোন সন্দেহ ছাড়াই নিশ্চিত করে বলা যায় যে কোরআনের সকল গল্প এবং চরিত্রগুলো ১০০% সত্য।
এবারে আসুন দেখি স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই গল্পগুলোর ব্যাপারে কি বলছেন । সুরা ইউসুফে তিনি বলছেনঃ আমি তোমার কাছে সর্বোত্তম (“best of stories”) কাহিনী বর্ণনা করছি, এ কুরআন তোমার কাছে ওয়াহী যোগে পাঠিয়ে, যদিও এর পূর্বে তুমি না-জানা লোকদের মধ্যেই শামিল ছিলে। (১২:৩) খেয়াল করে দেখুন, মহাজ্ঞানি আল্লাহ এসব গল্পগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে সুরা ইউসুফে আবারও বলছেন যে এগুলোতে কোন মিথ্যা নেইঃ এদের কাহিনীসমূহে বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় আছে। এ কুরআন কোন মিথ্যে রচনা নয়, বরং তাদের পূর্বে আগত কিতাবের প্রত্যয়নকারী আর যাবতীয় বিষয়ের বিস্তারিত বিররণে সমৃদ্ধ, আর মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য পথের দিশারী ও রহমাত (১২ :১১১)। আবার কোরআনের এই গল্পগুলো মিথ্যা প্রতিপন্নকারিদের উদ্দেশ্য করে দয়াময় আল্লাহ সুরা আল আরাফে বলছেনঃ তাই তার দৃষ্টান্ত হল কুকুরের দৃষ্টান্তের মত। যদি তুমি তার উপর বোঝা চাপাও তাহলে জিভ বের করে হাঁপাতে থাকে এবং তাকে ছেড়ে দিলেও জিভ বের করে হাঁপাতে থাকে। এটাই হল ঐ সম্প্রদায়ের উদাহরণ যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যে মনে করে অমান্য করে। তুমি এ কাহিনী শুনিয়ে দাও যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে (৭:১৭৬) ।
সুতরাং গল্প, ফিকশন, লিজেন্ড আর মিথ – যাই বলি না কেন এগুলোর সাথে কোরাআনের বর্নিত কাহিনীগুলোর সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলঃ কোর আনের কাহিনী ১০০% সত্য যা স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক বর্নিত এবং তা নির্দিস্ট কোন জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য না হয়ে সমগ্র মানবজাতির জন্যই গ্রন্থিত। যেমন আমরা যদি হাবিল এবং কাবিল (কেইন) এর গল্পের কথাই বলি তবে দেখব এই একটি গল্পই কিভাবে সমগ্র মানবজাতিকে একটি পরিবার বা সমাজে পরিণত করে। গল্পের মুল চরিত্র বা প্রটাগনিস্ট হাবিলকে সত্যের প্রতিক হিসাবে উপস্থাপনের সাথে সাথে ন্যায় এবং অন্যায়ের বিরোধকে তুলে ধরা হয়েছে; ভাইকে ভাইয়ের হাতে অন্যায় এবং নির্মমভাবে খুন হতে হয়েছে শুধু মাত্র হক বা সত্যের উপর থাকার কারণে; ছোট গল্প কিন্তু ট্র্যাজিক। প্রত্যেকটি চরিত্র এবং ঘটনাই স্ব-মহিমায় প্রোজ্জল; গোটা গল্পেরই আছে শুরু (beginning), মধ্যম (middle) এবং শেষ (ending)। হাবিলকে নির্মমভাবে খুনের পর এখানে অলৌকিকভাবে কাকের ব্যাবহার এসেছে যারা মৃত হাবিলকে কিভাবে দাফন করতে হবে তা দেখিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবে এ গল্পটা একজন কোরআন সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা মানুষের কাছে ফিকশনাল মনে হবে যদিও এর সবটাই পুরো সত্য ।
অন্যদিকে কোরআনের বর্নিত কাহিনীগুলোর যে ক্যারেক্টারঃ রাসুল, নবী এবং তাঁদের সমসাময়িক অত্যাচারী রাজা বাদশারা এরা কেহই না পৌরাণিক (মিথলজিক্যাল), না কিংবদন্তী আর না ফিকশনাল কারণ এগুলো কোন কাল্পনিক বানানো (made-up) চরিত্র নয়; তা আদম, নুহ, সালিহ, দাউদ, সুলাইমান, ইব্রাহীম, লুত, ইউসুফ, মুসা, ঈসা, মারিয়াম (আলাইহিসসালাম) এর গল্প হোক আর যুবকদের দেশ ত্যাগ করে গুহায় লুকানোর কাহিনী হোক (সুরা আল কাহফ)। এ গল্পগুলো কোন কল্প-কাহীণির উপর ভিত্তি করে বর্নিত হয়নি অথচ এগুলো অতুলনীয় ও অসাধারণ সার্বজনিন গল্প যা ধর্ম, বর্ন, গোত্র এবং কালকে ট্টানসেন্ড বা অতিক্রম করেছে। মিথ্যে কল্প-চিত্রকে বাদ দিয়ে একেবারে সত্য ঘটনা এবং সত্য চরিত্রকে আশ্রয় করে এক অসাধারণ কথা-শিল্প তৈরী করা হয়েছে যেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই একজন কথাশিল্পী – আর এখানেই লুকিয়ে রয়েছে কোরআনের গল্পের স্বাতন্ত্র্য যা পৃথিবীর অন্যসব গল্প থেকে তাকে আলাদা করেছে।
(লেখাটি লেখক কর্তৃক এডিট করা, প্রথম প্রকশিত হয়েছে আমার দেশ পত্রিকায় ২৬ জুন ২০২৩ এ)
Picture Courtesy: https://www.artpad.org/3scz3w5br2len05012awy8qo78kh9n