বুয়েটের রাজনীতিকরণ এক ষড়যন্ত্রের অংশ

Share this post

কাউকে না জানিয়ে এমনকি তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী না নিয়ে মে মাসের ১০ তারিখ ২০২৩ সালে ইন্ডিয়া কংগ্রেসের বিরোধী তরুণ নেতা রাহুল গান্ধী গিয়েছিলেন দিল্লি ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে; সেখানে তিনি ছাত্রদের সাথে বসে কিছু কথা বার্তা এবং খানা খেয়েছিলেন। অনুমতি ছাড়া তাঁর হোস্টেলে যাওয়াকে বিশ্ববিদ্যালয় অননুমোদিত (unauthorised), অসঙ্গত এবং নিয়মকানুনের বাইরে বলে ঘোষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয় আরও বলে যে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং হোস্টেল কোন সর্বজনীন বা পাবলিক প্লেস নয় যে এখানে যে কেউ যখন তখন আসতে আর যেতে পারবে। কর্তৃপক্ষ এজন্য তাঁকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখানেই থেমে থাকেনি, তাঁকে নোটিস পর্যন্ত দিয়েছে (May 11, 2023, The Times of India)।

আমাদের বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সভাপতি প্রশ্ন করছে যে, ‘বুয়েট পাকিস্তান নাকি যে ভিসা-পাসপোর্ট নিয়ে প্রবেশ করতে হবে?’ (১ এপ্রিল ২০২৪, মানবজমিন)। আপনার পাকিস্তান যাবার প্রয়োজন নেই, বাড়ির পার্শ্বে দিল্লিতে গিয়েই দেখে আসেন সে দেশের কোন নেতা বা সাধারণ নাগরিক ‘পাস’ বা পূর্ব অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাস বা হোস্টেলে প্রবেশ করতে পারে কি না। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে গিয়ে ঘুরে আসুন এবং দেখুন, অনুমতি ছাড়া রাত্রি তিনটায় আপনি ঢুকতে পারেন কিনা। শুধু পাকিস্তান যেতেই কি ভিসা লাগে? তো কয়টি দেশে গিয়েছেন? ভিসা ছাড়া পৃথিবীর কোন দেশ ভ্রমণ করেছেন? পৃথিবীতে এমন কোন দেশ আছে নাকি যে বিনা অনুমতি বা ভিসা ছাড়া ভ্রমণ করা যায়? ইন্ডিয়া, চাইনা, রাশিয়া, নেপাল, শ্রীলংকা, উগান্ডা, সোমালিয়া? দেশে যদি আইনের শাসন থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মেরুদণ্ড বলে কিছু থাকে তবে তাঁদের উচিৎ এই অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে মামলা করে ওকে আইনের আওতায় আনা। বুয়েটের ছাত্রাবাস কি বাজার, নাকি এখানে আপনার ক্রয়কৃত কোন ফ্ল্যাট আছে যে আপনি যখন খুশি যাবেন আর আসবেন? এ ছাড়া রাতে ক্যাম্পাসে প্রবেশ যেখানে বুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য নিষিদ্ধ, সেখানে রাত তিনটায় (৩১ শে মার্চ ২০২৪, প্রথম আলো) অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র, নেতা বা সাধারন পাবলিকের প্রবেশ সুস্পষ্টভাবে বুয়েটের নিয়ম নীতির লঙ্ঘন – এর জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিৎ।

বলা হচ্ছে যে ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং এটা বুয়েটে করতে দিতে হবে। ভাল কথা, কিন্তু এই অধিকার ক্যাম্পাসে কেন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে? বুয়েট বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং ছাত্রাবাসগুলো কি মারদাঙ্গা, র‍্যাগিং, চাঁদাবাজি আর রাজনীতির চর্চা বা খেলার মাঠ? এটা তো পড়াশুনার জায়গা যেখানে ছাত্ররা পড়বে, অনুসন্ধান (investigation) বা অন্বেষণ (exploration) ও বিশ্লেষণ (analysis) করবে, নতুন জ্ঞানের উৎস, তার চর্চা এবং যাচাই বাছাই করবে। আমাদের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি শিখতে আসে, আর এজন্যই কি তারা এখানে ভর্তি হয়? ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, এম আই টি, ইম্পেরিয়াল – পৃথিবীর এই সব সেরা এবং র‍্যাংকিং থাকা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা দুনিয়া থেকেই সবচেয়ে মেধাবীরা আসে পড়াশুনা করতে। এমনকি এইসব দেশের স্থানীয় ছাত্রদেরকেও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হিমশিম খেতে হয়। দেশের এবং বিদেশের এসব ছাত্ররা কি এখানে রাজনীতি শিখতে আসে? হ্যাঁ, তাঁরা এইসব প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা নিরীক্ষা, গবেষণা, অনুশীলন আর বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে তৈরি করে এক নতুন জ্ঞান; আর আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করি নির্যাতনের নতুন নতুন রেকর্ড। এগুলো সবই রাজনীতির অবদান।

এই ছাত্র সংগঠন এবং রাজনীতিবিদরা বুয়েটসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তাদের রাজনৈতিক দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করতে চায়। এটা কতটা বিদ্রূপাত্মক এবং স্ববিরোধী যে, ক্ষমতাসীনরা গনতন্ত্রের কথা বলছে অথচ বুয়েটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৯৯% ছাত্রের অরাজনীতিকরণকে মেনে না নিয়ে জোরপূর্বক ছাত্রদের উপর তাদের রাজনীতি চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। আর এটাকেই বলা হচ্ছে গণতান্ত্রিক চর্চা! এ এক আজীব চিত্র! কিছুদিন আগে যে ক্ষমতাসীন দলের ছেলেরাই আবরারকে সারারাত ধরে নির্যাতন করে খুন করল, অথচ তাঁর রক্তের দাগ না শুকাতেই এরাই আবার বলছে ছাত্র রাজনীতি শুরু করতে। যে গণতন্ত্র (!) নিষ্পাপ মেধাবী ছাত্র (দের) কে অত্যাচার করে মেরে ফেলতে শেখায়, জুনিয়রদেরকে ডেকে বাস্তব অথবা কল্পিত বিরোধী মতের কারনে সারারাত ধরে বছরের পর বছর পিটিয়ে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের অভ্যাস করায়, সহপাঠীদের অর্ধ-নগ্ন করে থুতু চাটায়, ধর্ষণে উৎসাহিত করে সেই গণতন্ত্রের আদৌ কোন প্রয়োজন কি আমাদের আছে? আমি হই আর আপনি হোন; যে কোন অবস্থায় খুনি এবং স্বৈরাচারের মুখে গনতন্ত্রের কথা কতটুকু মানায়?

দেশের স্বার্থে এবং জাতির স্বার্থেই বুয়েট রাজনীতিমুক্ত থাকা উচিৎ। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা এখানে পড়াশুনা করে; আমাদের উচিৎ তাঁদেরকে মুক্তভাবে চিন্তা করার স্পেস দেওয়া এবং কোন অবস্থাতেই তাঁদের উপরে কোন কিছু চাপিয়ে না দেওয়া। এ কথা ভাবা অমূলক যে তাঁরা রাজনীতি বুঝে না বা রাজনীতি সচেতন নয় বরং আমাদের দেশ এবং বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাপারে তাঁরা আমাদের অনেকের চাইতে অনেক বেশি সচেতন।

বুয়েটে বা যে কোন প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি করা যদি ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার হয়, তবে সেই একই প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি না করাও তো যে কারও গণতান্ত্রিক অধিকার। সমাবেশ, রাজনৈতিক দল করার এবং বাক-স্বাধীনতার অধিকার যদি মৌলিক অধিকার হয় তবে সমাবেশ এবং রাজনৈতিক দল না করার এবং রাজনীতি নিয়ে কথা না বলার স্বাধীনতাও কি একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার নয়? এখন কোন একটা প্রতিষ্ঠানের ৯৯% সদস্য যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে তাঁরা রাজনীতি করবে না, গণতন্ত্রের কোন নিয়মে আপনি তাঁদেরকে রাজনীতি করতে বাধ্য করবেন? এভাবে দেশের মেধাবী তরুণ সমাজের একটি অংশের উপর জোর করে রাজনীতি চাপিয়ে দেওয়া কি স্বৈরতন্ত্র নয়? প্রত্যেক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের রাজনীতি করা এবং না করার অধিকার আছে। আইন দিয়ে রাজনীতি করতে বাধ্য করা কতটুকু আইনসম্মত? ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতাকে রাজনীতির গোলামে পরিণত করা কতটুকু গণতান্ত্রিক এবং মানবিক?

কেন বুয়েটের ছাত্ররা ক্যাম্পাস এবং হোস্টেলকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে চায়? প্রাইমারী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রচণ্ড পরিশ্রমী এবং সারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রথম সারিতে থাকা এই মেধাবী ছাত্রগুলো যা থেকে মুক্তি চায় তা হলঃ, “র‍্যাগিং, অত্যাচার, চাঁদাবাজি, ক্ষমতা প্রদর্শনী, অন্যায় সুবিধাভোগ” (এপ্রিল, ২০২৪ দৈনিক শিক্ষাডটকম) এবং খুন ও নির্যাতন। কারণ তাঁদের কাছে এটা প্রমাণিত সত্য যে রাজনীতিই এইসব অভিশপ্ত কর্মকাণ্ডের মূল কারণ। তা যে কোন ছাত্র রাজনীতিই হোক না কেন। একটি দেশে সরকার বিদ্যমান, তার আশ্রিত প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন ক্রিয়াশীল এবং এদেরই দায়িত্ব ছিল এসব ছাত্রদের জান, মাল, ইজ্জত রক্ষা করা এবং তাঁদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্ত তাঁরা ব্যর্থ হলে বুয়েটের ছাত্ররা অহিংস পক্রিয়াই নিজেদের অরাজনীতিকরণের মাধ্যমে নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই নিশ্চিত করেছে এবং তা বহাল রাখতে চায়। এদের তো বরং সরকার এবং তার ছাত্র সংগঠনের সহযোগিতা করা দরকার। অথচ সহযোগিতার পরিবর্তে তাঁরা আবার সেই খুন এবং নির্যাতনের রাজনীতিই ফিরিয়ে আনতে চায়।

কিন্তু আপনারা কি একবারও ভেবেছেন যে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি পুনরায় চালু করার জন্য একটি মহল কেন ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের ব্যবহার করছে? একমাত্র বুয়েট বাদে সারাদেশে কি এমন কোন বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যাবে যেটা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না? এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলুন তো যেখানে তারা র‍্যাগিং, অত্যাচার, টেন্ডার/চাঁদাবাজি, ক্ষমতা প্রদর্শনী, ধর্ষণ এবং অন্যায় সুবিধাভোগ করছে না? এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলুন তো যেখানে সত্যিকার অর্থে আমাদের ছাত্রদের মানুষের মত মানুষ হয়ে বের হবার মত পরিবেশ আছে? ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেই এই মহলটি আস্তে আস্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো থেকে আমাদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, দেশপ্রেম, মেধা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করতে চায়। বাক স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে; বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে একমাত্র ক্ষমতাসীনরা ছাড়া আপনি আপনার সংস্কৃতি, বিশ্বাস, দেশপ্রেম এর কথা বলতে এবং চর্চা করতে পারবেন? জাতি এবং রাষ্ট্র হিসাবে ধ্বংস করতে হলে অবশ্যই আমাদের মধ্যকার সবচেয়ে মেধাবী অংশকে ধ্বংস করতে হবে। ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী হীরের টুকরা বুয়েট ঠিক এই ষড়যন্ত্রের শিকার বলেই মনে হচ্ছে।

সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, ক্যাম্পাস এবং ছাত্রাবাসই মোটামুটি ক্ষমতাসীনরা দখলে নিয়ে রাজনীতিকরণ করেছে কিন্তু পারেনি শুধু বুয়েটের ছাত্রদেরকে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই এক মুমূর্ষু রোগীতে পরিণত হয়েছে। আর বুয়েটে রাজনীতি চালু করার মাধ্যমে তারা আমাদের এই মেধার শেষ প্রদীপটাকেও নিভিয়ে দিতে চায়। বাংলাদেশে এমন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে রাজনীতি নিষিদ্ধ। আপনি চাইলেই কি ব্র্যাক এর মত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত আর্মি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য কর্পোরেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে রাজনীতির চর্চা করতে পারবেন? তাহলে এসমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সমাবেশ, রাজনৈতিক দল করার এবং বাক-স্বাধীনতার অধিকার কি মৌলিক অধিকার নয়? তাঁদের জন্য তো শাসক দলের ছাত্র নেতারা রাজনীতি বাধ্য করার কথা বলে না; তাঁদের জন্য তো কোন আইন হয় না।

গত দুদিনে বুয়েটের ছাত্ররা যেভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রধানের কাছে আবেদন নিবেদন করেছে তা নজিরবিহীন। ক্যাম্পাসে ছাত্রদের রাজনীতি বন্ধের জন্য তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক, প্রশাসনিক, ডিসিপ্লিনারি এবং সিন্ডিকেটই যথেষ্ট ছিল; আর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রশাসন বা ঢাকার জেলা প্রশাসক হলেই হয়ে যেত কিন্তু ছাত্ররা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছে এবং এটা করতে গিয়ে বারংবার প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর বাবার রেফারেন্স টেনেছেন। এবং যেভাবে তাঁদের স্তব স্তুতি করেছেন তাতে তো ছাত্রলীগের সাথে আপনি এদের কোন তফাৎ দেখতে পাবেন না। তারাতো হিজবুত তাহরির, শিবির, মৌলবাদ, সবকিছুকেই প্রতিহত করার সর্বোচ্চ আল্টিমেটাম দিয়েছে — এগুলো তো ক্ষমতাসীন দল এবং ছাত্রলীগেরও মূল লক্ষ্য। তাহলে এদের দাবি মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়? ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের অনুপস্থিতিতে যদি তাঁরা ছাত্রলীগের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করে তাহলে তারা কি সাধুবাদ পাওয়াটা ডিজার্ভ করে না? দর্শনগত ভাবে বললে (philosophically speaking), এটা বলতেই হবে যে আওয়ামীলীগ বুয়েটে অনেকটাই সফল হয়ে গেছে।

ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি এই কোমলামতি ছাত্রদের কোথায় নিয়ে গেছে দেখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রশাসন, সিন্ডিকেট, পুলিশ, জেলা প্রশাসক – কোন কিছুই কাজ করছে নাঃ এগুলো হল নখ-দন্তহীন বাঘ। ছাত্ররা জেনে গেছে প্রধানমন্ত্রী যা বলবেন তাই হবে কারণ তিনি হলেন স্বয়ং আইন। আমরা বুঝি যে ছাত্ররাও নিরুপায় এবং এটা করা ছাড়া তাঁদের উপায় নেই। বস্তুতঃ আমরা আমাদের প্রজন্মের স্বাধিকার এবং প্রতিবাদ করার স্পিরিট বা স্পৃহাকে এভাবেই দিনে দিনে নষ্ট করেছি। অধিকার এবং প্রতিবাদের ভাষা যখন স্তব-স্তুতি এবং তোষামোদে পরিণত হয়, মেরুদণ্ডহীন ভিক্ষুকের মত তখন করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আর উপায় নাই।

ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অভিযোগ বুয়েটে হিজবুত তাহরির এবং শিবিরের আনাগোনা বেড়ে গেছে। এব্যাপারে আপনাদের একটা বিশ্ববিখ্যাত নাটকে নিয়ে যাই।

শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটক ম্যাকবেথ এর নায়ক ম্যাকবেথ রাজা ডানকানকে খুনের পর তার ক্ষমতা নিশ্চিত এবং পাকাপোক্ত করতে একের পর এক খুনের নেশায় মেতে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় সে তার প্রিয় সহ কর্মী, সাথী এবং আর এক জেনারেল ব্যাংকোকে হত্যা করে। কিন্তু খুন হবার পরে ব্যাংকোর আত্মা/প্রেতাত্মা (ghost) কিছুতেই ম্যাকবেথকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিল না। এই যেমন রাজদরবারে ম্যাকবেথ দেশের নোবল তথা জ্ঞানী গুণীদের নিয়ে আলোচনায় বসেছেন এমন সময় সে ব্যাংকোর ভুত দেখে আঁতকে উঠে উল্টা পাল্টা বকতে শুরু করে। ক্ষমতার মসনদ স্থায়ী করতে, পারলে এই ভূতকেও সে হত্যা করে। কিন্তু কাল্পনিক ভূত আর ভয়কে তো আর ভাড়া করা খুনি দিয়ে খুন করা যায় না। যায় হোক, অবশেষে তাঁর স্ত্রী লেডি ম্যাকবেথকে এসে পরিস্থিতি সামলাতে হয়।

বেচারা ম্যাকবেথ খুবই সোজা-সাপ্টা লোক, উপস্থিত বক্তৃতা এবং যে কোন অনভিপ্রেত প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবার দেবার মত আছে তাঁর দারুণ এক যোগ্যতা। কিন্তু যখন করার মত কোন কাজ থাকে না তখন সে অস্থির হয়ে যায় এবং অদ্ভুত সব অলীক আর ভয়ংকর কল্পনা তাঁকে গ্রাস করে ফেলে। আর এসব ভয় এবং কুসংস্কার দূর করার জন্য আবারও এগিয়ে আসে খুনের ইন্ধনদাতা লেডি ম্যাকবেথ।

আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থা হয়েছে ম্যাকবেথের মত। তাঁরা হিজবুত তাহিরকে শহীদ (নিষিদ্ধ) করেছে, শিবিরকে পঙ্গু করে দেশ ছাড়া করেছে (কার্যতঃ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের সকল কর্মকাণ্ড স্থগিত করেছে) অথচ তাদেরই ভুত এই নেতাদের ঘুমকে হারাম করে দিয়েছে। তাঁরা রাজনীতি-নিষিদ্ধ বুয়েটে হিজবুত তাহরির এবং শিবিরের ভুত দেখেছে। এখন এই ভূত তাড়ানোর জন্য রাজনীতি চালু করতে হবে যাতে করে ছাত্রলীগ পুলিশ হয়ে এই ভুতগুলোকে ক্যাম্পাস থেকে তাড়াতে পারে। কি অদ্ভুত যুক্তি! এটা কি যৌক্তিক কোন কথা নাকি মানসিক রোগ, তা আপনারাই বিবেচনা করুন।

দেশ এবং জাতির স্বার্থে যে কোন মূল্যে বুয়েটকে রাজনীতি মুক্ত রাখতে হবে। বুয়েট একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান ; এটাকে কোন রাজনৈতিক দলেরই শাখা বা কার্যালয় বানানো যাবে না। পৃথিবীর কোন আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানেই রাজনীতির চর্চা হয় না। আর স্থানীয় ছাত্র রাজনীতির কথা তো চিন্তাই করা যায় না। বুয়েট চলে জনগণের টাকায় – এটা কোন রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী বা কোন মহলের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। আর বুয়েটের ছাত্ররা হল সেই জনগণের সন্তান সন্ততি – তারাই সিদ্ধান্ত নিবে তারা রাজনীতি করবে কি করবে না। ক্ষমতা বলে তাঁদের উপর রাজনীতি চাপিয়ে দেওয়ার অর্থ হল বুয়েটের একাডেমিক কর্মকাণ্ডকে রাজনীতিকরণ (politicised) করে ছাত্রদেরকে মারামারি, কোন্দল এবং রাজনীতিতে ব্যস্ত রেখে তাঁদের মেধার বিকাশকে ধ্বংস করা যা মেধা ধ্বংসের এক অপরাজনীতি। যদি তাই হয় তবে এটা আমাদের দেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সুগভীর এক ষড়যন্ত্র।

আমার খুব অবাক লাগছে যে দেশের সচেতন বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিভাবক, নাগরিক সমাজ এবং আলেম উলামারা কেন এসব নির্যাতিত ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে কথা বলছেন না এবং ঐতিহ্যবাহী বুয়েটকে রক্ষা করার জন্য কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে আসছে না। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ ভেদে এটা তো সবারই স্বার্থের ব্যাপার। নাকি তাঁরা ভাবছেন যে এ বিষয়ে কথা বলার সময় এখনও আসেনি।

Share this post

Leave a Reply