লেখক, দার্শনিক, প্রফেটস এবং ফ্যাসিজম (কিস্তি ২)

Share this post

নবী রাসুলদের প্রসঙ্গটা জরুরী এই জন্য যে তাঁদের প্রত্যেকেরই একটি অভিন্ন দর্শন ছিল যা দিয়ে তাঁরা বিভিন্ন ফ্যাসিস্টের শাসন, আইন, সামাজিক রীতিনীতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ – এসবকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এটা করতে গিয়ে তাঁরা প্রায় সবাই চরমমাত্রায় দৈহিক, মানসিক, সামাজিক এবং দার্শনিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এরপরে যুগে যুগে অনেক ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে আজও তাঁদের দর্শন মানবজাতিকে পথ দেখাচ্ছে । ক্ষমতার জন্য যদিও প্রফেটসরা ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতাকে কক্ষনই চ্যালেঞ্জ করেননি কিন্তু তবুও তারা (ফ্যাসিস্টরা) ধরেই নিয়েছিল যে প্রফেটদের দর্শন, সংস্কার এবং সর্বোপরি আল্লাহর একত্ববাদ তাঁদের ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিবে। তাঁদের দর্শনের আলোচনা, প্রচার এবং রাস্তা এখনকার অনেক দর্শনের মত কক্ষনই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। যায় হোক ফিরে আসি প্রফেটসদের সাথে আমাদের মিলের দিকে।

আমার কণ্ঠটা খুব সুন্দর এবং আমি ভাল গান গাইতে পারি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দাউদ (আঃ) কে ও খুব সুন্দর কণ্ঠ দিয়েছিলেন। তাহলে কি আমি বলতে পারিনা যে এদিক থেকে মহান আল্লাহ আমাকে দাউদ (আঃ) এর মতই ভালবাসেন? আমি এতিমদের ভালবাসি এবং সুবিচার করতে পছন্দ করি; আমাদের রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কেও আল্লাহ তায়ালা এই গুণগুলো দিয়েছিলেন। এখন এটা অনুভব করা কি অন্যায় হবে যে এই ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা আমাকে রাসুলের (সাঃ) এর মত ভালবাসেন। অন্যভাষায়, রাসুলের চার কন্যা সন্তান ছিল; আল্লাহ আমাকেও অনুরূপ সন্তান-সন্ততি দিয়ে আমাকে আনন্দিত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা কি একই রহমতে আমাকে ধন্য করেননি?

প্রশ্ন হল যে নবী/রাসুলরা যেভাবে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন, আমরা কি সেই একই আবেগ, বোধ, ভালবাসা এবং গভীরতা নিয়ে তা করতে পারি? বলে রাখা ভাল যে নবী/রাসুলরা হলেন আল্লাহর পছন্দনীয় মনোনীত মহাপুরুষ (Chosen people) । কিন্তু এটাও ঠিক যে তাঁরা আমাদের মতই মানুষ ছিলেন এবং তাঁরা সর্বাবস্থায় তুষ্ট থাকতেন। এখন তাঁদেরকে দেওয়া সবকিছুর জন্য তাঁরা আল্লাহকে তাঁদের চিন্তা, কথা এবং কাজে যেভাবে ধারণ করতেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন, আমরা সেই একইভাবে তা করতে পারি না। ঠিক তাঁদের মত করে আমরা আমাদের রবকে মাথা এবং হৃদয় দিয়ে বুঝি না। তফাৎটা এই মানা এবং বুঝের মধ্যে।

আমরা তো সবাই আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। আল্লাহ দয়াশীল; আমরা কি আল্লাহর এই দয়াকে ধারণ করে নবী/রাসুলদের মত নিঃস্বার্থ দয়াশীল হতে পেরেছি? আল্লাহ সুবিচারক; আমরা কি আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে সেই রকম সুবিচার করি যেভাবে নবী রাসুলরা করেছেন? আল্লাহ মহান এবং নিঃস্বার্থ; আমরা কি নিঃস্বার্থ এবং পরোপকারী গুণগুলোকে ধারণ করেছি যেভাবে নবী রাসুলরা করেছেন আল্লাহকে ভালবেসে? পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, তাঁরা ছিলেন আল্লাহর প্রকৃত প্রতিনিধি যারা রবের এই গুণগুলিকে অকৃত্রিমভাবে ধারণ করতেন যা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেকগুণের মতই কোন প্রফেটই জীবনে কক্ষনও মিথ্যা বলেননি; তাঁরা কক্ষনই স্বার্থপর ছিলেন না; কোন বাজে ভাষা ব্যবহার করেননি; কারও উপর ক্ষুদ্রতম জুলুম করেননি, তাঁদের মিশনের জন্য কোন পয়সা কড়ি নেননি এবং রবের কোন নির্দেশের নূন্যতম সমালোচনা, সন্দেহ, অভিযোগ বা বিরোধিতা করেননি বরং সেগুলো শুনামাত্রই আনন্দচিত্তে মেনেছেন। আমাদের কি এইরূপ গুণ, শক্তি এবং মানসিকতা আছে?

নবী রাসুলগণ এই বোধশক্তি এবং একে ভাষায় রূপান্তরিত করে তা ক্ষমতাসীন, প্রভাবশালী এবং সাধারণ লোকজনকে বুঝাতেন যা একজন কবি, লেখক এবং দার্শনিকও করে থাকেন। আমরা আগেও বলেছি যে একাজ করতে গিয়ে নবী রাসুলগণ আল্লাহ কর্তৃক চালিত হতেন যেখানে কবি, লেখক এবং দার্শনিকরা চালিত হন একান্তই নিজেদের চিন্তা, চেতনা, মূল্যবোধ এবং পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা। উপরন্তু, একজন নবী বা রাসুলের অতিরিক্ত একটি কাজ করতে হয় আর তা হল এই বুঝকে বাস্তবে রূপদান করে দেখানো যাতে অন্যরা অনুসরণ এবং অনুকরণ করতে পারে। এটা লেখক, কবি বা দার্শনিকের জন্য জরুরী নয়; তাঁরা শুধু তাঁদের ধারণা লেখাবন্দি করে দিলেই হলো। যেমন ধরেন, গত এবং বর্তমান শতাব্দীতে অনেক দার্শনিক তত্ত্ব বা ধারণার জন্ম হয়েছে কিন্তু সেগুলোকে বাস্তবে রূপান্তর বা দেখানোর দায়িত্ব একজন দার্শনিকের উপর বর্তায়নি এবং সেটা কেউ দেখায়ওনি। সক্রেটিস থেকে শুরু করে আধুনিক দার্শনিকদের মাথায় সে সব সুন্দর এবং অনন্য চিন্তার উদ্রেক হয়েছে তা তাঁরা লিখেছেন এবং প্রচার করেছেন। আর আমরা পাঠকরা এবং কোন কোন রাজনীতিবিদরা সেগুলো পড়েছি, ক্রিটিক্যালি বিশ্লেষণ করেছি এবং কেউ কেউ রাষ্ট্রে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছি; যদিও এগুলোর মধ্যে কোন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাহিত্যিক দর্শনই এখন পর্যন্ত এবসলিউট হিসাবে প্রমাণিত হয়নি। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে যে নবী রাসুলদের দর্শনই বা কি এবং তাঁরা এগুলো কিভাবে বাস্তবে রূপদান করেছেন?

এমন কোন ফ্যাসিবাদ পাওয়া যাবে না যে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে, নিজেকে আল্লাহ বা খোদার মত ভাবেন না। প্রত্যেক নবী এবং রাসুল তাঁদের দর্শন উপস্থাপন করেছেন সমসাময়িক ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করে; এবং তা করেছেন বা করতে চেয়েছেন একটা সমতাভিত্তিক, জুলুমমুক্ত সমাজ এবং শাসন কায়েমের মাধ্যমে। এবং ইন্টারেস্টিংলি কোন নবী রাসুলই জোর করে সেগুলো চাপিয়ে দেননি বা দেবার চেষ্টাও করেননি; বরং আল্লাহর নির্দেশে তাঁরা প্রত্যেকেই সেটা করেছেন একটা ডিসকোর্স বা বয়ানের (discourse) মাধ্যমে। তাঁরা তাঁদের দর্শন বিরোধীদের সাথে শেয়ার করেছেন, তাঁদের যুক্তিগুলোও শুনেছেন, ডিবেট করেছেন এবং সবশেষে তাঁরা (নবী রাসুলরা) নিজেদের দর্শনের পক্ষে কংক্রিট বা সাক্ষাৎ প্রমাণ দিয়েছেন। সেই দর্শন তাঁরা কায়েম করেছেন তাঁদের নিঃস্বার্থ ভালবাসা, ত্যাগ এবং দুনিয়াবি এবং ঐশী জ্ঞানের মাধ্যমে; তাঁদের সবার চরিত্র ছিল ফুলের চেয়েও পবিত্র। ফ্যাসিবাদ কক্ষনই চায় না তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকুক; আর রবই হলেন তার সবচেয়ে বড় শত্রু। সেজন্যই সে নিজেকে জেনে বা না জেনে খোদা বানিয়ে নেয়। পৃথিবীর সব ফ্যাসিবাদরাই কখন ধর্ম, কখন সেকুলারিজম, কখন গণতন্ত্র, কখন সমাজতন্ত্র অথবা এগুলোর মিশ্রণ করে আল্লাহ বা রবের একত্ববাদ, ভালবাসা, সুবিচার এবং অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ফ্যাসিবাদের ভণ্ডামি এবং অসার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও একত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করা এবং সেটাই যে একক এবং শ্রেষ্ঠ তা প্রমাণ করে দেখিয়ে দেওয়াই ছিল নবী রাসুলের দর্শন।

আলোচনাটা এই জন্যই গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি যতটা পলিটিক্যাল বা রাজনৈতিক তার থেকে অনেক বেশী দার্শনিক। নবী রাসুলরা তাঁদের দর্শন, চিন্তা-ভাবনা এবং যুক্তিগুলো মুখোমুখি (face-to-face) প্রচার করেছেন কারণ তাঁরা মনে করতেন যে তাঁদের একত্ববাদের দর্শনই কেবল মানুষের সত্যিকার মুক্তি আনতে পারে। আমরা আগেই বলেছি তাঁরা কক্ষনই ক্ষমতা চাননি; তাঁরা চেয়েছেন ফ্যাসিবাদমুক্ত একটা সমাজ বা রাষ্ট্র যা তৎকালীন সময়ে একজন অহংকারী, ক্ষমতালোভী, যালিম এবং আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর মানুষ এবং তার কিছু সাঙ্গপাঙ্গদের হাতে জিম্মি হয়ে গিয়েছিল।

ফেরাউন এবং নম্রুদের মত এ সকল ফ্যাসিস্টরা এটাই ভাবত যে তারাই জাতির একমাত্র ত্রাতা, তাদের শাসন পদ্ধতিই বিশ্বসেরা, ক্ষমতা কেবল মাত্র তাদেরই প্রাপ্য এবং দেশের স্বার্থে যা কিছু করবে তার মধ্যে কোন ভুল নেই। অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা, মানুষের পূজা, উত্তরাধিকার বা জন্মসূত্রে রাজ্যের অধিকর্তা এবং রাষ্ট্রের একক সার্বভৌম মালিকানার ফলে তাদের মধ্যে তাদের নিজস্ব ব্যাক্তি-একত্ববাদের ধারণা এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে তারা নিজেদেরকে খোদার মত করে ভাবত। এই জন্য নবী রাসুলগণ ভোট, জনমত বা ক্ষমতার কথা বাদ দিয়ে প্রথমেই যে বিষয়টা নিয়ে তাদের কাছে গিয়েছে তা হল আল্লাহর একত্ববাদ এবং সার্বভৌমত্ব। আল্লাহর এই একত্ববাদ এবং সার্বভৌমত্ব ছিল মানুষের বসবাসস্থল, তাঁর দেহ, আত্মা বা হৃদয়ের উপর যা মানুষ ভালবেসে গ্রহণ করবে এবং আল্লাহকে বাদে আর কাউকে তাঁদের রব, ইলাহ বা মালিক হিসাবে গ্রহণ করবে না। রাতের অন্ধকারে অথবা ভোরবেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষ মসজিদে যায় কেন? নিতান্তই দায়িত্ব এবং আল্লাহর প্রতি গভীর ভালবাসার কারণে।

মানুষ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও একত্ববাদকে তাঁদের হৃদয়ে ধারণ করে বলেই আল্লাহর ভালবাসায় তাঁদের জান এবং মালকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। নবী রাসুলগণ আল্লাহর এই একত্ববাদ এবং সার্বভৌমত্বের ধারনাকে সফলতার সাথে মানুষকে বুঝিয়েছেন। ফ্যাসিস্টদের কাছে একত্ববাদের এই দর্শন গ্রহণ করা ছিল আত্মহত্যার শামিল আর এখানেই দ্বন্দ্বটা প্রকট হয়ে উঠে। আমরা আরও জানি যে কিছু ফ্যাসিস্ট আমাদের রাসুলকে ক্ষমতার লোভও দেখিয়েছিল; আর রাসুল তাদেরকে দুনিয়া এবং আখিরাতে তাঁদের থেকে অনেক অনেক বেশি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং ক্ষমতার নিশ্চয়তা দিয়েছিল কিন্তু তবুও তারা একত্ববাদের দর্শন মেনে নেয়নি কারণ এটা মেনে নিলে ফ্যাসিস্টদের খোদায়ী শক্তি ধ্বংস হয়ে যায়, তাঁদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক হীন স্বার্থ বিলীন হয়ে যায়।

প্রত্যেক ফ্যাসিস্টই নিজেদের জন্য একটি দর্শন তৈরি করে এবং সে নিশ্চিত থাকে যে তার দর্শনই এক, অদ্বিতীয় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ যা তাকে যুগ যুগান্তর ধরে টিকিয়ে রাখবে। এভাবেই অর্থ, বিত্ত, সিন্ডিকেট, পেটোয়া বাহিনী, গোপন কিলিং মিশন, ধর্ষণ, জেল-জরিমানা, প্রোপাগান্ডা, দলীয়-সমর্থন এবং ক্ষমতার দাপটে সে তার দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আমি আপনাদের সামনে মাত্র দুটি ঘটনা তুলে ধরব যার মাধ্যমে আপনারা দেখবেন যে ফ্যাসিস্টরা কিভাবে কাজ করেছে এবং পরাজিত হয়েছে। আপনারা আরও দেখতে পাবেন নবী রাসুলদের দর্শন কিভাবে কাজ করে এবং কিভাবে তাঁদের দর্শনের উপর ভিত্তি করে আইন তৈরি হয়।
প্রথমেই আসেন আমরা লুত (আঃ) উদাহরণ দেই। কি সেই ঘটনা?

আমরা আগেই বলেছি যে শুধু মানুষই ফ্যাসিস্ট হয় না, কখন কখন একটি দর্শনও ফ্যাসিস্ট হতে পারে। এটা একটা দানবের মত যা একজন ফ্যাসিস্ট নিজ হাতে তৈরি করে এবং পরে তাকে দিয়ে দানবীয় সব বর্বরতা করায় এবং কখনও কখনও এর উপর শেষে সে তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই ফ্যাসিস্ট দর্শন এতটা অহংকারী এবং যালিমের মত হয় যে সে অন্যদের স্বাধীনতাকে হরণ করে, কথা বলতে দেয় না, সমালোচনা করাকে রাষ্ট্র বিরোধী মনে করে এবং বিরোধী মতকে ততটুকু স্পেস বা কথা বলার অধিকার দেয় যতটুকু দিলে তার হিপোক্রিসি এবং জুলুম খর্ব হবে না। সে আসল খোদাকে খোদা হিসাবে তো মানেই না; বরং অস্বীকার করে এবং নিজের জ্ঞানে বা অজান্তেই খোদা বনে বসে। নবী রাসুলদের দ্বারা প্রচারিত আল্লাহর একত্ববাদ ও সার্বভৌমত্বের সাথে ফ্যাসিস্টদের লড়াইটা ছিল মূলত: এইখানে।
তাহলে আসুন দেখি লড়াইটা কিভাবে বেধেছিল যা এখনও চলমান।

এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় আমার দেশ পত্রিকায় ২৯ নভেম্বর ২০২৪

Share this post

Leave a Reply