গল্প হল দুই ধরনেরঃ একটি হল কাল্পনিক বা বানানো ঘটনাসূমহকে শৈল্পিক রূপ দিয়ে আনন্দের মাধ্যমে মানব জীবনের কোন একটি সত্য বা শিক্ষাকে বের করে আনা। এক্ষেত্রে ঘটনা (events), চরিত্র (characters), সেটিংস (setting), সংঘাত (conflict) এবং কল্পচিত্র (image) – এগুলোর কোনটি সত্য অথবা মিথ্যা অথবা সবগুলোই মিথ্যা অথবা কিছু সত্য এবং কিছু মিথ্যার মিশ্রণ হতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা ইশপের গল্পের উদাহরণ টানতে পারি, যেখানে কাল্পনিক বা বানানো চরিত্র এবং ঘটনা থাকে, কিন্তু ঘটনার শৈল্পিক সংযোজন, ছবির মত প্রতিফলন এবং জীবনমুখী উপস্থাপনার মাধ্যমে একটা প্রফুল্ল বা আনন্দময় পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়। এখানে চরিত্রের সাথে ঘটনার সংযোজন, সাহিত্যিক/ভাষার কলা-কৌশল (literary/language device), রুপক ভাষা (figurative language), আপাত/কল্পিত (made-up) উত্তেজনা, মানবিক আবেদন (mental appeal) বা চাপ, নকল সংঘাত (fake conflict), আগ্রহ (curiosity), এবং উৎকণ্ঠা (suspense) থাকে; সবশেষে গল্পের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে একটা নৈতিক শিক্ষা, উপদেশ এবং মানব জীবনের এক সত্য বা বাস্তব অবস্থা (true state of life) – যা হয়ে উঠে সমস্ত গল্পের একক সার সংক্ষেপ বা মুল ফোকাস।
একটা গল্পের রুপান্তর হতে পারে; এক লেখকের একটি টেক্সট এক বা একাধিকবার পরিবর্তন হতে পারে । তাঁর মানে কোন একজন বড় উপন্যাসিক বা নাট্যকারের লিখিত নাটক অন্যদের দ্বারা সম্পাদনা (edited) হতে পারে। আর তা যদি সত্যি সত্যি হয়ে থাকে তবে তা হয় দুইটি চিন্তা, আবেগ বা মনের প্রতিফলন এবং এই পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জিত টেক্সটি হয় উঠে আগের টেক্সটের ডিকন্সট্রাকশন (deconstruction) বা বিনির্মান । যেখানে পূর্বের টেক্সটকে পুরোপুরি নষ্ট বা ধ্বংস না করে এটাকে পুনরায় এমনভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে নির্মান করা হয় যাতে পরিবর্তিত এই টেক্সটটিকে আগের থেকে ভিন্নভাবে বুঝা এবং উপভোগ করা যায়। এই ধরণের সম্পাদনাকে ডিকন্সট্রাকশন এইজন্য বলছি যে এক্ষেত্রে টেক্সটের মধ্যে থেকে অনেক কিছু শুধু কেটে ফেলা বা বাদ দেওয়াই হয়না (যা সাধারণত এডিট বা সম্পাদনায় করা হয়) বরং এটাকে এমনভাবে ভেংগে আবার নতুন ভাবে গড়া হয় যে আগের গঠন (structure) এবং অন্তর্নিহিত অর্থেরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয় । এভাবেই একজন কবি এবং লেখক আমাদের জীবনের কোন একটি সত্য বা অস্পষ্ট ধারণাকে ভেঙ্গেচুরে আবার নতুন সত্যে এবং সুস্পষ্টভাবে নির্মান করার চেষ্টা করেন।
এ ব্যাপারে আমরা স্বয়ং শেক্সপিয়ারের উদাহরণ দিতে পারি। আঠারশ শতাব্দীর প্রায় গোটাটা ধরেই শেক্সপিয়ার এর কাজের তীব্র সমালোচনা হয় এবং বলা হয় যে তিনি যতটা না ছিলেন শিক্ষার (হয়ত জ্ঞানের ও বলা যায়) কবি তার থেকে বেশি ছিলেন প্রকৃতির কবি (a poet of ‘nature’ rather than learning) এবং আরও বলা হয় যে তাঁর ছন্দ (versification), শব্দভাষা (diction), শ্লেষ (pun), প্লট (plot), চরিত্রায়ন (characterization) এবং থ্রি ইউনিটি গুলো ছিল বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ । ফলে আঠার এমনকি উনিশ শতকেও তাঁর নাটকগুলো নিয়মিত পূনর্লিখিত (regularly rewritten) হয় যাতে তাঁর কর্মগুলো সমসাময়িক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে উপভোগ করা যায়। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে আঠার শতকে King Lear কখনই মঞ্চায়িত হত না কারণ এর শেষটা ছিল খুবই তমসাচ্ছন্ন বা হতাশাজনক (gloomy)। অবশেষে ১৬৮১ তে নাহুম টেইট (Nahum Tate) এই King Lear পুনর্লিখন করেন যার শেষটা হয় অধিক সুখকর, যুক্তিযোগ্য বা যথাযথ। আমরা এখন শেক্সপিয়ারের লেখায় যে রোমান্টিক উপাদন বা ধারণা (conception) দেখি তাঁর জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান এই নাহুম টেইটের (Bennett and Royle, 2009, pages, 46-47)। আবার একই লেখক দ্বারা তাঁর বর্নিত গল্প তাঁর দ্বারাই এডিটেড বা বিনির্মিত হতে পারে বারে বারে। যেমন সমারসেট মম এর কথাই বলা যায় যিনি তাঁর একই গল্প গুলোকে অনেক বার পরিমার্জিত করতেন। এগুলো প্রকারন্তরে মিথ্যাকে আরও ভালভাবে সাজানোর একান্ত প্রচেষ্টা যাতে সত্যের কাছাকাছি যাওয়া যায়।
আরেকটি হল সত্যকে শৈল্পিক রূপ দেওয়া। সত্য এমনিতেই সুন্দর, শক্তিশালী, সার্বজনীন, গ্রহণযোগ্য এবং নির্ভেজাল আনন্দের উৎস। তারপরেও যদি এটিকে গল্পের অন্যান্য (সত্য) উপাদান দিয়ে সাজানো যায় তাহলে তা হয় অসাধারণ এবং অতুলনীয়। অর্থ্যাৎ মুল সত্য ঘটনাগুলোকে বাস্তব কনফ্লিক্ট বা সংঘাত, আবেগ, অনুভুতি, বাস্তব চরিত্র, চিত্র-কল্প এবং প্রেক্ষাপট দিয়ে দক্ষতা ও সুচারুরূপে ফুটিয়ে তুলা যায় তবে তা হয়ে উঠে অনেক বেশী উপভোগ্য, সুখকর, বিশ্বাসযোগ্য, শক্তিশালী এবং বিশ্বজনীন (universal)। ১০০% সত্য গল্প কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয় না। একজন কবি বা লেখক যখন নিজের বা অন্যের অনভুতিকে তাঁর মত করে প্রকাশ করে; মন বা হৃদয়ের অদৃশ্য কষ্টের অথবা সুখের অনুভূতিকে (internal feelings) আভ্যন্তরিন জগত থেকে বাহিরের জগতে এনে ভাষার মাধ্যমে দৃশ্যমান এবং শ্রুতিময়তা দিয়ে রূপদান (externalised) করে তখন তাতে অবশ্যই কিছু কম বেশী হবে; উপরন্ত, অন্যের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আবেগ, চিন্তা, অনুভব, কর্ম তৎপরতা হবহু প্রকাশ করা আরেকজনের পক্ষে কোন প্রকারেই সম্ভব নয়।
এটা তাঁর পক্ষেই সম্ভব যিনি কোনরূপ পরিবর্তন বা সংযোজন/বিয়োজন ছাড়াই অন্তরের অনুভূতিকে অবিকল বা হুবহু ভাষায় রূপ দিতে পারে; যিনি দয়াকে ধারণ করেন কিন্ত ভাষা এবং আবেগ দ্বারা তাড়িত বা চালিত হন না; যিনি প্রতিটা বলা এবং না বলা কষ্টের ভাষা জানেন কিন্তু কম বা অতিরঞ্জিত করেন না; যিনি ভাষাকে আবেগ এবং আবেগকে ভাষায় রূপান্তরিত করেন কিন্তু এসবের দাস নন এবং কক্ষনই মিথ্যা বলেন না ; যিনি রূপকল্প এবং প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করেন অথচ সর্ব প্রকার জাল (fake) বা সত্য-মিথ্যা মিশ্রণের উর্ধে; যিনি ভুলেন না বিধায় তাঁর চিন্তাভাবনাকে অবিকৃতভাবে তুলে ধরতে পারেন – এরকম একজন শিল্পীই কেবল পারেন অকৃত্রিমভাবে তাঁর ভাবকে ১০০% অবিকৃতভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরতে ।
লেখক ও কবির কাজ হল ভাব এবং ভাষা নিয়ে খেলা করা – এটা মুলত ভাবকে ভাষাতে রুপান্তরের খেলা যেখানে শ্রোতা বা পাঠক একজন লেখক এবং কবির লেখা ও কবিতা পড়া বা শুনার সময় কোন পরিবর্তন ছাড়াই ঠিক একই রকমের আবেগ অনুভুতিতে ডুবে যায় বা অনুভব করে; কোন কমও নয় বা কোন বেশীও নয়। কিন্তু এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? একজন লেখক বা কবির মনের গহীনে যে ব্যাথা বা ভালবাসার বুদবুদ তাঁর সাথে কোন প্রকার যোগ, বিয়োগ, গূণ, ভাগ না করে এবং তাঁকে কোনরূপ দুষিত না করে হবুহু ঠিক সেই অবিকৃত ভাবেই উপস্থাপন করা – এটা কি কোন লেখক বা কবি করতে পারবেন? আবার অবিকৃতভাবেই সেটা বুঝা এবং ধারণ করা – তা কি কোন শ্রোতা বা পাঠকের পক্ষে সম্ভব? এসব প্রশ্ন সামনে রেখেই একজন লেখক ও কবি তাঁর সকল মেধা ও প্রচেষ্টা নিয়োগ করেন।
সহজ ভাষায় বলতে হয় যে কোন লেখক বা কবি যখন তাঁর প্রিয়তমার সাথে মিলনে আনন্দিত হন; তাঁর প্রয়াণে বা চিরবিদায়ে কাতর হন; অথবা তাঁর সদ্যজাত কন্যা/সন্তানের মৃত্যুতে দুঃখভারাক্রান্ত মনে আবেগ প্রকাশ করেন এবং তা কবিতা বা গল্পের মাধ্যমে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন তা মুলত একধরনের স্থানান্তর । অন্যকথায় – এই কবিতা বা গল্পগুলো হল অস্পর্শযোগ্য, দৃশ্যহীণ সুখ, দুঃখ, অনুরাগ, উতসায়, ক্রোধ ইত্যাদি মানবিক অনুভবের কথায় প্রকাশ । এটাকে প্রথমত এক হৃদয় বা মন থেকে মুখের ভাষায় নিয়ে আসা হয় এবং তারপরে কবি বা লেখকের হৃদয় বা মুখ থেকে পাঠক বা শ্রোতার হৃদয় বা মনে পৌঁছে দেওয়া হয় । এগুলো আবার অভিনয় বা নৃত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করলে তা হবে দৃশ্যগত ফর্ম বা কাঠামো যা আমরা নাটক, সিনেমা বা নাচের মাধ্যমে বুঝে থাকি। যেহেতু এটা অদৃশ্য আবেগ বা উপলব্ধিকে দৃশ্যমান বা ভাষাশৈলিতে রূপান্তর করা সেহেতু একজন লেখক বা কবি অবশ্যই তাঁর আত্ম, হৃদয়স্থ বা অন্তরস্থ ভাব, আবেগ, চেতনা, মেজাজ বা বোধকে কক্ষনই অবিমিশ্র, প্রাথমিক বা মৌলিক ফর্ম বা কাঠামোতে উপস্থাপন করতে পারেন না; যোগ বিয়োগ তাঁকে করতে হবেই হবে। যখন আমাদের আম্মা/আব্বা/সন্তান/সন্ততি/স্ত্রি/ভাই/বোন মারা যায়,তখন আমাদের হৃদয়ে অপরিসীম কান্না এবং কষ্টের সাগর তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে এই কান্না, কষ্ট এবং ব্যাথা কি সুর, সংগীত বা নৃত্য আকারে হয়? অথবা তা কি কাব্যিক, ব্যাকারণিক বা ছান্দিক রুপে হয়? নিশ্চয় তা নয়? এমনকি গভীর আবেগময় কষ্ট বা সুখের মুহুর্তেও আমরা কবিতার ছন্দে নিশ্চয়ই কাঁদি না বা হাসি না বা ভাবি না। সুতরাং আবেগ, অনুভুতি এবং উপলব্ধির ভাষাময় বাক্যিক বা কাব্যিক কাঠামো কক্ষনই ১০০% মৌলিক বা অবিমিশ্র (pure) নয় বরং তা মিশ্র, সংযোজন, বিয়োজন এবং দূষণ থেকে কক্ষনই মুক্ত নয়।
অন্যভাবে বলা যায় যে কবিতা বা যে কোন সাহিত্য কর্ম হল একটি মৌলিক বিষয়ের নকল বা অনুকরন। আমাদের মনের মধ্যে যখন ভালবাসা, দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, প্রিয় হারানোর ব্যাথা অথবা সুখ, শান্তি, তৃপ্তি এবং প্রিয় বা প্রিয়ার সাথে দেখা বা মিলনের অপার তৃপ্তি – এই সমস্ত ভাবের সৃষ্টি হয় তখন একজন কবি বা লেখক সেই ভাবগুলোকে শব্দের মাধ্যমে আমাদের সামনে তুলে ধরেন। প্রেম, ভালবাসা এবং বেদনা — এই ভাবগুলোর না আছে কোন দৃশ্যমান আকৃতি, না আছে কোন রং, না আছে কোন স্বর, না আছে কোন স্বাদ । আর এই রকমই রুপ-রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শহীণ একটি ভাবকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন লেখক এবং কবি নামের শিল্পীরা। তাহলে যে কোন লেখা বা সাহিত্যকর্মকে কি ভাবের রূপান্তর বলা যায় না যেখানে একটা অদৃশ্য ভাবকে দৃশ্যমান বা শ্রুতিযোগ্য করা হয়? এটা এমন একটা রূপান্তর যা মৌলিক ও অপরিবর্তনীয় এবং এ ভাবগুলোকে তার পুর্ব অবস্থার হুবহু কাঠামোতে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। এটা একেবারে কাঠামোর রূপান্তরঃ ভাব কে ভাষায় বা অনুভূতিকে কথায় বা আবেগকে সঙ্গীতে। এটাকে ভাব, অনুভূতি বা আবেগের নকল বা অনুকরণও বলা যায়। মানুষের হৃদয়ে প্রেম আছে ভালবাসা আছে আর একই ভালবাসার প্রকাশ একেকজন একেকভাবে করেন। প্রেম, ভালবাসা, দয়া, মায়া এবং নিষ্ঠুরতার কোন নির্দিস্ট কাঠামো বা চেহারা থাকলে সব লেখক এবং কবিরা নিশ্চয়ই একই চেহারার একই ভাষা ব্যাবহার করতেন। অথচ এখানে মুল চিত্রটা হল প্রেম বা ভালবাসা যা একেক চিত্রকর (লেখক বা কবি) একেক ভাবে তুলে ধরেন। যে যত ভাব বা মূল চিত্রের কাছাকাছি যেতে পারে তাঁর চিত্রকর্ম তত সুন্দর হয়। প্লেটোর ভাষায় এগুলো হল ছায়া। মানুষের যেমন ছায়া আছে; আর এই ছায়া যদিও একজন মৌলিক বা আসল মানুষেরই তবুও ছায়া তো ছায়াই তাতো আর মানুষ নয়।
একজন কবি বা লেখক এই সত্যকে মাথায় রেখেই তাঁর অন্তরস্থ অনুভূতিকে সর্বোচ্চ সুন্দর করে বাক্যিক বা কাব্যিকভাবে উপস্থাপন করেন। এখানে সুন্দর হল সত্যের সর্বোচ্চ কাছাকাছি যাওয়া। কেহ যদি তাঁর মৌলিক চিন্তা বা উপলব্ধিকে এমনভাবে তুলে ধরে যে অতিরিক্ত সংযোজোন এবং বিয়োজনের ফলে তা অবাস্তব বা দূষিত হয়ে পড়ে তবে সত্য এবং সুন্দর এর পরিবর্তে পাঠকরা জীবনের এক কুৎসিত চেহারা দেখতে পাবে যা হবে বিভ্রান্তিকর, জটিল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ধবংসাত্মক ও বটে।
একজন লেখকের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। যেমন আমাদের যারা বাঘা বাঘা লেখক অতীত হয়ে গেছেন তাদের লেখায় যতই সার্বজনীন অনুভুতি, ধারণা বা মানবিক গুণ থাকুক না কেন তারা কখনই ভবিষ্যতকে ধারন করতে পারেনি যা মুলতঃ কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব না। যেমনঃ রবীন্দ্র অথবা নজরুলের লেখায় এই ২০২৩ সালের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে গ্রাম থেকে আসা স্বামী পরিত্যাক্ত গার্মেন্টসের একজন বিধবা মেয়ে এবং একজন দরিদ্র শিক্ষিত ছেলের রিলেশনশিপ কিভাবে এবং কেমন হবে তার কোন ধারণা পাওয়া কঠিন কারণ নিজেদের সময়কে অতিক্রম করে ভবিশত্যের এই ২০২৩ সালের সমাজে তাঁরা আসতে পারেন না। পরিষ্কার করে বলতে গেলে তাদের ১৯৫০-৬০ দশকের লেখায় কক্ষনই এই ২০২০-৩০ এর সমাজ ব্যাবস্থা, প্রসঙ্গ (কন্টেক্সট), প্রেক্ষাপট, সমস্যা এবং সংঘর্ষ আসতে পারে না, কারণ তখন তো গার্মেন্টস কারখানা এবং এর মধ্যে কাজকরা নিপীড়িত, নির্যাতিত, অসহায় নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত এবং চরম পুঁজিবাদী মালিক শ্রেণী এখনকার মত করে তৈরিই হয়নি। কাল্পনিকভাবে হয়ত অনেকে কিছু লেখার চেষ্টা করা যেতে পারে কিন্তু তা বাস্তব থেকে অনেক দুরেই থেকে যায়। এটা সব লেখক-কবিদের জন্য প্রযোজ্য ।
কন্টেক্সট বা প্রেক্ষাপট ও সমসাময়কিতা এক না হলেও বড় মাপের কবি এবং লেখকরা কিছু ইউনিভার্সেল এজেন্ট বা বিশ্বজনীন মানবানুভুতিকে নিয়ে কাজ করে যা সকল যুগে, জাতিতে, দেশে এবং সময়ে অপরিবর্তিত থাকে। যেমনঃ প্রেম, ভালবাসা, মায়া, মমতা, ক্ষমতা, লোভ, লালসা, খুনাখুনি – এসব এমন বিষয় বা ধারনা যা মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই ছিল এবং ভবিশ্যতেও থাকবে। হ্যাঁ একথা সত্য যে, এই ইউনিভার্সেল এজেন্টগুলো প্রত্যেক ব্যাক্তি বা চরিত্রভেদে আলাদা হয় আবার যে লেখকরা এগুলো উপস্থাপন করেন তাদের বাচনভঙ্গি, কৌশল এবং প্রকৃতি হয় ভিন্ন ভিন্ন। আর এটাই স্বাভাবিক এবং আবশ্যিক, কারণ প্রেম, দয়া এবং অহংকার নিয়ে লেখা দুজন লেখক বা কবির বাচনভংগি এবং উপস্থাপনা বা প্রেজেন্টেশন একই রকম হলে সেটা তো আর ভিন্ন কিছু হয় না। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্র এবং নজরুল একাকার হয়ে যায়; তাদের আলাদা কোন অস্তিত্ব থাকে না। উদাহরন দেওয়া যাক। নজরুলের কবিতায় প্রেম আছে আবার একইভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও প্রেম আছে; দুটোই প্রেম কিন্তু তা কি একরকম? আমরা আলাদাভাবে তাদের প্রেমের কবিতা বা উপন্যাস উপভোগ করি কারণ যদিও তা চারিত্রিক বা উপস্থাপনাগতভাবে আলাদা তেমনই ভিন্ন আবেগ অনুভুতিতে পরিপুর্ন এক সুন্দর একপ্রেশন বা প্রকাশ যা আমাদের মনের কথা এবং অনুভুতির সাথে মিলে যায়। এমন শত শত কবি এবং লেখক একই বিষয়ের উপরে লিখলেও আমাদের পড়তে সমস্যা হয় না কারণ তাদের প্রত্যেকের প্রকাশভঙ্গী, কন্টেক্সট, ব্যাকগ্রাউন্ড, সেটিংস এবং প্লট আলাদা। এভাবেই একজন লেখক সময়, দেশ, জাতিকে অতিক্রম করেন ।
এটা অনেকটা এমন যে এই সকল লেখক এবং কবিদেরকে একই নরম কাদামাটি দেওয়া হয়েছে এবং তারা একেকজন এই নরম কাদামাটি দিয়ে একেকরকম পুতুল মানুষ তৈরি করেছে। যে আরেকজনকে নকল করেছে সেই আর কবি বা লেখক হতে পারেনি; যে এই একই মাল মসলা দিয়ে ভিন্নধর্মী কিছু তৈরি করেছে সেই-ই কেবল হতে পেরেছে। আর যে যত অরিজিনাল বা প্রকৃত চেহারার কাছে যেতে পেরেছে সেই -ই তত ভাল আর্টিস্ট হতে পেরেছে।
প্লেটো কবিতাকে অপছন্দ করতেন বিষয়টা এরকম নয়। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হল এই যে কবি বা লেখকরা কবিতা বা গল্পকে যে চরম সত্য মনে করে এটা একদম ঠিক না। তাঁর মতে সাহিত্যকর্মে মিথ্যা থাকে – এটাকে সত্য বলার কোন অবকাশ নেই। আর এই এই মিথ্যা হল পৃথিবীর অনান্য মিথ্যার মত যেটাকে উনি রিপ্রেজেন্টেশন বা নকল (কপি) বলছেন । যেমন আমরা আমাদের আশে পাশে যে চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি দেখি এগুলো হল একটি মুল চেয়ার বা টেবিলের নকল কপি; আসল কপি ছিল একটাই এবং সেটা এখন আর নেই । ঠিক একইভাবে আমরা যা দেখি তা আসলে সবই নকল বা রিপ্রেজেন্টেশন যা আসল বা মুল জিনিসের নকল বা ছায়া।
একজন লেখক বা কবি যখন কোন কোন ব্যাক্তির সন্তানের অকাল মৃত্যুর কথা লিখেন, সে আসলে ঐ ব্যাক্তির অনুভুতিকে ধারন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাস্তবে কি এইরকম সন্তানহারা একজন পিতার অনুভুতিকে অন্য একজন ব্যাক্তির পক্ষে ধারন করা সম্ভব? এমনকি যদি এই অন্য একজনের সন্তানও অকালে মারা যায় তবুও হুবহু ঐ আগের ব্যাক্তির অনুভুতিকে একই মাত্রায় অনুভব করা সম্ভব নয় – এটা হলে তো দুটো আত্মা বা মনকে ১০০% একই রকম হতে হবে যা একেবারেই অবাস্তব। ফলশ্রুতিতে, একজন কবি বা লেখক আসলে অন্যের অনুভুতিকে অনুকরন করেন আর এটা প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে এর সাথে অনেক কিছু এডিশন বা সাবসট্র্যাকশন করতে হয়। একজন কবি বা লেখক যখন তাঁর মনের কথাগুলো লিখেন তা কেবলমাত্র নিজের পড়ার এবং আনন্দের জন্য নিশ্চয়ই লেখেন না। তিনি তো লিখেন নির্দিস্ট পাঠক সমাজের জন্য এবং এটা করতে গিয়ে অবশ্যই তাঁকে তাঁর সমসাময়িক সমাজ, ভাষা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, বয়স এগুলো বিবেচনা করতে হয়; উপরুন্ত তাঁর লিখার অনেক উপাদানগুলো তো তাঁকে তাঁর আশেপাশে থেকেই সংগ্রহ করতে হয়, তাই নয় কি? অন্যের জন্য লিখতে গেলে আপনাকে অন্যরা বুঝে এমন ভাষায় লিখতে হবে; সুতরাং কবি/লেখকের অরিজিনাল বা মূল আবেগ অনুভুতির সাথে যোজন-বিয়োজন করতেই হবে।
অনেক সময় কবির নিজের সন্ততি/সন্তান মারা গেলেও তার প্রকাশ হয় অনেকটা নাটকিয় যা আর্টিস্টিক্যালি সুন্দর কিন্তু বাস্তবে তা ১০০% সত্য হওয়া অসম্ভব। যেমন আমরা জানি যে নজরুল ইসলাম ছিলেন এমন একজন কবি যার আবেগ ছিল অত্যত্ন তীক্ষ্ণ এবং যিনি কবিতায় এবং গানে শব্দ নিয়ে এত ভাল খেলতে পারতেন যে এদিক দিয়ে তার তুলনা মেলা ভার। তাঁর সন্তান বুলবুলের অকাল মৃত্যু হল এবং সন্তানের এই অকাল মৃত্যুতে তাঁর যে দুংখ কষ্ট তা তাঁর গানের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে একজন বাবা সে মহাকবি হন আর বিদ্রোহী কবি হন সে কি তাঁর অনেক আদরের একমাত্র সন্তান মারা গেলে কবিতার মত ছন্দ মিলিয়ে ব্যাথিত হবেন বা চিন্তা করবেন? কিংবা গান বা সঙ্গীতের মত করে বিলাপ করবেন? তাঁর কান্না, তাঁর বেদনা – এসব কি কাব্যিক আকারে তাঁর হৃদয়ে নাড়া দিবে বা আন্দোলিত হবে? নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু তিনি ছিলেন এমন একজন কবি যিনি তাঁর সুখ এবং বেদনাকে কবিতা দিয়ে প্রকাশ করতেন। তাঁর সন্তানের মৃত্যু এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম নয়। ফলে এই দুঃখজনক মৃত্যুর কথা এবং এর ফলে তাঁর যে যাতনা এবং ব্যাথা সেটা তাঁর গানের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি। নিঃসন্দেহে তাঁর কষ্টটা মর্মদায়ক এবং খুবই কষ্টকর কিন্তু তিনি আমাদের সামনে যা উপস্থাপন করেছেন তা এডিশন বা মিথ্যামুক্ত নয় আর এই কারনেই তিনি যা বলছেন তা সত্যের খুব কাছাকাছি হয়েছে কিন্তু হবহু ১০০% সত্য হয়ে উঠতে পারেনি।
একজন লেখক বা কবি মহৎ হন কখন?
এক্ষেত্রে তাঁরা সাহিত্যকর্মে কিছু ইউনিভার্সেল এজেন্ট বা সার্বজনীন মানবিক গুনের উপস্থিতি ঘটান যা সকল ধর্ম-বর্ন-গোত্র-দেশ এবং কালের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। এই মানবিক গুণগুলোকে তাঁরা তাদের সমসাময়িক ঘটনা,ইতিহাস, সমাজ ব্যবস্থা, মূল্যবোধ, চরিত্র, আচরণ, চিন্তা, বিশ্বাস এবং কাজের মাধ্যম ও প্রেক্ষিতে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেন যে তা সহজেই এক কালকে অতিক্রম করে আর এক কালে স্থায়িত্ব লাভ করে।
অতীতে ভ্রমন করা যায় যেহেতু অতীতের কিছু ঘটনা আমাদের কাছে রেকর্ড হয়ে থাকে কিন্তু যা ঘটে নাই বা যার ব্যাপারে কিছুই জানিনা সেখানে ভ্রমন করা যায় না। যদিওবা ভ্রমন করা যায় তবুও সেটা পুরোটাই কল্পচিত্র। কিন্ত তারপরেও কথা থেকে যায়। অতীতে ভ্রমন করতে পারলেও সেই অতীতকে ১০০% ধারন করা বা নিজেকে বর্তমান থেকে অতীতে নিয়ে গিয়ে সেই সময়ের ঘটনা ও চরিত্রের সাথে পুরোপুরি একাকার হয়ে যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। যেমনঃ মাইকেল মুধুসুদুন দত্ত তাঁর মহাকাব্যে রামের সাথে রাবনের যুদ্ধের যে বর্ননা দিয়েছেন তাতে তাঁকে লেখার সময় তাঁর কল্পিত বা বানানো যুদ্ধের ময়দানে থেকে একবার রাম হতে হয়েছে আরেকবার রাবন হতে হয়েছে; মুধুসুদুন দত্ত একজন চরম প্রতিভাসম্পন্ন লেখক কিন্তু তাই বলে সে পুরোপুরি/হুবহু রাম এবং রাবনে রুপান্তরিত হতে পারেন না। তিনি যা পারেন তা হল ধর্ম, বীরত্ব, এবং পৌরাণিক কাহিনীর আলোকে তাদের চরিত্র বা চিন্তা-চেতনাকে মনোজগতে ধারন করা এবং এগুলোকে তাঁর সাহিত্যিক, দার্শনিক, ধার্মিক, কাব্যিক এবং শৈল্পিক মেধাশক্তি দিয়ে লাইফ-লাইক (verisimilitude) বা জীবন নির্ভর করে আমাদের সামনে ড্রামাটাইজড বা নাটকীয় করে উপস্থাপন করা।
আমরা মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট এর ক্ষেত্রেও অনুরুপ উদাহরণ টানতে পারি। শয়তান বা ডেভিল কিভাবে গডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল, এডাম এবং ইভকে ধোঁকা দিল – এসব কথা কাব্যিকভাবে বলতে গিয়ে তিনি শয়তানকে প্রথম দিকে কিছুটা গ্লরিফাই বা গৌরাবান্বিত করেছেন। এই এপিক বা মহাকাব্যে তিনি শয়তানের হয়ে তার (শয়তানের) রাগ, হতাশা, আবেগ, অনুভুতি, চিন্তা-ভাবনাকে তুলে ধরেছেন; এটা করতে গিয়ে তাঁকে শয়তানের চিন্তার সাথে নিজের চিন্তাকে একাকার করতে হয়েছে । মনে রাখতে হবে শয়তান জন মিল্টনের মত চিন্তা করবে না বরং শয়তানের চরিত্র চিত্রিত করতে গেলে মিল্টনকে ঠিক শয়তানের মত করে চিন্তা করতে হবে (তার মানে এই নয় যে তিনি শয়তান হয়ে গেছেন)। ঠিক একই ভাবে একজন লেখক বা কবি প্লট, পটভুমি বা খসড়া নির্মান করতে গিয়ে চেষ্টা করেন নিজেকে সমসাময়িক চরিত্রের সাথে একাকার করে দিতে; তা করতে গিয়ে তাঁকে একাই অন্য সব চরিত্রের চিন্তা ধারণ করতে হয়। যেমন শেক্সপিয়ার তাঁর হ্যামলেট নাটকে কখন চিন্তা করেন অফেলিয়া হয়ে আবার কখন অফেলিয়ার বাবা পলোনিয়াস হয়ে আবার কখন বা অফেলিয়ার প্রেমিক হ্যামলেট হয়ে। মুলতঃ এর মাধ্যমে একজন লেখক হয়ে উঠেন কৃত্রিম সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহ যেমন মানুষ তৈরি করে তাদের জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে-রিজিক এবং ভাগ্য নির্ধারন করেন ঠিক একজন লেখকও ইচ্ছেমত তার সৃষ্টি করা চরিত্রকে কখন কাঁদায়, কখন হাসায়, কখন জেলে পাঠাই, কখন বিপদে ফেলে, কখন মিলন ঘটায় আবার কখন মৃত্যু ঘটায়। এই কৃত্রিম সৃষ্টি কর্তারা সত্যকে আবিস্কার করার প্রয়াসেই তৈরি করেন চরিত্র, হাজির করেন চরিত্রায়ন, হাজার কল্প-চিত্র এবং ব্যবহার করেন ভাষার গাঁথুনি।
বিষয়টা আর একটু পরিষ্কার করা যাক। আমরা আগেও বলেছি যে গল্প,নাটক, কবিতা, চলচ্চিত্র, স্থাপত্যশিল্পসহ অধিকাংশ শিল্পই হল আসলের নকল কপি বা মিথ্যা অনুকরন। একটা উপন্যাস, কবিতা, মঞ্চনাটক অথবা চলচ্চিত্রে আমরা যে কান্না, হাসি, মারামারি, রক্তারক্তি, ঝগড়া-বিবাদ, ষড়যন্ত্র, হত্যা, বিষপান এবং মৃত্যুর অভিনয় দেখি বা করি – তা হয়ত কোন কালে ঘটেছিল কিন্তু মঞ্চে অভিনয় করা শিল্পীরা অথবা গল্পের চরিত্ররা সত্যি সত্যি মারা যান না, বিষপান করেন না, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হন না, রক্তারক্তি করেন না — এসবই সত্যিকার ঘটনার অনুকরন বা নকল যা আমাদের সামনে অভিনয় বা চিত্র-কল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। একজন কবি বা লেখকের এই ক্ষমতা নেই যে সে বাস্তবে মানুষ সৃষ্টি করবে, তাঁদের ভাগ্য নির্ধারন করবে আর তাঁদের মধ্যে সত্যিকার আবেগ-অনুভুতি-প্রেম-ভালবাসা-হিংসা-লোভ ঢুকিয়ে দিবে। সে এগুলোর উদ্ভাবকও নন। তাঁর এই সামর্থ্য নেই যে সে তাঁর গল্প বা নাটকের চরিত্রগুলোকে সত্যি সত্যি দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত করাবেন, খোনাখুনি করাবেন, বিষপানে হত্যা করাবেন, রাজা-রানী, স্বামী-স্ত্রী, রাত-দিন এবং রাক্ষস-রাক্ষসি বানাবেন । তিনি যা তৈরি করেন তা হল মানব জীবনের ডামি (dummy) বা পুতুল, বড় জোর বলা যায় জীবনের অবিকল প্রতিরুপ বা রেপ্লিকা (replica) যা আসল জীবনের একটা ছায়া, কপি বা অনুলিপি; কিন্তু তা কখনই জীবন্ত এবং সত্য নয়। এই জন্য কবি/লেখকদের আমরা আল্লাহর প্রতিনিধিও বলতে পারি কারন তাঁরা আল্লাহ বা এক গডের দেওয়া বাস্তব জীবনের আবেগ, অনুভুতি, প্রেম, ভালবাসা, সুখ, দুঃখ, হিংসা, ঘৃনা এবং বুদ্ধির মত বিষয়গুলোকে একইভাবে বিভিন্ন চরিত্রে, ঘটনায় এবং কর্মে অনুকরণ বা চিত্রিত করার চেষ্টা করে ।
এমন কবি বা লেখক খুবই কম পাওয়া যাবে যে বিশ্বমানের কবি আবার একই সাথে সে একটি দেশের প্রথম শ্রেণির প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রি । কবি ও লেখকের কাজ-কারবার হল অন্তরাত্মার অনুরাগ এবং আবেগ-অনুভুতি নিয়ে; আর রাস্ট্র-পরিচালনায় প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর কাজ -কারাবার হল যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে যেখানে দরকার হয় সুবিচার বা সুশাসন। কিন্তু আল্লাহ বা এক গড আমাদের জন্য কি করেন? তিনি কি কবি নাকি প্রধানমন্ত্রী? মুলতঃ তিনি সব; তিনি অন্তর-আত্মারও মালিক, রাজ্যেরও মালিক। তিনিই মহাবিশ্বকে সুশৃঙ্খলভাবে ম্যাথম্যাটিক্যালি চালান, জালিমকে উপযুক্ত শাস্তি দেন আবার তিনিই মায়ের মনে শিশুর জন্য অপরিসীম গভীর ভালবাসা তৈরি করেন। এখানে একজন অথার (author) বা রচিয়তার জন্য যা জরুরী তা হল সুবিচার বা জাস্টিস করা। যেহেতু লেখক ও কবিরা আল্লাহর প্রতিনিধি বা নকল-খোদার মত কাজ করেন সেহেতু তাঁরা তাঁদের ইচ্ছেমত বিশাল কাল্পনিক রাজ্য তৈরি করেন, রঙ বেরঙের চরিত্র বানান, একে অপরকে দিয়ে ভালবাসান, যুদ্ধক্ষেত্র-পাহাড়-নদী তৈরি করেন, সাতার কাটান, বিচ্ছেদ ঘটান, মনের আনন্দে ছন্দের খেলা করে্ন এবং মনের মাধুরি মিশিয়ে শব্দের প্রাসাদ গড়েন।
কিন্তু মনে রাখতে হবে এত কল্পনা, খেলা, যুদ্ধ, মিলন, বিরহ, জয়, পরাজয়, আনন্দ, স্বাধীনতা এবং ছন্দের নৃত্য – সবকিছুর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যঃ নিয়ন্ত্রণহীণ সম্ভোগ, বিভ্রান্ত জীবন দর্শন, পলিটিক্যাল রেটরিক, আর মরীচিকা নয়; বরং মানবজীবনের অর্থহীন দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অহেতুক ভূল বুঝাবুঝি, ব্যার্থতা এবং বেদনাদায়ক শুন্যতাগুলোকে নাটকীয়ভাবে তুলে ধরে আমাদের জীবনকে উন্নত, আনন্দময়, অর্থপূর্ন করে তুলা এবং পুর্নতা দান করার চেষ্টা করা । অধিকন্ত, কোন একটি পারিবারিক, সামাজিক ও মানবিক সমস্যা বা অন্ধকার দিককে বস্তুনিষ্ঠ ও নৈর্বিক্তিকভাবে (objectively) ফোকাস (focus) বা দৃষ্টিগোচর করা যাতে করে আমরা আনন্দের সাথে আমাদের স্বভাব, রুচি এবং বোধকে পবিত্র (purify), শোধন (rectify) এবং ক্ষেত্র-বিশেষে আরও রুচিশীল করার জন্য আগ্রহী হই । আর এগুলো করতে হলে এই সব ভাবগুলোর হক বা অধিকার আদায় করতে হবে। এগুলোর আবার হক আদায়ের ব্যাপারটা কেমন? যেমনঃ প্রেম-ভালবাসা একটি পবিত্র জিনিস বিধায় তাকে ব্যাভিচারের (adultery) মত পাপের (sin) সাথে মিলিয়ে না ফেলা; এতে প্রেম-ভালবাসার মত শক্তিশালী ভাবগুলো তাদের ওজন ও পবিত্রতা হারিয়ে ফেলে এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। দেশপ্রেম-চেতনা-আত্মত্যাগের মত মহান ভাবগুলোকে অল্প কিছু লোকের কাছে সস্তায় বিক্রি না করে সবার মধ্যেই ছড়িয়ে বা ভাগ করে দেওয়া – আর তা না হলে এইগুনগুলো তাদের শক্তি এবং কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলবে। সত্যের আবিষ্কার বা ভাবগুলোর পোয়েটিক জাস্টিস বলতে আমি এগুলোই বুঝিয়েছি।
বর্তমান বা অতীতের কোন কবি বা লেখক যেমন ১০০ বছর পরের চরিত্রের সম্পর্কের ধরণ সম্বন্ধে বলতে পারেন না তেমনিই নিজের দেশকে পেরিয়ে অনেক দূরের দেশকেও অতিক্রম করতে পারেননা। এর অনেকগুলো কারনের একটি হল একেক দেশের মূল্যবোধ একেক রকমের যা একজন কবি/লেখক উপেক্ষা করতে পারেন না। যেমনঃ এই মুহুর্তে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে আপোষে একজন বয়স্ক নারী এবং পুরুষ নিজেদের সম্মতিতে বিয়ে ছাড়াই দৈহিক মিলনে আবদ্ধ হতে পারে এবং এই বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক ছাড়াই সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। পাশ্চাত্যের সমাজে এটা পাপ বলে গন্য হতে পারে কিন্তু এটা কোন প্রকারেই অপরাধ নয়। আবার সমকামীতার উপর ভিত্তি করে এখানে অনেক সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে যা আমাদের সমাজে একই সাথে পাপ এবং অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। ফ্রিডম অফ একপ্রেশনের নামে ধর্মকে যতপ্রকার গালিগালাজ করাটাও পাশ্চাত্যের একটা সেকুল্যার ও প্রগতিবাদি ফ্যাশন কিন্তু আমাদের দেশে তা একটি গর্হিত কাজ। ফলে পাশ্চাত্যের সব লেখা যেমন আমাদের সমাজ এবং জীবনকে রিপ্রেজেন্ট বা প্রতিনিধিত্ব করে না ঠিক একইভাবে আমাদের সব লেখাও তাদের প্রতিনিধিত্ব করেনা।
বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকার কথাই যদি ধরি তাহলে বলতে হয় যে আমেরিকার আইন-প্রণেতা বা সংসদ নির্বাচনে একজন পর্নস্টার প্রার্থী হতে পারে এমনকি নির্বাচনে জিতে অধিক সংখ্যক সাংসদের সমর্থন থাকলে সে প্রেসিডেন্টও হতে পারে। এটা তাদের মত চরম ভোগ, পার্থিব এবং পুঁজিবাদী সমাজে ধর্মীয় দৃষ্টিতে খারাপ হলেও অন্যায় কিছু নয়; এক্ষেত্রে মেয়ে এবং ছেলেদের দেহ বা সেক্সুয়ালিটি বা যৌণতাকে তারা ব্যাবসায়িক পন্য মনে করে যা এই ব্যবসার ব্যবসায়ীদের পুজি বা ক্যাপিটাল বৃদ্ধি করে। যায় হোক, আফগানস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে এই মুহুর্তে সঠিক গনতন্ত্র এবং সুবিচার না থাকলেও একজন পর্নস্টারের নির্বাচনে দাঁড়ানো কি কল্পনা করা যায়? এমনকি আমাদের প্রতিবেশি ভারতেও এটা ভাবা যায় না। আমাদের লেখকদেরকে এই সমস্ত মূল্যবোধ এবং সামাজিক ঐতিহ্যকে সম্মান করেই ভালবাসার গান গাইতে হয়; জীবন কাহিনী রচনা করতে হয়। ফলে এটা জরুরী নয় যে একজন লেখক বা কবিকে সার্বজনীন হবার জন্য তার দেশ, সংস্কৃতি, মুল্যবোধ এবং ধর্মকে বিকিয়ে দিয়ে অন্যদের খারাপটা গ্রহন করতে হবে। পৃথিবীর কোন বড় লেখক বা কবিকেই আমরা তা করতে দেখি না। তাহলে এটা কি যা একজন লেখক বা কবিকে বিশ্বজনীন করে তুলে?
কাগজ দিয়ে ফুল তৈরি করা যায় এবং শৈল্পিক কারু-কার্যে তৈরি কাগজের ফুলের মেকি সৌন্দয্যকে সব সময় অস্বীকার করা যায় না। কিন্ত তাই বলে সবুজ, সতেজ, রঙ্গিন, গন্ধময়, অতুলনীয় শৈল্পিক জীবন্ত ফুল আর কাগজের ফুল কখনই এক নয়। বস্তুতঃ মিথ্যা ঘটনা, চরিত্র এবং চিত্রকল্প দিয়ে আমরা যে জীবন সাজাই তাতে থাকতে হয় আসল জীবনের প্রতিচ্ছবি। আর যদি তা বাস্তব জীবনের মত বা তার কাছাকাছি না হয় তাহলে সেই সাহিত্যকর্ম আমাদেরকে খুব বেশী আনন্দ দিলেও তা হয় অর্থহীন কারন এ ধরণের কর্মে জীবনের সাথে কোন মিল খুজে পাওয়া না। ফলে আমরা তা যতই পড়ি তা আমাদের কাছে হয়ে উঠে বিদেশী, অপরিচিত এবং অগ্রহণযোগ্য ।
প্রশ্ন আসতে পারে বড় বড় লেখকদেরকে মৃত ঘোষণা করে শুধুমাত্র পাঠকরা একটি টেক্সট বুঝতে পারে কি না। এ প্রশ্নের জবাব আমাদের অনেক সমসাময়িক একাডেমিক এবং সাহিত্যিক দর্শনের জটিল কিছু গিঁট খুলতে সাহায্য করতে পারে ।
যে কোন একটি লেখা বা টেক্সটের লেখককে কি কখনই একেবারে টেক্সট থেকে বাদ দেওয়া বা মেরে ফেলা (the death of the author) যায় ? টেক্সটকে বুঝার জন্য কী আদৌ তাঁদের প্রয়োজন হয়? অনেক সময় একটি টেক্সটকে জানা এবং তা মূল্যায়নের জন্য অথার বা লেখককে বুঝাটাই সবচেয়ে জরুরী আর এই কঠিন কাজটি না পারলে ঐ টেক্সটই বুঝা যাবে না। বর্তমানের কোন লেখক যদি অতীতের কোন বিষয় লিখতে চান তবে অবশ্যই সেই অতীতে তাঁকে একাকার হতে হবে; তখনকার সমাজ যেভাবে চিন্তা করত তাঁকেও সেভাবেই চিন্তা করতে হবে এবং সেই সময়কার পোশাকআশাক, কৃষ্টি-কালচার, সমাজ ব্যবস্থা বা কাঠামোকে উপজীব্য করেই সাহিত্যকর্ম রচনা করতে হবে। আমরা এটাও জানি যে অতীতের কোন এক বিষয়ের উপর ১০০জন লেখক লিখলেও কিছু অভিন্নতা ছাড়া তা এক রকম না হয়ে ১০০ রকম ভিন্ন হবে। কোন লেখক ঐ সমাজকে কতটুকু বুঝেছেন, তার সাথে কতটুকু মিশে গিয়ে সেই সমাজের একজন সচেতন বাসিন্দা হয়ে কতটুকু উপস্থাপন করতে পেরেছেন – সেটার উপরেই নির্ভর করছে একজন লেখকের সাফল্য। তাহলে একজন লেখককে বাদ দিয়ে কিভাবে একটি টেক্সট সম্পুর্নভাবে বুঝা সম্ভব?
যে কোন দু একটি চরিত্রের কথাই ধরা যাক। যেমনঃ আমরা জানি যে ম্যাকবেথ (Macbeth) এবং ওথেলো (Othello) চরিত্র দুটি ঐতিহাসিক। শেক্সপিয়ার যখন ম্যাকবেথ অথবা ওথেলো লিখেন তখনতো তাকে ম্যাকবেথ এবং ওথেলোর মতই চিন্তা করতে হয়েছে; তাঁদের কাজের ভিতর, কথার ভিতর এবং হৃদয়ের ভিতর প্রবেশ করতে হয়েছে এবং অনেক ঘটনার মধ্য থেকে বিশ্বাসযোগ্য, আকর্ষনীয় এবং উত্তেজনাকর ঘটনাগুলো বের করে সেগুলোকে সফলতার সাথে সংযোগ করতে হয়েছে; আসলে সে নিজেই হ্যামলেট এবং ওথেলো হয়েছে। এখন ঘটনাগুলো সে যেভাবে ভেবেছে, সংযোগ করেছে এবং আমাদের সামনে এনেছে আমরা সেইভাবে বুঝেছি। অন্যভাবে বললে এটা অনেকটাই ভ্রমনের মতঃ সে তার সময় থেকে ৪০০/৫০০ বছর আগের একটি সময়, রাজ্য, রাজকুমার এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ দেখেছে এবং তা আমাদের সামনে নাটকীয়তার সাথে তুলে ধরেছে। তাহলে এই টেক্সট দুটোকে বুঝতে গেলে শেক্সপিয়ারকে না বুঝে সেটা কি করে সম্ভব। শুধু তাই নয় অন্যন্য চরিত্রের ক্ষেত্রেও তাঁকে পুরোপুরি ঐ চরিত্রেই রূপান্তরিত হতে হয়েছে; তারা যেভাবে ভেবেছে, কথা বলেছে, কার্যকলাপ এবং প্রেম-যুদ্ধ-বিগ্রহ করেছে তাঁকে ঠিক সেভাবেই সবকিছু চিন্তা করতে হয়েছে। তাহলে শেক্সপিয়ারকে অবমুক্ত করে ম্যাকবেথ এবং ওথেলো বুঝা কি করে সম্ভব? বস্তুতঃ যে কবি/লেখক যতটা মুল চরিত্রে রুপান্তর হয়ে একাকার হতে পারে তার লেখা/কবিতা তত প্রাণবন্ত, জীবন্ত এবং সফলকাম হবে।
হ্যাঁ শেক্সপিয়ারের মত অনেক লেখককে আমরা দেখব যে তাঁরা নিজেদেরকে কিঞ্চিত পরিমাণও তাদের অনেক লেখা বা কবিতার সাথে যুক্ত বা ইনভল্ভ করেন নাই। সেই ক্ষেত্রে কি এটা বলা যায় না যে একটি টেক্সট বুঝার জন্য লেখকের কোন প্রয়োজন নেই? মেনে নিলাম যে লেখক বা কবি ১০০% অবজেক্টিভ এবং তাঁর নাটক বা কবিতা বা লেখা ১০০% ক্লাসিক। কিন্তু আপনি একবার ভাবুন যে শেক্সপিয়ার বা নিটশে বাংলাদেশে জন্ম গ্রহন করেছেন। এখন এই জিনিয়াসরা যদি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করতেন তাহলে কি ঠিক এই রকম সাহিত্যিক বা দার্শনিক কর্ম রচনা করতে পারতেন যেটা তারা ব্রিটেন বা জার্মানীতে জন্মগ্রহণ করে করেছেন? আবার একইভাবে যদি আমরা রবীন্দ্র এবং নজরুলের কথা ধরি যে তাঁরা ইউরোপের কোন একটি দেশে জন্ম নিয়েছেন তাহলে কি এই জিনিয়াসরা ঠিক এই লেখাগুলো লিখতেন যা তাঁরা লিখেছেন? মুলতঃ শেক্সপিয়ার বা মিল্টন তাঁদের লেখায় তাঁরা নিজেদেরকে যুক্ত করেন নাই ঠিক কিন্তু তাঁদের ক্লাসিক এবং মুল্যবান সাহিত্যিক বা দার্শনিক কর্মগুলো অবশ্যই তাঁদের সমাজ, সমাজের রীতিনীতি, সমসাময়িক সমস্যা, চিন্তা, দর্শন, বিশ্বাস এবং ধারণা দ্বারা রুপায়িত, রঙ্গিত এবং প্রভাবিত ।
আবার একইভাবে রবীন্দ্র এবং নজরুলের লেখাগুলোও যতই অবজেক্টিভ এবং ক্লাসিক হোক না কেন এগুলো তাঁদের সমসাময়িক, পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা, রীতিনীতি, ধর্ম বিশ্বাস, ধারণা, মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত, বিন্যস্ত এবং গঠিত; এগুলোকে এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। তাহলে একটা শিল্পকে আমরা যতই নৈর্ব্যক্তিক, বস্তনিষ্ঠ এবং লেখক বা কবিমুক্ত বলি না কেন আসলে তা ১০০% লেখক বা কবিমুক্ত নয়। লেখক বা কবি যেহেতু তাঁর কবিতা, গল্প বা শিল্পের জন্য তাঁর বসবাসকারী নিজস্ব পরিবার, সমাজ, সমাজের চিরাচরিত প্রথা বা রীতি, সমসাময়িক পারিবারিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং ধারনাকে অবলম্বন বা পুজি করেই তা করেন সেহেতু তাঁকে বা তাঁর সমসাময়িক চিন্তা, দর্শন, বিশ্বাস এবং রীতিনীতিকে বাদ দিয়ে কোন টেক্সটের বিচার করা একধরনের অবিচার এবং অন্যায়। এখন কোন লেখক বা কবি ওল্ড, মডার্ন আর পোস্ট-মডার্ন (old, modern or postmodern) হোক সমাজের বাইরে বসবাস করে তো আর কেই লেখেন না।
প্রশ্ন আসতে পারে কে বড়ঃ সৃষ্টিকর্তা নাকি সৃষ্টকর্ম। এটা সত্য যে আমরা অনেক কবি, লেখক, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীর কর্ম জানি কিন্তু তাদের নাম জানি না। অনেক ক্ষেত্রে লেখকের কর্ম তাঁর নামকে ছড়িয়ে যায় এবং এখানে নাম গৌণ হয়ে পড়ে। এবং এটাও বলা হয় যে, যে কোন কর্ম বুঝতে হলে লেখকের নাম ভুলে যেতে হবে। কোন একটি টেক্সট বুঝতে হলে তাকে লেখক নয় বরং টেক্সট দিয়েই বুঝতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল কালিদাস, গালিব, ইকবাল, রবিন্দ্রনাথ, নজরুল, মুধুসুদুন, আল মাহমুদ কিংবা শেক্সপিয়ার, মিল্টনের কাজ সম্পর্কে জানতে হলে তাঁদেরকে জানা দরকার কি না? তাঁদেরকে বাদ দিয়ে তাঁদের কর্মের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, এবং মাহাত্ম্য বুঝা সম্ভব কিনা।
আচ্ছা ধরুন, নবার সিরাজদ্দৌলার উপর লিখিত নাটক বা টেক্সট থেকে আমরা লেখককে মৃত ঘোষণা করলাম। আমরা জানি প্রত্যেকটা ট্র্যাজেডিতেই মূল চরিত্র বা ট্র্যাজিক হিরোর একটা ভুল (খুব ছোটও নয় আবার খুব বড়ও নয়) বা ট্র্যাজিক ফ্ল (tragic flaw) থাকে যা তাঁর পতনের (downfall) বা দুঃখজনক মৃত্যুর মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সে যায় হোক, প্রত্যেক ট্র্যাজেডিতেই ট্র্যাজিক হিরো তাঁর আপন কিছু মানবীয় গুণাবলীতে হয় গুণান্বিত এবং উচ্চতায় থাকে উচ্চকিত ও উদ্ভাসিত। কিন্তু সমস্যা হল যখন নবাব সিরাজদ্দৌলার মত একটি জানা এবং ঐতিহাসিক চরিত্রকে ট্র্যাজিক ফ্লর মাধ্যমে পতন না দেখিয়ে তাঁকে ইতিহাসের একজন খলনায়ক (villain) বা ক্ষমতালোভী চরিত্রহীন শাসক হিসাবে দেখানো হয় ; ফলে স্বার্থক ট্র্যাজেডির পরিবর্তে তা হয়ে উঠে চরিত্র হননের হাতিয়ার বা লেখনি। এখন যদি নাট্যকার বা লেখককে ডিকোড না করে তাঁকে ডেড বা মৃত বলি তবে এই টেক্সটের মুল্যায়ন করব কি করে? ধরেই নিলাম যে আমরা কর্মের বিচার করব লেখককের নয়। ভাল কথা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এই মিথ্যা বা অসত্যের ভার কে বহন করবে? বিচারের কাঠগড়াই কি আমরা প্রাণহীন, বধির কাগজের বই আর কলমের কালিকে দাড় করাব নাকি যিনি এই কর্ম সৃষ্টি করেছেন তাঁকে? আমরা যে পোয়েটিক জাস্টিস এর কথা বলছি তা কি এখানে ভূল্ভাবে উপস্থাপন হচ্ছে না? এবং এর ফলে যা হচ্ছে তা কি রীতিমত পোয়েটিক অপরেশন বা জুলুম নয়? এই দায় কে নেবে? তাহলে এটা বলা কি ভুল হবে যে লেখকের মৃত্যু মানে হল একটি টেক্সটের মধ্যে যে পোয়েটিক জাস্টিস আছে তার বিদায় বা অসুম্পুর্ন মূল্যায়ন?
আবেগ অনুভুতি তো আর অংক বা বিজ্ঞানের সুত্রের মত নয় যে সূত্রের আবিষ্কারক ছাড়াই যোগ, বিয়োগ এবং বীজগণিত বা এলজেব্রার সুত্রে একটা বিধিবদ্ধ প্যাটার্নে কাজ করবে। ম্যাথম্যাটিকাল ট্রুথ হল ফিক্সড বা স্থায়ী। ঐতিহাসিক ট্রুথ ও অনেকটা তাই যা মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে গেছে। একজন বিজ্ঞানী বা ম্যাথম্যাটিশিয়ান কোন একটা সুত্র এবং একজন ইতিহাসবিদ কোন একটি ঐতিহাসিক সত্য আবিষ্কার করলে যুগ যগ ধরে অন্যরা সেটাই অনুকরণ এবং অনুসরণ করে। কিন্তু সাহিত্যিক বা পোয়েটিক ট্রুথ সম্পুর্নটাই ভিন্ন এক বিষয়। একই সমাজে, একই ঘরে এমনকি একই জীবন-সুত্রে আবদ্ধ হয়ে ও দুজন কবি বা লেখক দুধরনের পোয়েটিক ট্রুথ বের করবে। কারণ দুজনের মা, বাবা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, বর্ন, রক্ত একরকম হলেও তাঁদের চিন্তার যন্ত্র ভিন্ন। পৃথিবীতে কক্ষনই এক মা আরেক মায়ের সন্তান সন্ততির বিকল্প হতে পারে না। পৃথিবীতে যদিও প্রত্যেকেটা মায়ের ভালবাসার রং-রূপ-শব্দ-স্পর্শ-গন্ধই শ্রেষ্ঠ কিন্তু তবুও প্রত্যেকের ভালবাসার প্রকৃতি আলাদা কারণ প্রতিটা মায়ের ভালবাসা এবং আবেগের যে উৎসস্থল – তাঁদের মন, হৃদয় বা আত্মা তা আলাদা , স্বতন্ত্র এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ন।
এখন আপনারা বলুন যিনি এই প্রেম, ভালবাসা, আবেগ, অনুভুতি, চেতনা, দয়া, মায়া ধারণ করেন – তাঁকে বাদ দিয়ে এই প্রেম, ভালবাসা, আবেগ, অনুভুতির সঠিক রঙ দেখা কি সম্ভব? তাঁকে বাদ দিয়ে তাঁর কান্নার এবং শব্দের যথাযথ অর্থ, ভালবাসার তীব্রতা (intensity), তীক্ষ্ণতা (sharpness) এবং তাঁর গতি-প্রকৃতি বুঝা সম্ভব কিনা? যে হৃদয়, আত্মা বা মনের মধ্যে ভালবাসা প্রতিনিয়ত রঙ বদলায়, নয়া আকৃতি ধারণ করে, নিত্য তীব্রতা বদলায়, ক্ষণে ক্ষণে নতুন বাঁক নেয় – সেই হৃদয়কে বাদ দিয়ে বা মেরে ফেলে একজন শ্রোতা বা পাঠক ভালবাসার মূল্যায়ন করবেন কি করে? ঐতিহাসিক, সায়েন্টিফিক বা ম্যাথমেটিকাল ট্রুথ বুঝার জন্য লেখকের প্রয়োজন হয় না কিন্তু লিটারেরি বা পোয়েটিক ট্রুথ বুঝা এবং মূল্যায়নের জন্য এই কারনে অথার বা লেখককে মৃত ঘোষণা করে তাকে তাঁর লেখা থেকে বের করে দেওয়া যায় কি?
যে কোন শিল্প তা কবিতা, উপন্যাস, দার্শনিক মাস্টারপিস অথবা স্থাপত্য-কর্ম – যাই হোক না কেন তা তৈরির আগে থাকে অদৃশ্য, মৃত, অনাবিস্কৃত এবং নির্জীব; মূলত এসবের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করেন একজন শিল্পি । অর্থ্যাৎ আমরা যেমনটা আগেই বলেছি যে একজন শিল্পী তাঁর কল্পনা বা ভাবকে ভাষা, সুর, ছন্দ এবং গতি দিয়ে নাটকে রুপান্তর করে বা জীবন দেয়। একজন শিল্পী এসব ভাব, চিন্তা, ধারণা, এবং তত্ত্বকে তাঁর বুকের, মনের এবং হৃদয়ের গহীন জগৎ থেকে তুলে এনে পুতুলের মত করে সাজায় এবং এ ক্ষেত্রে সে ব্যবহার করে নিজের স্বতঃলব্ধ জ্ঞান (intuitive), প্রতিভা (talent), বুদ্ধিমত্তা ও প্রকাশভঙ্গি যা তাঁকে অনন্য করে। এটা তো একান্তই তাঁর নিজের কর্ম, নিজের সৃষ্টি, নিজের দর্শন এবং অভিব্যাক্তি । একজন পাঠক বড় জোর যা করতে পারে তা হলে এই টেক্সটের সমালোচনা। যার এই টেক্সটে নুন্যতম অবদান বা অংশগ্রহণ নেই কেবলমাত্র সে-ই এই টেক্সটের অর্থ বের করে কি করে আর একমাত্র ব্যাখ্যাদাতাই বা সে হয় কি করে?
এটা করলে যে কোন শিল্পের একতরফা এবং অন্যায় মুল্যায়ন হয় এবং সবচেয়ে ভয়ংকর যে ক্ষতি হয় তা হল শিল্পকে একটি বিশেষায়িত বস্তু বা পন্যের পর্যায়ে নিয়ে আসা। যেমন বাজারে কোন একটি নকশীকাঁথা বিক্রির ক্ষেত্রে এর গুণগত মানটাই বিবেচ্য কিন্তু এটা কে বানিয়েছে বা এর সাথে কতটুকু দুঃখ-বেদনা-বঞ্চনা-চোখের পানি-ক্ষুধা-সাংসারিক কষ্ট মিশে আছে তাঁর কোন মুল্য নেই। এটার মানে হল আর্টের জন্য আর্ট বা শিল্পের জন্য শিল্প যেখানে সৃষ্টিকর্তা বা এক-গডের প্রতিনিধি হিসাবে একজন কবি, লেখক বা দার্শনিকের আবেগ, অনুভুতি, বুদ্ধিমত্তা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসকে অবজ্ঞা বা অস্বীকার করা হয় এবং এভাবে কখনই একটা টেক্সট বা কর্মের যথাযথ মুল্যায়ন হয় কি না তা আপনারাই বিচার করবেন।
কিছু কিছু সাহিত্যকর্ম বা শিল্পের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমরা কেবলমাত্র লেখকের উপরই নির্ভর করতে পারি যেমন আত্মজীবনীমূলক কর্ম। উদাহরনঃ ডিকেন্সের কর্ম বুঝতে হলে তাঁর জীবনী না জেনে তা বুঝা কষ্টকর এবং অসম্পুর্ন। আবার মধুসুদুন দত্তের ‘কপোতাক্ষ নদ’ সনেটটি বুঝতে এবং উপভোগ করতে হলে কবির ব্যাক্তি জীবনের কষ্টের কথা জানতে হবে। তবে হ্যাঁ সবক্ষেত্রেই এই কৃত্রিম সৃষ্টি কর্তা বা শিল্পীই তাঁর কাজের মুল্যায়নের একমাত্র একক বা মানদন্ড নয় । একজন বিখ্যাত লেখকের সব লেখাই সমান গুরুত্বপুর্ন নয়। তার মানে কোন লেখা বা শিল্প কত ভাল তা নির্ভর করবে তাঁর কাজের মানের উপর। কিন্তু তাই বলে লেখক বা শিল্পীকে তুলি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম যে একজন বিধবা মা তাঁর উপর চাপিয়ে দেওয়া নির্মম যুদ্ধ এবং অবর্ননীয় অভাব অনটনের মধ্যে থেকে অসহনীয় কষ্টে প্রেম, ভালবাসা দিয়ে সন্তান-সন্ততিদের বড় করে তুলেছেন কিন্তু দিন শেষে সন্তান-সন্ততিদের বীরত্বই আমাদের কাছে মহান হয়েছে আর বিধবা মায়ের অবদানগুলো পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে।
যত নিম্ন মানের লেখাই হোক না কেন, একজন লেখক বা কবি তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে পাঠক-শ্রোতাকে একটা শিক্ষা বা বার্তা (message) পাঠাতে চান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চরিত্র,ঘটনা এবং লেখক তাঁর নিজস্ব সাহিত্যিক ধারা বা জানরার (genre) মাধ্যমে এই বার্তা পরোক্ষভাবে (passively or indirectly) আমাদেরকে পাঠান। আমরা যখন কবি বা লেখকের মৃত্যুর (the death of an author) কথা বলি, তখন তাঁর মেসেজ বা বার্তার মৃত্যুর কথা বলি অথবা তাঁর বার্তাকে আমলে না নিয়ে আমাদের মত করে কোন টেক্সটকে ব্যাখার কথা বলি। এখন একজন পাঠক বা শ্রোতা যদি মৃত বা জীবিত কবি ও লেখকের এই বার্তার সাথে একমত না হয়ে অন্য কোন বার্তা আবিষ্কার করেন তাহলে একই টেক্সটের দুইটি বার্তা তৈরি হয়; এভাবে একাধিক পাঠক তৈরি করবেন একাধিক বার্তা বা মেসেজ । অবশ্যই দেশ-কাল-পাত্র-বিশ্বাস ভেদে সকল পাঠকের মূল্যায়ন পদ্ধতি, মতামত, যোগ্যতা, আগ্রহ এবং বিচার বুদ্ধি সমান হবে না । এর ফলে হবে অসংখ্য মতামত যেগুলো হবে একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক এবং বিপরীত আবার সেই সাথে অনেকের সাথে সাথে অনেকর মিলও থাকতে পারে। এটা কি গভীর সমুদ্রে মাঝিহীণ নৌকার মত নয়?
যে কোন একটি বাস্তব অথবা কল্পিত আকৃতির মধ্যে এদিক সেদিকে অনেক বিন্দু ছড়িয়ে থাকে এবং তা সুসম বা অসম যে গঠনেরই হোক না কেন তাঁর অবশ্যই একটা কেন্দ্র (centre) থাকে। প্রত্যক গল্প, কবিতা, সমালোচনা, মহাকাব্য, জীবনিগ্রন্থ – যে কোন ধরনের লেখার মধ্যেই একটি কেন্দ্রীয় বার্তা (central message or key theme) থাকে যা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক, বিতর্ক হতে পারে কিন্তু কেন্দ্রবিন্দু বাদ দিয়ে যেমন আকৃতির কল্পনা করা কঠিন ঠিক একইভাবে কবি এবং লেখকের মৃত্যু ঘটিয়ে তাঁর মূল বার্তাকে বাদ দিয়ে একটি টেক্সটের মূল্যায়ন হবে অর্থহীন, অপ্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবতা বিবর্জিত।
ফলে, সত্যিকার অর্থে একটি টেক্সটের যদি একাধিক অর্থ থেকেও থাকে, তবুও এ ব্যাপারে যুগ, স্থান, কাল এবং পাত্রভেদে হাজার রকমের মতামত আসবে এবং একজন আরেকজনের অর্থ বা বার্তা মানতে বাধ্য হবেন না। সহজ করে বললে, লেখককে মেরে ফেলে (by the death of an author) পাঠককে যদি আমরা টেক্সটের অর্থ বের করার দায়িত্ব দিই তবে দেশ-কাল-পাত্র-বিশ্বাসভেদে হাজার রকমের পাঠক, কোন নির্দিস্ট অর্থের পরিবর্তে, তৈরি করবে হাজার হাজার অর্থ; আর এতে টেক্সটের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সত্যের মৃত্যু হয়ে পাঠকদের তৈরি করা হাজার সত্যের হবে হাজার রকমের ব্যাখ্যা। কারণ প্রত্যেক পাঠকই চাইবেন তাঁর মতামত বা ব্যাখ্যাকে যুক্তি এবং প্রমান দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে। লেখককে মেরে ফেলা মানে হল তাঁর আবিস্কৃত সত্যকে মেরে ফেলা, আর এই সত্যকে মেরে ফেলে পাঠকরা যে হাজার রকমের ব্যাখ্যা দিবেন তা কিসের ব্যাখ্যা এবং কতুটুক গ্রহণযোগ্য তাঁর ভার আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
দেখুন, লেখকের মৃত্যুর কারনে যেহেতু এর কোন স্থায়ী, টেকসই, নির্দিস্ট অর্থ, বার্তা বা শিক্ষা থাকবে না, ফলে এই টেক্সটটি হবে অন্ধকারের হাতির মত যেখানে কেউ হাতির শুঁড়কে মনে করবে পানির নল, পাকে মনে করবে খুটি আর লেজকে মনে করবে সাপ। এর ফলে যে ক্ষতিটা হবে তা হল, লেখক বা কবি মানবজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় যে অজানা সত্যটা আবিস্কার করেছিল তা পাঠক-শ্রোতার কাছে অজানাই থেকে যাবে এবং লেখকের মৃত্যুর ফলে যে বার্তাটা আবিষ্কার হবে তাঁর কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না কারণ তা সত্যও হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে, উভয়ের মিশ্রণও হতে পারে আবার টেক্সটের সাথে সম্পর্কহীণ কোন কিছুও হতে পারে।
সুতরাং কবি ও লেখকের মৃত্যু মানে তাঁর বার্তাকে মেরে ফেলা, টেক্সটের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সত্যকে গলা টিপে খুন করা। এর ফলে একটা টেক্সট থেকে হয়ত আনন্দ পাওয়া যেতে পারে কিন্তু সত্য বা বার্তা উদ্ধারে তা পাঠককে বিভ্রান্ত করবে এবং গোটা ব্যাপারটাকেই এক সাহিত্যিক অরাজকতার দিকে ঠেলে দেবে।
সাহিত্যিক কর্মগুলো ছাড়াও যে কোন ধরনের লেখাই একজন লেখকের আদরের ধন, ভালবাসার রত্ন, পরিশ্রমের ফসল, হৃদয়ের প্রতিধ্বনি, চিন্তার ফসল এবং অনেক দিনের জমিয়ে রাখা দুঃখ-কষ্ট-সুখ-শান্তি, অভিজ্ঞতা ও না বলা ব্যাথার বহিঃপ্রকাশ যার মাধ্যমে একটি সত্য বেরিয়ে আসে। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত অমর্ত্যসেনের কথাই ধরা যাক । তিনি একজন অর্থনিতিবিদ কিন্তু তাঁর লেখনির (Poverty and Famines: An Essay on Entitlement and Deprivation 1981) মাধ্যমে তিনি যা দেখিয়েছেন (১৯৪৩ সালে বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল) তা হল সম্পদের অভাবে কোন দুর্ভিক্ষ হয় না, দুর্ভিক্ষ হয় সম্পদের সুষম বন্টনের অভাবে। প্রত্যেকটা সুন্দর লেখাই হল এক একটা সত্যের আবিষ্কার — তা অর্থনিতি হোক আর বিজ্ঞান হোক। এই ধরনের লেখার বিচার বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের অনেক তথ্য, প্রমান এবং যুক্তির প্রয়োজোন হয়। কিন্তু কবি লেখকরা সত্য প্রকাশে অন্যদের মত ড্যাটা বা তথ্য ব্যবহার করেন না। তাঁরা ব্যবহার করেনঃ মন, হৃদয়, আত্মা।
একজন পাঠক যখন একটি টেক্সটের বিচার করবেন তখন তাঁর বিচারের মাপকাঠিগুলো কি হবে? পাঠক তো আর মন, হৃদয় বা আত্মা দিয়ে টেক্সটের বিচার করবেন না, তাঁরা বিচার করবেন যুক্তি (logic), বুদ্ধি (reason) এবং জ্ঞান (experiment or experience) দিয়ে। মাথা (rationality) দিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলঃ আমাদের মনের গহীন জগত, অন্তরের অন্তস্থল বা হৃদয়ের প্রেমের ঝর্না থেকে যে আবেগ, ভালবাসা এবং ভাবগুলো বেরিয়ে আসে সেগুলো কি বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে মাপা যায়? হাজার শাররিক এবং মানসিক নির্যাতনে বিধ্বস্ত হৃদয় এবং অতৃপ্ত আত্মার অবিরাম কান্না কি যুক্তি এবং বুদ্ধি দিয়ে একজন পাঠকের পক্ষে ওজন করা সম্ভব? পাঠক যদি কোন একটি টেক্সট তাঁর হৃদয় বা মন দিয়ে বুঝতে চায় তাহলে তো লেখককে বাদ দিয়ে সেটা সম্ভব নয় কারণ লেখাটাতো লেখকেরই হৃদয় থেকে আসা।
মাথার কথা মাথা দিয়ে বুঝতে হয়, যুক্তির কথা যুক্তি দিয়ে বুঝতে হয় আর মনের কথা বুঝতে হয় মন দিয়ে; হৃদয়ের কথা হৃদয় দিয়ে।
একজন লেখকের শেষ গন্তব্যস্থল কোথায়?
অদৃশ্য অনুভুতি – ‘রাগ এবং লোভকে’ যেমন এক করে ফেলার কোন কারণ নেই তেমনিই ‘ভালবাসা এবং দয়াকে’ও এক করে ফেলার কোন যুক্তি নেই। ভিন্ন ভিন্ন এই সমস্ত মানবিক গুণ এবং অনুভুতি আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ যা কিনতে হয়না, পড়াশুনা করে ডিগ্রীর মাধ্যমে অর্জন করতে হয় না অথবা ধার করতে হয়না ; জন্মকালীন সময়েই এগুলো আমাদের মন এবং আত্মার মধ্যে আগে থেকেই সুপ্ত অবস্থায় দেওয়া থাকে; বয়স হওয়ার সাথে সাথে যা আমরা আমাদের আম্মা-আব্বা, পরিবার, প্রতিবেশি এবং বৃহত্তর সমাজের লোকজনকে দেখে চাষাবাদ, কর্ষন ও অভ্যাস করি ।
হ্যাঁ, আমাদের মানবিক সুবৃত্তি বা অনুভুতিগুলো একটি থেকে আরেকটি আলাদা এবং এদের সহজেই পৃথক করা যায়; যেমন দয়া, মায়া, ভালবাসা, স্নেহ – এসবেরই আছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। আমাদের আম্মারা হলেন ভালবাসার প্রতিক, বাবারা হলেন ত্যাগের প্রতিক, বড় বোন এবং ভাইয়েরা সম্মানের আর ছোটরা হলেন স্নেহের প্রতিক যদিও সবাই ধারণ ক্ষমতানুযায়ী সবকিছুরই প্রতিক হতে পারে; আবার একজনের মধ্যেও এ সবগুনগুলোও থাকতে পারে। একবার ভাবেন আমাদের অন্তর, হৃদয়ে বা আত্মার মধ্যে আছে দয়ার জন্য এক ঘর, ভালবাসার জন্য এক ঘর, স্নেহের জন্য এক ঘর আর মায়ার জন্য আর এক ঘর। ঠিক একইভাবে মানুষের হৃদয় বা মনের মধ্যে লোভ, ক্রোধ, হিংসা, অহংকার — এসবের জন্য আছে এক একটা করে প্রকোষ্ঠ, ইউনিট বা ঘর । তাহলে আমাদের মন বা হৃদয়ের মধ্যে কতগুলো ঘর আছে?
দয়া, মায়া, মমতা, ভালবাসা – এসব অনুভূতি, ধারণা বা অনুভবগুলো শুধু সন্দরই নয় এগুলো শক্তিশালী, মহামূল্যবান এবং আত্মার সাথে সম্পর্কিত। এগুলো যিনি তৈরি করেছেন তিনি নিশ্চয়ই এসব গুনে গুণান্বিত, শ্রেষ্ঠ দয়াশীল, মহাশক্তিধর, অলৌকিক এবং একক পরমাত্মা। এটা কেন বলছি? বলছি এই জন্য যে এই প্রেম, ভালবাসা, আদর, স্নেহ, সহানুভুতির মত ভারী, প্রভাবশালী এবং স্বর্গীয় ভাবগুলো নিশ্চয় এমনি এমনি বাতাস বা শুন্য থেকে তৈরি হয়নি। কেউ একজন এগুলো তৈরি করেছেন যিনি নিশ্চয়ই এগুলোকে ধরতে পারেন, ছুতে পারেন এবং আকৃতি দিতে পারেন যদিও তা আমাদের বুঝে কঠিন এবং অস্বাভাবিক। তিনিই হলেন মূল আর্টিস্ট; আমরা শুধু তাঁর আবিস্কৃত এসব ভাবগুলোকে অনুসরণ এবং অনুকরন করছি মাত্র। ভাবগুলোকে যেমন চেহারা দিতে পারেন তিনি আবার এ চেহারাগুলোকে অবিকৃতভাবে ভাব, ভাষা এবং সুরে আমাদের হৃদয়ে বাঙময় করে ধারণ করাতে পারেন তিনি । ভাবগুলোর মতই তিনি অদৃশ্যমান ভাবের এক সীমাহীন মহাসমুদ্র। এ ভাবগুলো নিয়ে কাজ করা মানেই হলো এই অদৃশ্য মহান শিল্পীর মহান কাজ করা । সুতরাং কবি ও লেখক যেন তেন কোন ব্যাক্তি নন, তিনি সত্যের গায়ক, সুন্দরের চিত্রক এবং তাঁর কাজকে ছোট করে দেখার কিছু নেই।
এখন বলেন তো ‘দয়া’ বেশি শক্তিশালী নাকি ‘নিষ্ঠুরতা’ বেশি শক্তিশালী? ‘ভালোবাসার’ ওজন বেশি নাকি ‘ঘৃণার’ ওজন বেশি? দেখুন, ‘দয়া’ এতটাই ক্ষমতাশালী একটি গুণ যা চরম কঠিন হৃদয়ের মানুষকেও নরম করে ফেলে; কিন্তু ‘নিষ্ঠুরতা’ ‘দয়াকে’ কখনই নষ্ট করতে পারে না, বরং এটা একজন নিষ্ঠুর মানুষের হৃদয়কে আরও নিষ্ঠুর করে তুলে। ‘ভালবাসা’ নামক বিষয়টার ব্যাপারটাও তাই। এটার প্রভাব এত বেশি যে, ‘ভালবাসার’ কারনে কঠিন পাথর (হৃদয়ের) থেকেও পানির ঝর্না বয় কিন্তু ‘ঘৃণা’ এতটাই দুর্বল যে সে পাথরকে গলানো তো দূরের কথা বরং তাকে আরও দুর্বল এবং দুর্গন্ধময় করে ফেলে।
এই যে ‘দয়া’, ‘ভালবাসা’, ‘স্নেহ’, ‘মায়া’ আর ‘সহমর্মিতা’ – এসব সোনালী, মহামূল্যবান, ভারী, পবিত্র এবং আধ্যাত্মিক ভাবগুলো থাকে কোথায়? এসব নিশ্চয়ই আমাদের হাতে বা পায়ে থাকে না; তাহলে হাত এবং পা কেটে গেলেই তো সব শেষ হয়ে যাবে তাই না? কিন্তু হাত-পা কাটা মানুষগুলোকে বরং আমরা আরও বেশি দয়াশীল ও দয়ানির্ভর হতে দেখি। যে জিনিস যত মুল্যবান তা রাখার ব্যাপারেও হতে হয় ততটাই সতর্ক । যেমন হীরা, মানিক,স্বর্ন আর মনিমুক্তাগুলোকে যা ধারন করে সেটাকে হতে হয় খুবই সুরক্ষিত। এখন এইসব হীরা আর মনিমুক্তাসম মানবীয় গুনগুলো অবস্থান করে আমাদের আত্মা, মন বা হৃদয় নামক ঘরে। এই পবিত্রগুণগুলোর অবস্থান হয় আমাদের এই মাটির দেহের আত্মা নামক পবিত্র স্থানে। প্রশ্ন হতে পারে তাহলে বিদ্বেষ বা লোভের মত খারাপ গুণগুলো এর মধ্যে থাকে কি করে? সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ এই মানুষের মন বা হৃদয় ঘৃণা, বিদ্বেষ, লোভ, অপরাধ বা শত্রুতা নিয়ে জন্মায় না বরং নিস্পাপ হয়ে ভালবাসা, দয়া এবং মায়া নিয়েই জন্মায়। কিন্তু জন্মের পর খারাপের দ্বারা আমরা এতটাই প্রভাবিত হয় যে আমাদের এই দয়া, মায়া এবং ভালবাসা দুষিত হয়ে যায় এবং ভালবাসা এবং প্রেমকে আমরা শত্রুতা ও ঘৃণাতে রূপান্তরিত করে ফেলি।
আচ্ছা, তাহলে আমাদের দয়া, দান এবং ভালবাসা কিভাবে দুষিত হয়? এগুলো আমাদের জন্মলগ্নে থাকে পুত পবিত্র অবস্থায় কিন্ত কালে এসব হয়ে যায় কলুষিত কারণ আমরা কাউকে একটু দয়া করলে তার স্বীকৃতি (recongniton) চাই, দান বা সাহায্য করলে এর বিনিময় (return) চাই, প্রেম করলে বা কাউকে ভালবাসলে তার মধ্যে যৌনতা, বিনিময় বা বস্তুগত স্বার্থ খুজি। খ্যাতিমুক্ত দয়া, বিনিময়মুক্ত দান এবং স্বার্থহীণ ভালবাসাই হল দূষণ মুক্ত – এমন ভালবাসা দেখতে এবং তা ধারণ করতে হলে আমাদেরকে কোথায় যেতে হবে? সেক্ষেত্রে, আমাদেরকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলদের (আঃ) দিকে তাকাতে হবে। আল্লাহর দয়া, দান এবং ভালবাসা হল নিখুত, নিখাদ এবং সম্পুর্ন স্বার্থমুক্ত। তিনি তাঁর নবীদের (prophets) মাধ্যমে এই গুণগুলোর শিক্ষাগুলো দিয়েছেন যাঁরা তাঁদের চিন্তা, কথা এবং কর্মের মধ্য দিয়ে এসবগুণ গুলোর মুর্ত প্রতীক হয়ে আছেন । আল্লাহ এবং রাসুলদের এই স্বার্থহীণ শিক্ষা গ্রহণের জন্য কি কারো ধর্ম পরিবর্তনের আবশ্যকিতা আছে? স্বার্থহীন ভালবাসার শিক্ষা-দীক্ষা এবং মূর্ত উদাহরন আমরা এসব ধারণকারী যে কোন ধর্ম এবং বর্নের মহামনীষির কাছ থেকেই নিতে পারি। এমনকি স্বার্থহীণ ভালবাসার উদাহরন আমরা পৃথিবীর অনেক মায়ের কাছ থেকেও নিতে পারি – তা সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন।
দয়া হলঃ স্বেচ্ছায় এবং আনন্দচিত্তে অন্যের বিপদে সাহায্য করা, অন্যের অনুভুতির কথা বন্ধুত্ব, উদারতা এবং দরদ দিয়ে ভাবা, অন্যের অভাব পূরণ করা । অন্যদিকে ভালবাসা হলঃ অন্যকে হৃদয়ে স্থান দেওয়া ও নিজের অংশ করে নেওয়া, অন্যের অনুভুতিকে তীব্র এবং গভীরভাবে অনুভব করা, অন্যের অনুরাগে সিক্ত হওয়া। আমরা এসব মানবীয়ভাব এবং গুনগুলোকে যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করি না কেন এগুলোর অস্তিত্বকে কোন প্রকারেই অস্বীকার করতে পারিনা; আর এগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার না করলে এসবের ধারণকারী আত্মা, হৃদয়, মন বা নফস যাই বলিনা কেন সেটাকেও অস্বীকার করতে পারিনা।
একটা পুকুর, নদী বা মহাসাগর পানিকে শুধু ধারণ করতে পারে কিন্তু তাকে বাষ্প বানিয়ে বাতাসে নাচিয়ে, উড়িয়ে মেঘ বানিয়ে আবার বৃষ্টিতে পরিণত করতে পারে না। আমাদের হৃদয়েরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে; আর তা হল এটা শুধু প্রেম ভালবাসাকে ধারণ করতে পারে। কিন্তু সেগুলোকে হৃদয় থেকে বের করে ভাষান্তরিত করা ও সাজিয়ে গুছিয়ে পেশ করার কাজ করে আমাদের মস্তিষ্ক, গলা, জিহবা এবং মুখ । এ যেন একটা বড় কারখানায় অনেকগুলো মেশিনের সাহায্যে সিস্টেম্যাটিক পক্রিয়াকরনের মাধ্যমে একটি দ্রব্য বা প্রোডাক্ট তৈরি করা। আমরা খাবার খাই এবং আমাদের পরিপাকতন্ত্রের এক একটি অংগের কাজ হয় একেক রকম। বিভিন্ন পদের খাদ্য খাবার পর মুখ থেকে অগ্ন্যাশয় পর্যন্ত সকল অঙ্গগুলি যদি খাবার সুন্দর মত হজম করতে পারে তবেই এই খাবার থেকে তৈরি হয় শক্তি বা এনার্জি যা দিয়ে আমরা কাজ করি ও শরীরকে সচল রাখি। ঠিক একইভাবে আমরা যদি আমাদের হৃদয়ের সুকুমার বৃত্তি তথা প্রেম, ভালবাসা, দয়া, মায়াগুলোকে নির্ভেজাল এবং নিঃস্বার্থভাবে আত্তীকরণ করতে পারি তবে তা আমাদের এমন শক্তি দিবে যা দিয়ে আমরা বিনির্মান করতে পারব দয়ার পুকুর, প্রেমের সাগর আর ভালবাসার ঘর ।
প্রশ্ন হল একজন লেখক কেন লিখেন? যে কোন কিছু লেখার আগে আমাদের সবারই সচেতন অথবা অবচেতন মনে অবশ্যই এক ধরণের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কাজ করে। একজন লেখকের কাজ কি শুধুই আনন্দ দেওয়া অথবা নৈতিক শিক্ষা দেওয়া অথবা জীবনের অর্থ খুজে বের করা নাকি ভাষা, ছন্দ, রুপক এবং কল্পনার মাধ্যমে শৈল্পিক ভাবে মানব জীবনের একান্ত সম্পর্ক এবং সত্যকে আবিস্কার করা, মেলে ধরা এবং ক্ষেত্রভেদে সেই সত্যকে নতুনভাবে চিত্রায়ন করা ? আমরা আগেই বলেছি মিথ্যা গল্প বা কল্প চিত্রের মাধ্যমে দিনশেষে একমাত্র সত্যকে আবিস্কার করার মধ্যে দোষের কোন কিছু নেই যদি সেখানে জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্ত মিথ্যা শিক্ষা দেওয়া, অলীক চরিত্র, অর্থহীণ সস্তা চরিত্রায়ন, ঘটনা এবং কল্প-চিত্রের মাধ্যমে সব শেষে জীবনের ব্যাপারে মিথ্যা ধারণা দেওয়া নিশ্চয়ই একজন কবি বা লেখকের কাজ হতে পারে না কারণ মিথ্যা কক্ষনই জীবনকে অর্থবহ, সুখী, সুন্দর এবং আনন্দদায়ক করতে পারে না। বরং এতে বনি-আদমের জীবন হয় জটিল, অসুখী এবং কষ্টকর।
আমরা খেয়াল করলেই দেখতে পাব কিছু বিষয় বা সত্য আছে যা পৃথিবীর সব মানুষকে একই কাতারে দাঁড় করায়। যেমন সব মানুষের রক্তই লাল, সব মানুষেরই দুটি পা, দুটি হাত, একটি চোখ আছে; সবাকেই জন্মাতে হয় এবং মরতে হয় ইত্যাদি। আমি আগেই বলেছি যে পৃথিবীর সব মানুষের এইরকম কিছু কমন বা সাধারন সাদৃশ্য বা গুণ আছে এবং এ সত্যকে আমরা কেহই এড়িয়ে যেতে পারি না। যেমনঃ দয়া, মায়া, প্রেম, ভালবাসা, হিংসা, লোভ, অর্থ, বিত্ত এবং বিপরীত লিংগের প্রতি দুর্বলতা এমন অনেক কিছু। একজন বয়স্ক মহিলা অথবা পুরুষ পৃথিবীর অনান্য সব মানুষের কাছে যতই স্বার্থপর, ইতর বা নিষ্ঠুর হোক না কেন সে যখন একটা সদ্যজাত শিশুর মা অথবা বাবা তখন তাঁর ভিতরই আমরা দেখতে পাব পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র, গভীর এবং স্বার্থহীণ এক প্রেম এবং ভালবাসা যা আমরা সম্মান না করে পারিনা, যার তারিফ করে আমরা রচনা করি ভালবাসার কাব্য। একজন লেখক বা কবি যখন এমন কিছু সার্বজনিন শিল্প বা কর্ম তৈরি করতে পারে যা মানব জাতির – ধর্ম, বর্ন, গোত্র, কাল এবং দেশকে অতিক্রম করে, তখনই সে হয় সবার কবি বা লেখক। যে ক্যারিশম্যাটিক শিল্পী সবার মধ্যেই তাঁর আবেগ, ভাব, ধারণা এবং সর্বোপোরি তাঁর কর্মকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে সে-ই হয় বিশ্ব কবি বা লেখক।
কোন কবি বা লেখক যখন কোন ঐতিহাসিক ব্যাক্তি, ঘটনা বা ধারনা নিয়ে লিখেন তখন সে নিজেকে এইসব ঘটনা থেকে যত বেশি দূরে রাখতে পারেন তাঁর শিল্প কর্ম হয় তত বড়। এ ক্ষেত্রে একজন কবি বা লেখককে অবশ্যই অবজেক্টিভ বা নৈর্ব্যক্তিক হতে হয়। ঘটনার নাটকীয়, বাক্যিক, ছান্দিক, কাব্যিক এবং দ্বান্দ্বিক উপস্থাপনা হবে কিন্তু তা হবে সত্য এবং সুন্দরকে আবিস্কার এবং তুলে ধরার প্রয়াসে। আর যদি তা করতে পারেন তবে এই কর্ম লেখককে ছাপিয়ে যাবে এবং তাঁকে বাদ দিয়েই আমরা টেক্সট বুঝতে পারব।
কিন্তু এটা একটা কঠিন কাজ । আমরা আগেই বলেছি পৃথিবীর খুবই বড় মাপের কাজগুলোর কথাও যদি আমরা বলি সেখান থেকে শিল্পীকে আমরা বাদ দিতে পারব না। রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী, নজরুলের বিদ্রোহী, আল মাহমুদের সোনালী কাবিনে ভাষার যে বুনন, কল্প-চিত্রের যে উচ্চতা, ভাব এবং বিষয়বস্তুর যে মহিমা ব্যাক্তি হিসাবে তাঁদেরকে তা পেরিয়ে গিয়েছে । কিন্তু ভাষার এই যে বুনন তাতো কবিকেই বুয়েট থেকে পাশ করা একজন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ আর্কিটেকচারের মত অনেক ভেবে চিন্তা করে করতে হয়েছে; যে ইমেজ বা প্রতিচ্ছবি ব্যবহার করেছেন তাতো একান্তই তাঁদের ব্যক্তিগত মানসপটের দ্বারা আঁকা; তাদেরই হৃদয় থেকে নিংড়িয়ে বের করে আনা, আর আবেগ-অনুভুতি দিয়ে যে সত্য তাঁরা আবিস্কার করেছে তাতো তাঁদেরই চিন্তা, পরিশ্রম, ভাবনা, ভালবাসা, জীবনের অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির ফসল। ফলে তাঁদের মন, হৃদয় আর উপলব্ধিকে টেক্সট থেকে ভাগিয়ে দিয়ে এসব সত্যের মূল্যায়ন আপনি কিভাবে করবেন?
একজন লেখক বা কবির সব কর্মই যে ভাল হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এমন অনেক লেখক পাওয়া যাবে যারা তাঁদের পারিপার্শ্বিকতাকে ভালভাবে বুঝতে পেরেছেন কিনা তাতে আপনার সন্দেহ হবে। আপনি সেক্সপিয়ার এর কথাই ধরেন। এত বড় কবি এবং নাট্যকার কিন্তু তাঁকেও রেসিস্ট বলা হয় তাঁর Tempest এবং Othello নাটকের জন্য; নজরুলকে দায়ী করা হয় এই বলে যে তিনি একজন নিবেদিত হিন্দু ছিলেন যদিও জীবনভ্যাস ছিল একজন মুসলিমের মত। দেখুন কি কান্ড, আপনি অন্য ধর্মের কোন এক ব্যাক্তির দুঃখ-কষ্ট-প্রেম-ভালবাসা বর্ননা করতে গেলে আপনাকে আপনার ধর্ম পরিবর্তন করতে হবে! আবার রবীন্দ্রনাথকে দায়ী করা হয় একজন সাম্প্রদায়িক কবি বলে কারন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হল তিনি মুসলিমদের মধ্যে থেকে মুসলিমদের নিয়ে ব্যাবসা করেছেন কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর পালস বা নাড়ীর খবর নিতে ব্যার্থ হয়েছেন।
একজন কবি বা লেখকের অবশ্যই এই স্বাধীনতা আছে তিনি কাদের নিয়ে লিখবেন আর কাদের নিয়ে লিখবেন না। কিন্ত শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল – যার কথাই বলি আমরা তো সবাই মানুষ, আমাদের সবারই রক্ত লাল, আমরা সবাই মা এবং বাবা – হই আমরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ খ্রিষ্টান এবং কেউ বুদ্ধিস্ট – একজন মুক্তমনের কবিকে অবশ্যই এই বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে কারণ তিনি তো সবার কবি, তাঁর সমাজ তো কেবলমাত্র তাঁর জাতিকে নিয়ে নয় – তাঁর সমাজ হবে বিশ্বসমাজ। অবশ্য বিশ্বমানের লেখক ও কবিদের এই ধরনের সীমাবদ্ধতায় আমি দোষের কিছু দেখি না কারণ আমরা তো এক ঈশ্বর, খোদা বা নবী রাসুল নয়; আমরা মানুষ এবং একজন মানুষের পক্ষে অবশ্যই সকল যুগ, গোত্র, ধর্ম, বর্ন এবং দেশকে ধারন করা সম্ভব নয়।
প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের অন্যতম একটি পার্থক্য হল পাশ্চাত্য বলবে “তুমি তোমার যুক্তি (logic) এবং বুদ্ধিকে (reason) উন্নত ও বিশুদ্ধ (purify) কর অভিজ্ঞতা (empiricism), পরীক্ষা (experiment) এবং তোমার ইন্দ্রিয় উপলব্ধির (sensory perception) মাধ্যমে।“ আর প্রাচ্য বলবে “তুমি তোমার অন্তর, আত্মা (spirit or soul), আবেগ এবং জ্ঞানকে উন্নত বা পরিশুদ্ধ কর নিস্বার্থ দয়া, মায়া, ভালবাসা এবং ত্যাগ তিতিক্ষা দিয়ে।“ দর্শনের সাথে সাহিত্যের পার্থক্য বুঝতে হবে। অনেকেই বলেন যুক্তিকে পরিশুদ্ধ করতে গেলে মানুষকেই সবার উপরে সত্য বা স্ট্যান্ডার্ড বলে গ্রহণ করতে হবে। যে কোন মানুষঃ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক, ফেমিনিস্ট, হোমোসেক্স, লেসবিয়ান, গে, সুপারম্যসিস্ট, ইহুদী, খ্রিষ্টান, বুদ্ধিস্ট, হিন্দু, মুসলিম, মডার্নিস্ট, পোস্ট-মডার্নিস্ট, এথিস্ট – সর্বোচ্চ সত্যের মাপকাঠি বা স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে আপনি এদের মধ্য থেকে কাকে বাদ দেবেন আর কাকে রাখবেন? সবার উপরে এদের কি ‘সত্য’ হবার যোগ্যতা আছে? এরা কি বিশ্বজনীন বা সার্বজনিন? এরা কি নির্ভুল?
অন্যদিকে, আত্মা, হৃদয় বা মনকে পরিশুদ্ধ করতে গেলে আপনাকে তা নিস্বার্থ প্রেম, ভালবাসা, দয়া, মায়া, মমতা, দিয়ে করতে হবে। তাহলে আল্লাহতায়ালা কি আমাদের মাথা এবং হৃদয় তৈরি করেছেন পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করার জন্য? আসলে ব্যাপারটা এ রকম নয়। একজন বিজ্ঞানীর জীবনে কি প্রেম ভালবাসা থাকতে নেই? আবার একজন কবি বা শিল্পীর কি যুক্তিবোধ থাকবে না? আমাদের অসীম, প্রগাঢ় ও গোপন ভালবাসা থাকবে কিন্তু তার ভার এবং প্রলয় থেকে বাঁচার জন্যই আমাদের বুদ্ধির দরকার; ঝর্নার মত প্রবাহমান এবং প্রশান্ত মহাসাগরের মত গভীর হবে আমাদের আবেগ কিন্তু তা যেন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে আমাদের জীবনকে অর্থহীণ এবং ধ্বংস করে না দেয় তার জন্যই দরকার হবে যুক্তি এবং উপলব্বির। আবার হৃদয়, মন, আত্মা, প্রেম, ভালবাসা, দয়া, মায়া, হিংসা, অহংকার –দেখা যায় না বলে যুক্তি দিয়ে এসবের অস্তিত্ব অস্বীকার করা বা সন্দেহ প্রকাশ করা এবং সেই কারনে এসব বাদ দিয়ে একেবারে নির্দয়, নিষ্ঠর ও বস্তুবাদী হয়ে যাওয়া এবং অঙ্কের সুত্রে জীবন যাপন করা মানুষের জীবনকে শুধু অর্থহীনই করে না বরং মানুষকে মানুষের পর্যায় থেকে নামিয়ে তা বস্তু তথা বেচা-কেনার পণ্যের পর্যায়ে নিয়ে আসে।
মানুষের আত্মা (spirit) এবং মাথা (logic/reason) মুলতঃ একে অপরকে পরিশুদ্ধ (purify) করে; সুন্দর করে (beautify), সুষম করে (balance); সুন্দর এবং সত্য আবিস্কারে একে অপরকে সহয়তা করে; আমাদের জীবনের আনন্দগুলোকে বাধাহীণ করার সাথে সাথে তাকে জাস্টিফাই বা ন্যায্যতা প্রদান করে। যুক্তি এবং আবেগ – একে অপরকে তাদের হক বা অধিকার আদায় এবং সুবিচার নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসে। কবিতা এবং গল্প পড়ে আমরা যদি আনন্দিত না হই এবং সত্য বা সুন্দরের কাছাকাছি না যাই বা দেখা না পাই, তবে তা পড়ে আমাদের লাভটা কি?
দর্শন এবং দার্শনিকদের বিশাল একটা অংশ যদিও মন (mind) এবং আত্মা (soul) নিয়ে কাজ করে তবুও এটা মূলত যুক্তি (logic) ও প্রয়োগ/অভিজ্ঞতা (empiricism/) নির্ভর। কিন্ত সাহিত্যের মূল উৎসই হল মন এবং আত্মা। দর্শন বা ফিলোসফিতে জাস্টিস বা সুবিচারের বিষয়টি কক্ষনই মুখ্য নয় কিন্ত কাব্য, কবিতা, নাটক এবং যে কোন ধরণের গল্পের (fictions) ক্ষেত্রে একজন কবি এবং লেখকের কাছে পোয়েটিক জাস্টিস বা কাব্যিক সুবিচার খুবই গুরুত্বপুর্ন। বিচারের প্রশ্ন তখনই আসে যেখানে থাকে দ্বন্দ্ব বা সংঘাত (conflict), সন্দেহ, ভুল বুঝাবুঝি এবং বৈপরীত্য যা যে কোন সাহিত্যকর্মের সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি। এমন কোন সাহিত্যকর্ম পাওয়া যাবেনা যেখানে কনফ্লিক্ট নেই। এই সংঘাত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে; সচেতন বা অবচেতনভাবে, দৈহিক বা মানসিক ভাবে হতে পারে। আবার দ্বন্দ্ব হতে পারে এক চরিত্রের সাথে তাঁর নিজের বা অন্য চরিত্রের বা পরিবারের, সমাজের, ভাগ্য বা নিয়তির (fate), অতিপ্রাকৃতের (supernatual), দেব-দেবীর, কুসংস্কারের, রাক্ষসের এবং কোন অবস্থা, মতাদর্শ বা ধারনার। প্রতিটা ক্ষেত্রেই পোয়েটিক জাস্টিস থাকতে হবে যেখানে ন্যায়/সততা হবে পুরস্কৃত এবং অন্যায়/অসততা হবে শাস্তিপ্রাপ্ত বা পরিত্যাক্ত। আর এই জাস্টিস বা বিচার করতে গেলে তা হতে হবে সত্যের মাপকাঠিতে যেখানে সত্য বলতে বুঝায় সুন্দর, অকৃত্রিম (genuine), ন্যায়, আসল এবং যা কিছু মিথ্যার বিপরীত। মোট কথা দ্বন্দ্বের একটা সুন্দর, ন্যায়সঙ্গত, সুষম, আবশ্যিক পরিনামযোগ্য সমাধান। তা হতে পারে রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পের ফটিকের মৃত্যু অথবা নজরুলের মৃত্যক্ষুধার রুবির অনিশ্চিত যাত্রা অথবা শেক্সপিয়ারের রোমিও এবং জুলিয়েটের ট্র্যাজিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ।
দিনশেষে অবশ্যই পাঠক বিচার করবেন কবি এবং লেখক তাঁর কর্মে কতটুকু জাস্টিস করতে পেরেছে এবং জীবনের অর্থ সত্যিকারভাবে কতটুকু তুলে ধরতে পেরেছে। চরিত্র, ঘটনা, দ্বন্দ্ব, এবং সাবলিল বর্ননার মধ্য দিয়ে জীবনের জানা এবং অজানা বিষয়গুলোকে নাটকীয়ভাবে তুলে ধরে জীবনকে আনন্দময়, সহজ, সুন্দর, অর্থময় করে তুলাই একজন কবি ও লেখকের কাজ। এ এমন এক কর্ম বা প্রচেষ্টা যার শেষ গন্তব্যস্থল হল সত্য ও সুন্দরের আবিস্কার। যে কোন টেক্সটের সার সংক্ষেপে, জীবন সম্বন্ধে যে কোন অসত্য বা অবাস্তব উপস্থাপন জীবন সম্বন্ধে ভুল ধারণা দেবে, পাঠকের জীবনকে অসুখী করবে এবং তাঁর আত্মা বা মনকে করে তুলবে দূষিত এবং বিষময়। কোন কোন ক্ষেত্রে একজন লেখকের মিথ্যা এবং অবাস্তব জীবনের চিত্রে (representation) একজন পাঠক সাময়িকভাবে সুখী হলেও হতে পারে। তবে তাতে তাঁদের চোখে জীবনের আসল রং কখনই ধরা পড়ে না ।
যে কোন লেখক ও কবির মন, আত্মা বা হৃদয়ের প্রত্যেকটি ভাব অন্য একটি মন বা হৃদয়ে কতটুকু স্থানান্তর করতে পারছে তা নির্ভর করে তাঁর সংবেদনশীলতা, বুঝ এবং ভাষান্তরের দক্ষতার উপর; কিন্ত তা কতটুকু অবিকৃত সেটা নির্ভর করে তার ভিতরের ভাবগুলোকে বাইরে এনে তাঁর লেখায় সে কতটুকু বিচুত্যিমুক্ত এবং যথাযথভাবে ধরে রাখতে পেরেছে তার উপর। যদি এই ভাবগুলো (abstractions) ব্যাপকভাবে পরিবর্তন, পরিমার্জন, বির্নির্মান ও পুনর্গঠন হয় তবে এর আসল রঙ বা মূল বার্তা (core message) হারিয়ে যায় এবং বিকৃত হয়। লেখক ও কবিরা নবী রাসুল (আঃ) নন এবং তাঁদের ভাব, ভাষা এবং লিখিত কর্মগুলো আসমানি কিতাবের কোন বাণীও নয় যে এগুলোকে ১০০% সত্য হতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁরা জীবনের ভূল বা অসত্য চিত্রগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরে আমাদের জীবনকে কষ্টকর এবং অসুন্দর করবে। যা সত্য তাই সুন্দর আর যা সুন্দর তাই সত্য। লেখক এবং কবিরা সুন্দর কারণ আহকামুল হাকেমিন তাঁদেরকে এমন ক্ষমতা দিয়েছেন যে তাঁরা মানুষের অন্তুরের সত্যেক সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পারে। কাজেই শুধু আনন্দ আর হৃদয়ের আবেগকে শৈল্পিকভাবে আকৃষ্ট করে প্রকাশ করাই তাঁর কাজ নয় বরং তাঁর কাজ হল সত্যকে ফিগার বা আকৃতি দিয়ে ফুটিয়ে তুলা যাতে করে তা সহজেই চেনা যায়; আর তা না পারলে অন্তত যতটুকু পারা যায় সত্যের সর্বোচ্চ কাছাকাছি যাওয়া; চেষ্টা করা তাঁর হৃদয়ের সুন্দর, শ্রেষ্ঠ এবং অজানা ভাবগুলোকে যথাসম্ভব অবিকৃতভাবে তুলে ধরা।
উদাহরণ দেওয়া যাক। মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদী ধর্মের সকল রাসুল এবং নবী – আদম (আঃ) থেকে সর্বশেষ মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত এবং সেই সাথে বৌদ্ধ, হিন্দু ও শিখ ধর্মের এমন কোন প্রবর্তক এবং প্রধান ধর্মগুরু পাওয়া যাবে না যিনি স্বপ্ন দেখেননি এবং সেই স্বপ্ন কোন বিশেষ অর্থ বহন করেনি। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হযরত ইউসুফ (আঃ) এর স্বপ্ন। তিনি স্বপ্নে দেখেন যে এগারটি তারা এবং সেই সাথে চাঁদ এবং সূর্য তাঁকে সিজদা করছে। বাস্তবে এইটা অসম্ভব এবং পুরোটাই ফিকশন কিন্তু এর একটা বাস্তব (real) অর্থ ছিল আর তা হল এই যে তিনি হবেন একজন নবী এবং তাঁর পরিবারের সবাই তাঁকে শেষমেশ তাঁদের নেতা বা নবী হিসাবে মেনে নিবেন। আবার ফেরাউনের সেই স্বপ্নের কথা ভাবেন যার অর্থ করেছিলেন হযরত ইউসুফ (আঃ)। এই স্বপ্নটিও ছিল একটি পুরো ফিকশন যেখান সাতটি দুর্বল গরু সাতটি মোটা–তাজা গরুকে খাচ্ছিল যার অর্থ ছিল দুর্ভিক্ষ থেকে রেহাই পেতে সাত বছর পালাক্রমে ফসল ফলাতে হবে; এরপরে সাতটি সবুজ শীষ ও অপর সাতটি শুষ্ক শীষ যার অর্থ ছিল ফসল কাটার পর সামান্য খাবে ও তা বাদে শীষ সমেত সংরক্ষণ করবে আর এর পরে একটা বছর আসবে যখন অনেক বৃষ্টি হবে আর মানুষ অনেক ভোগবিলাস করবে (সুরা ইউসুফ ১২:৪৩-৪৯)।
এই স্বপ্নে যে সকল প্রাণীর একে অপরকে ভক্ষন করার কথা বলা হয়েছে বাস্তবে তা অসম্ভব ছিল কারণ সাতটি দুর্বল গরু নিশ্চয়ই সাতটি সবল গরুকে ভক্ষন বা ক্ষেতে পারে না। কিন্তু এই স্বপ্নগুলোর প্রত্যেকটা বিষয়ই ছিল প্রতীকী (symbolic) যার ছিল বিশেষ এবং বাস্তব অর্থ। এবং আমরা দেখি যে স্বপ্নে দেখানো নমুনাস্বরূপ (representative), রুপক (figurative) এবং ইংগিতপুর্ন (suggestive) ঘটনাগুলো বাস্তবেই ঘটেছিল। অবশ্যই নবী রাসুলগণ (আঃ) আমাদের মত সাধারন মানুষ ছিলেন না এবং আমরা তাঁদের সাথে আমাদের তুলনাও করব না। যে বিষয়টা এখানে গুরুত্বপূর্ন তা হল প্রতীকী আকারে অথবা রুপকভাবে যদি কোন কিছু বলা হয় যা আমাদের জীবনকে প্রতিনিধিত্ব (represent) করে এবং এর ফলে একটি সত্য বেরিয়ে আসে তবে তা আমাদের জীবনকে অনেক সহজ, অর্থপূর্ন এবং সুন্দর করতে পারে। একজন কবি ও লেখক অনেকগুলো রাজ্য ভ্রমন করেনঃ দয়ার রাজ্য, প্রেমের রাজ্য, ভালবাসার রাজ্য, সুখের রাজ্য, দুঃখের রাজ্য, নিষ্ঠুরতার রাজ্য, অভাবের রাজ্য, লোভের রাজ্য, ক্ষমতার রাজ্য, সম্ভোগের রাজ্য ……, এবং সব রাজ্য ভ্রমন করে শেষ গন্তব্যস্থলে এসে তিনি আমাদেরকে একটি সত্য বার্তা দেন – তা ১০০% পুরো সত্য না হলেও অন্তত সত্যের খুবই কাছাকাছি হতে হবে যা আমরা গ্রহণ করতে পারি। আর এতগুলো রাজ্য ভ্রমন করেও যিনি আমাদের সত্য এবং সুন্দর বার্তা দিতে পারবেন না, তাকে কি আমরা মৃত বলতে পারি না?
সবশেষে, একজন কবি ও লেখকের মৃত্যুর জন্য কোন প্রকারেই পাঠক, শ্রোতা বা সমালোচকগণ দায়ী নয়; তাঁকে তাঁদের মেরে ফেলারও কোন প্রয়োজন নেই। সত্য সর্বদাই সুন্দর ও চিরস্থায়ী – এর মৃত্যু নেই। একজন কবি ও লেখক — এই সত্য ও সুন্দরকে পুঁজি করেই দেশ, কাল, ধর্ম ও বর্নকে অতিক্রম করে শত বাধা পেরিয়ে এবং এটাই তাঁর শেষ গন্তব্যস্থল । মূলতঃ একটি টেক্সটে মানবজীবনের অন্তঃনিহিত সত্যগুলোকে চিত্রায়নে ব্যার্থ যে কোন লেখক ও কবি নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটায় এবং এর জন্য সে নিজেই দায়ী।
(তিনটি কিস্তি লেখা আমার দেশ অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ০৮ জানুয়ারী ২০২৪)