কোটা আন্দোলন থেকে এক দফা – এ পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন

Share this post

প্রথমেই বলে রাখি যে ক্ষমতাসীন রেজিম এবং তার এস্টাব্লিশমেন্ট তাদের শেষ কামড় দেবে এবং ছাত্র-জনতার বিপ্লব নস্যাৎ করার জন্য এমন কোন পথ ও অস্ত্র নাই ব্যবহার করবে না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সে শত্রুকে স্বামী বা নিয়ন্ত্রকের আসনে বসাতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। রেজিম তার শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও ক্ষমতাকে ধরে রাখার অপচেষ্টা করবে। বর্তমান ছাত্র-জনতা এবং দেশপ্রেমিক বাহিনীর লড়াই বাংলাদেশের অস্ত্বিতের লড়াই; এখানে দুটি দলঃ দেশপ্রেমিকের দল আর বেঈমানের দল; মজলুম আর জালিমের লড়াই – মাঝামাঝি কোন দল নেই। এ লড়াইয়ে যদি বেঈমানরা জিতে যায় তবে জাতি হিসাবে আমাদের গোলামীর খাঁচায় বন্দী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। 

ধরে নিলাম বর্তমান ক্ষমতাসীন রেজিম বা সরকার ছাত্রদের দাবীর প্রেক্ষিতে ১০০% কোটা সিস্টেমই বাতিল করল এবং ক্ষমতায় থাকার শর্তে আরও দাবি-দাওয়া মেনে নিল। কিন্তু তাতে কি এই সমস্যার সমাধান হবে? ছাত্রদের দাবীর এসেন্স বা মুল কথা হল মেধার মূল্যায়ন। কিন্তু সরকার সব দাবী মেনে নিলেই কি মেধার মূল্যায়ন হবে? ক্ষমতাসীন রেজিমের অতীত এবং বর্তমান তথ্য –প্রমাণের ভিত্তিতে এটা বলা মোটেই অযৌক্তিক হবে না  যে এ সমস্যার সমাধান তো হবেই না বরং কিছুদিন পর ছাত্রদের আবারও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে নামতে হবে, মরতে হবে, পঙ্গু হতে হবে; নিঃসন্দেহে ততদিনে রেজিম অতীতের মতই দমন নিপীড়নের নতুন কৌশল এবং মাত্রা বাড়াবে এবং এ আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ  করে দেবার ফন্দি আঁটবে। যায় হোক, ছাত্রদের আবারও জেনে শুনে গুলি খাওয়ার আন্দোলন ছাড়া  কোন বিকল্প থাকবে না।  কেন?     

কেইস স্টাডি হিসাবে আমি শুধু একটি স্যাম্পল বা নমুনা এখানে তুলে ধরব। এ রকম হাজার হাজার কেইস স্টাডি স্যাম্পল বা এক্সাম্পল আপনাদের জানা আছে।  এটা এমন একটা ঘটনা যা আপনি আরব্য উপন্যাস অথবা ড্রাকুলার চেয়েও গভীর কল্পনার জগতে গিয়েও কল্পনা করতে পারবেন না। সেটা কি? দেখুন দৈনিক ইত্তেফাকের ১৪ জুলাই ২০২৪ এর একটি সংবাদঃ ‘মেয়েকে বিয়ের শর্তে জামাইয়ের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দেন শ্বশুর; ননদও একই কায়দায় সুবিধাভোগী[‘। এই একই ঘটনার উপর ভিত্তি করে আরেকটি পত্রিকা জানায়,’ সিআইডি তিনটি বিসিএস পরীক্ষা পর্যালোচনা করেছে। সংস্থাটির সূত্রে জানা গেছে, ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় পুলিশ ক্যাডারে ২৪টি ও ৪১তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে ১৬টি জেলার কোন প্রার্থী নির্বাচিত হয়নি। …… ৪৩তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে ১৪ জেলায় কোনো প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়নি। মোট ১০০ জন উত্তীর্ণ হন, এর মধ্যে ৯ জন নারী। ফলে এখানে কোটা পূরণ করা হয়নি। এই তিন বিসিএসে যেসব জেলায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তারাই উত্তীর্ণ হয়েছেন। পুলিশ ক্যাডারসহ সকল ক্যাডারে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে’ (১৪ জুলাই, ঢাকাপ্রকাশ)। গত ১৫/২০ বছরে কিভাবে জাতীয় পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তা জানলে আপনার গাঁ শিউরে উঠবে। ফাঁসকৃত এইসব প্রশ্নপত্রে যারা চাকুরি পেয়েছেন সেইসব অপরাধী, দুর্নিতিবাজ, মেধাহীন বিষ ফোঁড়া গুলো সংগত কারণেই এই ক্ষমতাসীন রেজিমকে টিকিয়ে রাখার জন্য জীবন বাজী রাখবে। সুবিধাভোগী এইসব কুলাংগাররাই জনগণের টাকায় খায়, পরে, বউ,-বাচ্চা-কাচ্চা পালে, সংসার চালায় আবার জনগণের টাকার কলম ও বন্দুক দিয়ে তাদেরই বাচ্চাদের ঠকায় ও গুলি করে মারে।   

যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তারা কারা? যখন যারা ক্ষমতায় থাকে তারাই তো বিসিএস সহ সকল পরিক্ষায় প্রশ্নপত্র তৈরি, বিলি বন্টন এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনায়  থেকে থাকে। এই সকল শিক্ষাবিদ, আমলা, বুদ্ধিজীবী, পণ্ডিতরাই হয়ে উঠেন পরীক্ষার প্রশ্ন বিক্রি করার মাফিয়া। শেয়ার বা ভাগ শুধু ড্রাইভার, রাজনীতিবিদরাই পান না, পান শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী নামের এসব ভণ্ড প্রতারকরা। দেশপ্রেম আর মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে এরা মুখে ফেনার বন্যা বয়ে দেয়, কিন্ত ভিতরে থাকে সকল ধরণের মোনফেকি, প্রতারণা, এবং দেশপ্রেমহীণ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চেতনা কারণ এরা তারা যারা এদেশের খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে এবং সাধারন মেহনতি মানুষের সন্তান সন্ততিদের কাছ থেকে পরীক্ষার নামে ব্যাংকের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নেয় কিন্ত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে তাঁদের মেধাকে নর্দমায় ফেলে দেয়।  

১০০% কোটা তুলে দিয়ে ক্ষমতাসীনরা এভাবেই দুর্নিতি করবে এবং পুনরায় তাদের লোকজনকেই নিয়োগ দেবে। মেধাকে যে নর্দমায় তারা ফেলে দিত পুর্বের মত তাকে তারা সেই একই নর্দমায় নিক্ষেপ করবে। দুর্নিতির ধরণ, মাত্রা এবং কৌশল পরিবর্তন করে তাদের নির্ধারিত কোটা তারা পুষিয়ে নেবে। সুতরাং যা দরকার তা হল গুড গভর্ননেন্স তথা রেজিম চেঞ্জ, এর বিচার এবং দুর্নিতিমুক্ত একটি ব্যবস্থা। এই রেজিম যদি ক্ষমতায় থেকে যায় তবে অবস্থা হবে ‘যা লাউ তাই কদু’।  ইতিমধ্যেই তারা দুর্নিতির হাজার হাজার বরপুত্র তৈরি করে তাদেরকে যেভাবে ক্ষমতায়ন, পদায়ন, রাষ্ট্রীয়করন এবং সাংবিধানায়ন করেছে তাতে বিরোধীদের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ট্যাগ দিয়ে এদেশে বসবাস করাকে জাহান্নামে পরিণত করবে; এর প্রমাণ ইতিমধ্যেই তারা করেছে। আপনি হিন্দু হন আর মুসলিম হন আর খ্রিষ্টান হন – রেজিমের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই হল আপনি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী।    

রেজিম কিভাবে কিলিং ম্যান এবং মনস্টার তৈরি করে এবং করেছে তার একটি উদাহরণ দিয়েই শেষ করব। পুলিশের প্রাক্তন আইজিপি এবং র‍্যাবের প্রধান বেনজির আহমেদ বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন; তার কথা বার্তা শুনলে মনে হবে বাংলাদেশে তার চেয়ে এতবড় দেশপ্রেমিক আর দ্বিতীয়টি নেই; যেমন তিনি বলেছেনঃ “স্বাধীনতা, সংবিধান, রাষ্ট্র ও জাতির জনক – নোবডি ক্যান টাচ দেম!” অথচ এই সেই দেশপ্রেমিক (!) যে গোপনে গোপনে দেশকে শোষণ করেছে; লুট করেছে এ দেশের মেহনতি মানুষের কস্টার্জিত উপার্জন এবং নেতৃত্ব দিয়েছে গুম এবং বিচার বহির্ভুত  হত্যাকান্ডের। তার দুর্নিতির তদন্তের শুরুতেই ‘দুদকের আইনজীবির তথ্য অনুযায়ী দুদক তার ও তার পরিবারের যে সব সম্পদ জব্দ বা ফ্রিজ করার নির্দেশ দিয়েছেন তার মধ্যে আছে ঢাকার গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, তিনটি শেয়ার ব্যবসার বিও অ্যাকাউন্ট, প্রায় ৬২১ বিঘা জমি, উনিশটি কোম্পানির শেয়ার এবং ত্রিশ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র’ (১ জুন ২০২৪, BBC NEWS বাংলা) । এ রেজিমের গত তিনটি টার্মে  শুরু থেকেই এ রকম হাজার হাজার ভণ্ড দেশপ্রেমিক আর প্রতারক চেতনাবাজ বেনজির তৈরি করে চলেছে যারা রাস্ট্রের প্রতিটি বিভাগে প্রকাশ্য এবং গোপনে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভুমিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে যাচ্ছে। অর্থলোভী, স্যাডিস্ট, ভণ্ড প্রতারক যেমন প্রেমকে লালন এবং ধারণ করতে পারে না, ক্ষমতাসীন রেজিমের নিয়োগকৃত এবং তৈরি করা এইসব  ভুয়া, মেধাহীণ, দলীয় এবং দুর্নিতিগ্রস্ত দেশপ্রেমিকরাও কক্ষন মেধার লালন করতে পারবে না এবং করবে না – এটা আর বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।   

এদের দেশপ্রেম ফেইক, এদের গণতন্ত্রের বয়ানের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সকল ধরণের স্বৈরতান্ত্রিকতা, এদের আইনের ছবকের প্রতিটি শব্দে পাওয়া যাবে দ্বিচারিতা।  এই রেজিম দেশপ্রেম এবং লুটপাটকে একাকার করে ফেলেছে; গণতন্ত্র এবং ভোট- ডাকাতিকে সমার্থক শব্দে পরিনত করেছে; আইন এবং গুম-খুনকে একটি শব্দের বাক্সে ভরে ফেলেছে। এই চেতনাবাজরা দেশটাকে নিজেদের ব্যাক্তিগত টয়লেট টিস্যুর মত মনে করে। নিজের এবং তাদের আত্মীয়দের ক্ষমতা, ইগো এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য  বিসিএসের প্রশ্ন কেন, প্রয়োজনে গোটা দেশকেই পানির দরে অন্যের কাছে বন্ধক বা বিক্রি করে দিতে পারে। গ্রামের নিরন্ন, ছেঁড়া বস্ত্রাবৃত অথবা টিউশনি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের মেধা এদের কাছে মূল্যহীন আগাছার মত; কারণ তারা তো মনে করে এ দেশ তাদের বাপ দাদার তালুক এবং ঠিকাদারি আর তাই প্রশ্ন ফাঁস এবং ভোট ডাকাতির মত দুর্নিতি করা তাদের অধিকার।  

ক্ষমতাসীন রেজিম ছাত্র জনতাকে যে পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তাতে এর সম্পুর্ন  পতন না হওয়া পর্যন্ত আর পিছনে ফেরার  কোনই সুযোগ নেই। এটা হল পয়েন্ট ওফ নো রিটার্ন । মনস্টার বা রাক্ষসকে  হয় প্রতিহত করতে  হবে আর না হয় রাক্ষস দ্বারা চর্বিত বা ভক্ষিত হতে হবে। মাঝামাঝি কোন পথ নেই।  

বিজয়ের শেষ প্রান্তে এসেও অনেক সময় বিজয় হাতছাড়া হয়ে যায় কিছু মোনাফেক এবং সুবিধাবাদীদের চক্রান্তের কারনে।ক্ষমতাসীন রেজিমের লাইনে যারা অতিতে কাজ করেছে এবং একই লাইনে যাদের চিন্তাধারা তারা গোপনে একটা আঁতাত করবে এটাই স্বাভাবিক এবং চিরসত্য। এ ব্যাপারে অবশ্যই বর্তমান নেতৃত্বকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। গত পনের বছর ধরে বাংলাদেশের প্রায় সব দল মিলেও রেজিমের একটা চুলও ছিড়তে পারেনি – কিন্তু বর্তমান ছাত্র জনতার বিপ্লবে ক্ষমতাসীন রেজিম প্রায় মৃত – এর অন্যতম কারণ যারা বিপ্লব করছেন এবং নেতৃত্বে আছেন তারা প্রকৃত দেশ প্রেমিক এবং সত্যিকার অর্থেই তারা একটা পরিবর্তন চান। বিজয় না আসতেই যারা ক্ষমতার স্বপ্ন দেখেন, নেতৃত্বের মধ্যে কোন্দল বাঁধিয়ে তারা গোটা বিপ্লবকেই নস্যাৎ করতে চায়। আগের বিষয় আগে পরের বিষয় পরে।  শেষ পর্যন্ত মোনাফেক, ভণ্ড, রেজিমের দালাল এবং ফেইক চেতনাবাজদের প্রতিহত করে  বিজয় ছিনিয়ে আনাটাই এখন মুল কাজ।  

ছাত্র জনতা এবং দেশ প্রেমিক বাহিনী ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে তারা উপমহাদেশের দ্রাবিড় জাতির বংশধর, তারা কোন স্বৈরাচার এর গোলাম নয়, তাঁদেরকে আর একটি প্রদেশের নাগরিক বানানোর ষড়যন্ত্র কক্ষনই সফল হবে না –এটা হবে আগুন নিয়ে খেলা।  

সর্বশেষ; এখনই সময় জগতশেঠ, মীরজাফর আর ঘসেটি বেগমদের প্রতিহত করা এবং আইনের আওতায় এনে বিচার করা; তাদের সুযোগ দিলে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বাংলাদেশ নামক শেষ আলোটাও চিরতরে নিভে যেতে পারে।     

Share this post

Leave a Reply