দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগে ফিলসফি বা দর্শন শুধুমাত্র দর্শন বিভাগেই পড়ানো হত, কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে দর্শন বিষয়টি থিওরি আকারে সাহিত্য বিভাগে জুড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে করে আমাদের ছাত্ররা সাহিত্যকে দর্শনের আলোকে ব্যাখ্যা করতে পারে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মডার্ন লিটারেরি থিওরি (Modern Literary Theory) কোর্স নাম দিয়ে ছাত্রদেরকে মার্ক্সিজম, ফ্রয়েডিয়ান থিওরি, ডিকন্সট্রাকশন, মডার্নিজম, পোস্ট-মডার্নিজম এবং ফেমিনিজম এর মত ওয়েস্টার্ন ফিলসফি পড়ান হচ্ছে। খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়ই সাহিত্যে বিভাগে তাঁদের কোর্সে প্রাচ্যের কোন দর্শন অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বিশেষ করে যদিও এই এরিয়াতে ইসলামী দার্শনিকদের বিশাল এবং সমৃদ্ধ কাজ আছে, তবুও আমাদের প্রফেসর এবং বিভাগীয় প্রধানগণ ইসলামোফোবিয়ার কারণে ইসলামী ফিলসফিকে লিটারেরি থিওরি কোর্সে সামান্যতম স্পেস দিতেও একেবারেই নারাজ। এর ফলে আমাদের ছাত্রদের ক্রিটিক্যাল এবিলিটি বা সমালোচনার ক্ষমতা হচ্ছে একপেশে এবং অসম্পূর্ণ। জ্ঞানের এই প্রসিদ্ধ, প্রতিষ্ঠিত এবং আলোকিত শাখাকে লিটারেরি থিওরিতে অন্তর্ভুক্ত না করাটা এক ধরণের একাডেমিক ফ্যাসিজম।
একজন কবি, লেখক বা দার্শনিক মানুষের মাথা এবং হৃদপিণ্ড নিয়ে কাজ করে – অন্য ভাষায় বুদ্ধিমত্তা বা যুক্তি (reason) এবং আবেগ ও আত্মা (emotion/soul) হল তাঁদের কাজের উপাদান। নিশ্চিতভাবেই এ কাজে একেক জনের বোধশক্তি এবং বুঝানোর কৌশল থাকে একেকরকম। প্রফেটসরা এদিক দিয়ে ভিন্ন, কারণ তাঁদেরকে রবের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে হত; তাঁরা তাঁদের স্বাধীনতা এবং সীমাবদ্ধতা বুঝতেন এবং তার আলোকেই তাঁরা তাঁদের বোধ শক্তি বা যুক্তি ব্যাবহার করতেন। কখনও কোন বিচ্যুতি হলে মহান মালিক তাঁদের শুধরিয়ে দিতেন । তাঁরা স্বাধীন মত চলাফেরা করতেন, কথা বলতেন, যুক্তি তুলে ধরতেন, বিয়ে-সাদি করতেন; কিন্তু সবকিছুর জন্যই তাঁদের একটা জবাবদিহিতার আওতায় থাকতে হত। অন্যদিকে, কবি, লেখক বা দার্শনিকদের এই রকম কোন বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। কথা, চিন্তা, যুক্তি এবং ব্যাখ্যার জগতে তাঁদের কোন জবাবদিহিতাও নেই; তাঁরা কোন ভুল করলে তা ধরিয়ে দেবার মত কোন ঐশী ব্যবস্থাও নেই। চিন্তার ব্যাপারে তাঁরা এতটাই স্বাধীন যে এদের কেউ যদি আল্লাহ বা গডকে অস্বীকার করে বা গডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তবে কারোরই কিছু করার নেই, এবং অনেকে সেটা করেনও।
এতদসত্বেও এই তিন শ্রেণীর মধ্যে অদ্ভুত কিছু সাদৃশ্য আছে। অনেক কবি, লেখক, দার্শনিক এবং সকল নবী রাসুলগণই স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিস্টকে চ্যালেঞ্জ করেছেন কিন্তু তাঁরা কক্ষনই ক্ষমতার অংশীদারিত্ব চান নাই যদিও বৈধভাবে একটি রাষ্ট্রে ক্ষমতায় যাওয়া এবং সুশাসন করা যে কোন নাগরিকেরই একটি স্বীকৃত আইনগত অধিকার । তাহলে এ কথা কি বলা যায় না যে লড়াইটা ছিল মূলতঃ দর্শন এর সাথে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট এবং ফ্যাসিজমের?
যায় হোক, এদের মধ্যে যে সমস্ত মিল আছে তার মধ্যে অন্যতম হল এরা সবাই ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়েন বা যুদ্ধ করেন; কিন্তু অনেক অমিলের মধ্যে এটাও সত্য যে লেখক, কবি এবং দার্শনিকরা ফ্যাসিস্ট হতে পারে কিন্তু প্রফেটসরা (যারা দার্শনিকও বটে) কক্ষনই ফ্যাসিস্ট হয় না। সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে প্রফেটসরা কি দার্শনিক? আমরা অনেকেই মনে করি প্রফেটসরাই ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম এবং সবচেয়ে কার্যকরী লড়াই করেছেন। তাহলে বুঝা দরকার ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা তাঁরা কিভাবে করেছেন? এটা জানা খুবই জরুরী কারণ প্রফেটসদের এই চিন্তা, লড়াই, কথোপকথন, পটভূমি বা প্রেক্ষাপট (context) এবং কর্মপদ্ধতির উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে আইন, আদেশ এবং বৈধ অবৈধর ফরমান যা এখনও পৃথিবীর অনেক দেশে কার্যকর। সে আলোচনায় যাবার আগে কবি/লেখক এবং দার্শনিকের ব্যাপারে কিছু আলোচনা দরকার।
একজন কবি বা ফিকশন লেখকের সাথে একজন ফিলসফার এর অনেক সাদৃশ্যের মধ্যে কিছু সহজ দৃশ্যমান পার্থক্য আছে। কবি তাঁর কাজে অবধারিত ভাবেই, ধারনা এবং চিত্রকল্প (imagery) ব্যবহার করেন যা একজন দার্শনিক তাঁর কাজে ব্যবহার করতেও পারেন নাও করতে পারেন। কবি বা গল্পলেখকের ঘর নির্মিত হয় পটভূমি (plot), কনফ্লিক্ট, প্রেক্ষাপট (setting), চরিত্র (character), কল্পনা (imagination), চিত্রকল্প/কল্পচিত্র (mental picture through sense language), রূপক ও আলঙ্কারিক ভাষা (figurative language devices) ইত্যাদি দিয়ে। অন্যদিকে, একজন দার্শনিক মূলত তাঁর বাড়ী তৈরি করেন অভিজ্ঞতা (experience or experiment), যুক্তি (logic or reason), ধারণা (deduction), বিশ্লেষণ (analysis), নিশ্চয়তা (certainty), সন্দেহ (doubt), সমালোচনা (criticism) ইত্যাদি দিয়ে। গল্প, কবিতা বা দর্শনে এই সরঞ্জামাদি বা টুলসগুলো একসাথে অথবা আংশিকভাবে ব্যবহার হতে পারে।
কবিতা এবং গল্পের মধ্য দিয়েই আমরা বেড়ে উঠি; ফলে এর সংজ্ঞা না জানলেও আমরা এগুলো চিনি বা বুঝি। কিন্তু দর্শন বিষয়টা আমাদের অনেকের কাছে বিজ্ঞানের চেয়েও জটিল বলে মনে হয়! ক্যামব্রিজ ডিকশনারির ভাষায়ঃ যথাবিধিভাবে (formally) বলতে গেলে দর্শন হল যুক্তির ব্যবহার যার মাধ্যমে আমরা আমাদের বাস্তব জগত এবং আমাদের অস্তিত্বের মত বিষয়গুলোর প্রকৃতি বা ধরণ বুঝে থাকি; এর পাশাপাশি দর্শন আমাদের জ্ঞানের ব্যবহার, সীমানা এবং নৈতিক বিচারের নীতিগুলাও আলোচনায় নিয়ে আসে। ঘরোয়াভাবে (informally) বললে, আপনি আপনার জীবন নিয়ে যেভাবে ভাবেন এবং চলেন সেটাই আপনার দর্শন; অন্য কথায় এটা হল একটি সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং নীতিমালা যা একজন ধারণ করে।
এটা ঠিক যে প্রত্যেকটা জীবনই অনন্য বা বিরল (unique); অর্থাৎ প্রত্যেকটি মানুষই কোন না কোনভাবে ভিন্ন এক বিশেষ গুণে গুণান্বিত। কিন্তু তা সত্বেও দৈহিক এবং মনোজাগতিক ভাবে আমাদের ভিতর অনেক মিল আছে। লেখক, দার্শনিকরা নিশ্চয়ই আমাদের এই ব্যতিক্রমী বা অনন্য দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেন না, কারণ এতে করে তাঁরা আমাদের জীবন এবং অস্তিত্বের ন্যাচার বা ধরণের ব্যপারে সাধারণ (common) কোন ফরমুলা, থিওরি বা তত্ত্বে আসতে পারবে না। ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ বা দেশের ব্যপারে কোন তত্ত্ব, নীতিমালা বা প্রস্তবনামূলক যুক্তি দিতে হলে আপনাকে অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা ভেবেই তা দিতে হবে; একজন বা দুজন মানুষের ব্যতিক্রমী বা অনন্য গুণ যা সমাজের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষকে রিপ্রেজেন্ট বা প্রতিনিধিত্ব করে না বা অন্যদের সাথে মিলেনা তাদের উপর ভিত্তি করে সমাজের সকল মানুষের জন্য কোন তত্ত্ব বা কবিতা হয় না। এই খানেই আমি কবিতার সাথে দর্শনের একটি মিল পাই। আর তা হল উভয়েই তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে লড়াই চালিয়ে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক/সাধারন সত্যকে বের করে আনতে চায়।
প্রশ্ন আসে, একজন লেখক বা দার্শনিকের সাথে একজন সাধারণ মানুষের তফাৎটা কোথায়? আমাদের আশে-পাশে যা কিছু ঘটে একজন কবি বা দার্শনিক সে সমস্ত ঘটনার যে ব্যাখ্যা দাঁড় করায়, জবাব দেয়, ছন্দায়িত করে, যুক্তির বাক্সে বন্দী করে এবং এসবকে নাটকীয়ভাবে সহজ ও সরলায়িত করে আমদের সামনে উপস্থাপন করে তা একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আরেকটি বাস্তব প্রশ্নের সম্মুখীন হলে বিষয়টি বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে। তা হল: নবী/রাসুলদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা কোথায়? এখানে আমরা পার্থক্যের বিষয়টাকে এড়িয়ে গিয়ে সাদৃশ্যের কথা বলব। আর তা হল: নবী/ রাসুলদের সাথে আমাদের অনেক মিল আছে কিন্তু মিলের পরিবর্তে আমরা শুধু অমিলগুলোই দেখি; বিপত্তিটা এখানেই। মিলগুলো দেখার আগে আসুন আমরা একটু জেনে নিই যে নবী রাসূলরা কোনভাবে দার্শনিক ছিলেন কিনা।
দর্শনের সংজ্ঞার ‘বাস্তব জগৎ’ (the real world) এবং আমাদের ‘অস্তিত্ব’ (existence) পৃথিবীর অধিকাংশ বড় বড় দার্শনিক/দর্শনের মূল শব্দ (key words) যা নিয়ে তাঁরা তাঁদের দর্শন দাড় করেছেন। দর্শনে এর পরে যে বিষয়গুলো আসে তা হল, আত্মা বা মনের অস্তিত্ব। আপনি নবী রাসুলদের জীবনী ও তাঁদের উপর নাজিলকৃত কিতাব পড়লে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাবেন তাঁদের প্রত্যেকেরই মিশনই ছিল এই বাস্তব জগৎ, আমাদের অস্তিত্ব এবং আত্মার সাথে মহান রবের সম্পর্ক নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা এবং সকল সন্দেহের অবসান করা। এবং এসবই হয়েছে নাটক বা সিনেমার মত ঘটনার মাধ্যমে যেখানে ছিল ১০০% বাস্তব প্লট, চরিত্র, সেটিং, ডায়ালগ, কনফ্লিক্ট, লজিক, বিশ্লেষণ ইত্যাদি। আপনি দেখবেন নবী রাসূলরা বিভিন্ন ফ্যাসিস্টদের কাছে যাচ্ছেন এবং কিভাবে তাঁদের সাথে এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা এবং যুক্তি আদান প্রদান করছেন।
প্রত্যেক নবীই মানুষকে তাঁদের আদল বা কান্ড-জ্ঞানের ব্যবহার, তাঁদের চিন্তা, ক্ষমতা এবং সুবিচারের নীতিমালা এবং সীমানা বলে দিতেন। তাঁরা সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং জীবনাচারের কথা বলতেন যার মাধ্যমে মানুষ ইহকালীন এবং পরকালীন মুক্তি পেতে পারে। এগুলো করার আগে তাঁরা চিন্তা করতেন, রাতের অন্ধকারে মহান রবের সামনে দাড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাঁদতেন, সাহায্য চাইতেন এবং যুক্তি পেশ করার সময় সর্বোচ্চ হিকমা বা প্রজ্ঞা ব্যবহার করতেন। এই যদি হয় নবী-রাসুলদের কাজ তাহলে তাঁদের থেকে বড় এবং খাঁটি দার্শনিক আর কে আছে? মেটাফিজিক্স যা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরের এক সত্তা (being) নিয়ে কাজ করে এবং যার মধ্যে আছে গড, আত্মা, মন ইত্যাদি। এর মধ্যে আছে আরও কিছু প্রশ্ন যেমন: আমরা কোথায় থেকে এসেছি; কোথায় যাব; কোন কিছু কেন হয়; কোথায় হয়; কিভাবে হয় ইত্যাদি। প্রত্যেকটা প্রফেটই এইসব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন এবং এসব নিয়ে ভেবেছেন। ওয়েস্টার্ন ফিলসফাররা এইসব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমাদের এক সংশয় এবং সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে কোন ফিলসফারেরই সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর নেই। আশ্চর্যজনকভাবে এ ব্যাপারে প্রত্যেক প্রফেটই সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট জবাব দিয়েছেন।
আচ্ছা এবার বলেন, একজন লেখক বা কবির কাজ কি? অবশ্যই জীবনকে কঠিন না করা। তিনি যে গল্প বা ফিকশন লিখছেন সেটা কি জীবনকে অনুসরণ করছে (‘fiction’ copies life) নাকি জীবনই গল্পকে অনুসরণ করছে (‘life’ copies fiction)? আমাদের ‘জীবন‘ যদি ‘গল্পকে‘ অনুসরণ বা নকল করে তাহলে তা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই জীবনকে হেল বা জাহান্নামে রূপান্তরিত করে। আমরা এমন উদাহরণ প্রচুর দিতে পারব যে অনেক লেখক এবং কবিরা তাঁদের টেক্সট বা সাহিত্যিক কাজের মাধ্যমে মানুষের জীবনকে চরম দুর্বিষহ করে তুলেছেন। এ ধরণের সাহিত্যকর্ম একটি জেনারেশন বা জাতিকে বদলিয়ে ফেলতে পারে; বিভ্রান্ত করতে পারে; এমনকি আপনার ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে আপনার কাছেই মূল্যহীন অথবা বদলিয়ে দিতে পারে। উদাহরণ দেওয়া যাক।
বিশ্ববিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক গ্যাতে (Goethe) তাঁর The Sorrow of Young Werther প্রকাশ করেন ১৭৭৪ সালে এবং এই বইটি প্রকাশের পরই ইউরোপের তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যা করা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয় এবং এটা করা হত এই উপন্যাসের নামাঙ্কিত নায়কের আত্মহত্যার আদলে (Bennet A, Royle N, Introduction to Literature, Criticism and Theory, Pearson Education, India, 2009)। একইভাবে জে ডি সেলিংগার (J. D. Salinger) এর উপন্যাস ‘The Cather in the Rye’ (1951) আমেরিকাতে ১৯৫০ এর দশকের শেষ এবং ১৯৬০ এর প্রথম দিকে প্রচুর তরুণদের সমাজ বিরোধী ব্যবহারের (anti-social behaviour) কারণ হয়ে দাড়ায়। এর কারণ ছিল এই উপন্যাসের নায়ক Holden Caufield যে ছিল অতৃপ্ত এবং অসুখী (প্রাগুপ্ত)।
একজন কবি বা লেখকের কাজ কি পাঠক তৈরি করা নাকি পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী লেখা? আমাদের দেশের অনেক কবি তাই লিখেন পাঠক যা চান; অনেকটা ইন্ডিয়ান সিনেমার রোমান্টিক প্লটের মত। ছোট বড় অনেক লেখক/কবির বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ আছে। সারা দুনিয়াতে তো বটেই; আমাদের দেশের কবি লেখকরাও গত এক শতাব্দীতে সংসার ভাংতে এবং জীবনকে জটিল করতে কম ভুমিকা পালন করেননি। তাঁদের লেখা পড়ে গত একটি শতাব্দী ধরে আমাদের ‘জীবন কেবলমাত্র বানানো গল্পকে নকল করেছে’ (‘life copies fiction’) যার ফল হয়েছে সত্যের বিপরীতে তাঁর ছায়া বা মিথ্যাকে দাড় করানো। বড় বড় সাহিত্যিক এবং কবিরা তাঁদের বিখ্যাত উপন্যাসের নায়ক নায়িকাদেরকে বিয়ের আগেই প্রেমে মজিয়েছেন, বিয়ে-পূর্ব প্রেমকে মহিমান্বিত (glorify) করেছেন এবং এই সম্পর্ককে এমন এক মিথ্যা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে তরুণ তরুণীরা তাঁদের বই এবং কবিতা পড়ে বিবাহ-পূর্ব এই সম্পর্ককে পবিত্র এবং অত্যাবশ্যকীয় করণীয় বলে ধরে নিয়েছে। তাঁরা বিয়ের পরের বাস্তবতার উপর খুব কমই লিখেছেন; ফলে জীবনের আসল বাস্তব বা সত্যটা তাঁরা আবিষ্কার করতে পারেননি এবং বিয়ের মত একটি পবিত্র ধারণা এবং সামাজিক বন্ধনকে অনেকটাই ভেঙ্গে দিয়েছেন। আর গান এবং সুর থেকে শুরু করে অন্যদের উপন্যাসের অনেক ঘটনা এবং চরিত্রের হুবহু নকল এবং সেগুলো বিকৃতি করার অভিযোগ তো আছেই। এসব চৌর্যবৃত্তির ফলে সাহিত্যের পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে; জীবনের অপচ্ছবি চিত্রিত হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে এখন খুব বড় মাপের কোন কবি বা লেখক চাইলেই আর পাঠক তৈরি করতে পারছেন না; বরং নতুন প্রজন্মকেও ঔ কবি মহাকবি এবং লেখকদেরই অনুসরণ করতে হচ্ছে। এই জন্য শুধু পাঠক হলেই চলে না; সচেতন এবং সমালোচনামূলক পাঠক হওয়া চাই।
একজন কবি বা উপন্যাস লেখককে কি সমাজের ফ্যাসিস্ট ধারণার সাথে লড়াই করতে হয়? অবশ্যই। শুধু লিখতেই হয় না অনেক সময় ফ্যাসিস্টদের সাথে লড়াই করে জেলেও যেতে হয়; অনেককে মরতেও হয়। তিনি অনেক সময় সরাসরি লড়াই করতে না পারলেও মিথ্যা, দুর্নীতি, একনায়কতান্ত্রিকতা, জুলুম এবং অন্যায়-অবিচারকে চরিত্রায়ন করেন। সমাজ, পরিবার, জীবন, সম্পর্ক, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, জীবনের লক্ষ্য ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁর একটা আলাদা বা বিশেষ চিন্তা থাকে এবং সে ভিন্ন রূপে আমাদের পরিচিত বিষয় গুলোকে অপরিচিত এবং অপরিচিত বিষয় গুলোকে পরিচিতভাবে নাটকীয়তার সাথে আমাদের সামনে তুলে ধরেন। কখনও কল্পনা, কখনও একটি মাত্র জীবন আবার কখনও অনেক জীবন থেকে ভিন্ন ঘটনার সমন্বয়ে তিনি গড়ে তুলেন জীবনের এক নতুন ধারণা যাকে মনে হয় আমাদের অনেক দিনের চেনা। এই সূত্রে কবি ও লেখক অবশ্যই দার্শনিক।
দার্শনিকরা যেহেতু জগৎ, অস্তিত্ব, আত্মা এবং প্রকৃতির মত বিষয় নিয়ে কাজ করেন সেহেতু তাঁদের কাজে কল্পনার স্পেস বা জায়গা খুবই কম। এখন, দর্শন কি ফ্যাসিস্ট হতে পারে? অবশ্যই। ব্যাক্তি কর্তৃক আবিষ্কৃত যে কোন দর্শনই ফ্যাসিজম যদি সে মনে করে যে সে ই শ্রেষ্ঠ এবং সে ছাড়া আর সবগুলো অচল। সেই সূত্রে স্বয়ং পোস্ট-মডার্নিজম একটি ফ্যাসিস্ট আইডিয়া বা দর্শন। কেন? দেখুন, পোস্ট-মডার্নিজম মনে করে যে মেটা ন্যারেটিভ বলে কিছু নেই। তাহলে তো স্বয়ং পোস্ট-মডার্নিজমও মেটা ন্যারেটিভের মধ্যে পড়ে না, কারণ তার দাবি অনুযায়ী সে নিজেও মেটা ন্যারেটিভ নয়। আর যদি তাই হয় তাহলে তো তাকে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। ব্যাপারটা এই রকম যে আপনি বলছেন: পৃথিবীতে কেউ এককভাবে শ্রেষ্ঠ না, সবাই সমান। যদি তাই হয় তাহলে তো আপনিও সবার সাথেই পড়েন এবং এই কথা বলে আপনি নিজেকে এককভাবে শ্রেষ্ঠ দাবি করতে পারেন না। পোস্ট-মডার্নিজমকে এই জন্যই আমার ফ্যাসিস্ট আইডিয়া মনে হয় যে সে নিজে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসে অন্য সব আইডিয়াকে এককভাবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি থেকে খারিজ করে দেয়। কেউ সবার থেকে শ্রেষ্ঠ না হলে তো অন্যদেরকে এভাবে খারিজ করে দিতে পারে না। পারে কি? তাহলে এই অথরিটি সে কোথা থেকে পেল, বা কে-ই বা তাকে দিল? সে কি সবার গড?
পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যারা একটি নির্দিষ্ট ফিলসফি বা দর্শনের উপর দাঁড়িয়ে আছে; আবার অনেক দেশ তাদের অতীত দর্শনের উপর থেকে ছিটকে পড়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। যেমন ইউরোপের অনেক দেশ সেক্যুলারিজম এর উপর দাড়িয়ে আছে কিন্তু রাশিয়া কম্যুনিজমের উপর টিকে থাকতে পারে নাই। এসব দর্শন কোন কোন ক্ষেত্রে জুলুমের হাতিয়ার হয় যার বিরুদ্ধে মানুষ ফুসে উঠে। কিন্তু পাশাপাশি আমরা এটাও দেখেছি যে একটা দর্শন কিভাবে আর একটা দর্শনের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফ্রান্স এবং পরে ইউরোপের অনেক দেশে অর্থোডক্স খ্রিশ্চিয়ানিটির সাথে সেক্যুলারিজম; আমেরিকান পুঁজিবাদের সাথে রাশিয়ান সমাজতন্ত্র এবং তারও আগে রাশিয়াতে সমাজতন্ত্রের সাথে স্বৈরতন্ত্রের সংঘাত – এমন অনেক সংঘর্ষ আমরা দেখতে পাই। একসময় সেক্যুলারিজম অর্থোডক্স খ্রিশ্চিয়ানিটিকে ফ্যাসিস্ট মনে করত; আমেরিকান পুঁজিবাদের কাছে রাশিয়ান কম্যুনিজম ছিল ফ্যাসিস্ট। অনেকের কাছে আবার পুঁজিবাদ এবং সেক্যুলারিজম হল ফ্যাসিস্ট আইডিয়া। মূলতঃ যারাই অপদর্শন ধারণ করে তারাই ফ্যাসিস্ট।
ফ্যাসিস্টের আদি, জীবন্ত এবং বাস্তব রূপ দেখতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই নবী রাসুলদের কাছে যেতে হবে। কিন্তু সেটা কেন এবং কিভাবে?
[প্রথম প্রকাশিতঃ আমার দেশ পত্রিকা: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪]