১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর ৫৩/৫৪ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু জাতি হিসাবে অভাবনীয় সম্ভাবনা থাকা সত্বেও আজ পর্যন্ত আমাদের ভাগ্যের তেমন কোনই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। বরং দিন দিন আমাদের অভাব, অনটন, নিম্নমানের শিক্ষা, দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য খাত, ক্ষমতা ও অর্থ-নির্ভর আইনি কাঠামো, নিরাপত্তাহীনতা, গড় দারিদ্রতা, এবং দুঃখ দুর্দশা বেড়েই চলেছ । দেশের এই দুর্নিতি এবং চরম অব্যবস্থাপনার ফলে যারা সবচেয়ে আক্রান্ত, নির্যাতিত এবং কষ্টের শিকার হয়ে আসছে তাঁরা হল এই দেশের নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত সাধারণ বনি-আদমঃ নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ । পরিস্থিতি এমন যে জনতা মনে করে পরের সরকার আগের থেকে ভাল হবে কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে আগের সরকারই বর্তমান সরকার থেকে ভাল ছিল। (একমাত্র শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত শাসনকাল ব্যাতিত) স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত নিরাপত্তা এবং জীবন-যাত্রার মানের অবনতিই হচ্ছে, দুর্ভোগের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এর জন্য এককভাবে কোন রাজনৈতিক দলকে দায়ী করা যায় না; হয়তবা এই দায় কারও বেশী এবং কারও কম। কিন্তু আমাদের এই ১২,৭৫৬ কিলোমিটার ব্যাসের উপগোলক –পৃথিবী নামক গ্রহটির অনান্য দেশের অবস্থাও কি একই রকম? আসুন খুব ছোট্ট করে একটা কেইস স্টাডি করে নিই (কেইস স্টাডি হলো প্রতিনিধিত্বমূলক একক ঘটনার আলোকে গভীর বিশ্লেষণ বা গবেষণা) ।
সিংগাপুরের সাথে বাংলাদেশের অনেক মিল আছে। এই দেশটি বাংলাদেশের মতই একসময় ব্রিটিশদের কলোনি ছিল এবং আমরা যেমন পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসেছি সিংগাপুরও তেমনিই ব্রিটিশদের থেকে আলাদা হবার পর আবার মালয়েশিয়া থেকে বেরিয়ে এসেছে (যদিও তাঁরা আসলেই বেরিয়ে এসেছে না তাঁদেরকে বের করে দেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে মতভেদ আছে)। সিংগাপুর ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হবার পরে গণতন্ত্রাতিক ধারা থেকে কক্ষনই বিচ্ছিন্ন হয়নি। সিংগাপুরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করে সাত হাজার আটশ (৭৮০০) জন নাগরিক আর আমাদের দেশে ঠিক ঔ প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে সর্বোচ্চ তেরশ (১৩০০) জন নাগরিক। কিন্তু আপনি কি জানেন সিংগাপুরের একজন নাগরিকের মাথাপিছু বার্ষিক আয় কত? এটা হল: প্রায় ১ লক্ষ ডলার (৯৫,৬০০ ডলার) যেখানে বাংলাদেশে জন প্রতি মাথাপিছু আয়: প্রায় ৩ হাজার ডলার (২,৭৮৪ ডলার) । আর চাকুরী, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, নাগরিক নিরাপত্তা ও সুবিধা–এগুলোর ক্ষেত্রে আমরা সিংগাপুরের ১০০ ভাগের ৫ভাগের কাছেও নাই? অথচ স্বাধীনতার শুরু থেকেই সিংগাপুরের তুলনায় জনবল, উর্বরতা এবং ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে আমাদের দেশ অনেক বেশী শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ । এ রকম একটি সম্ভাবনাময় দেশকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে কারা? বলতে পারেন দেশের এই অভুতপুর্ব সম্ভাবনাকে বার বার ধ্বংস এবং ধুলিস্যাত করছে কোন ডাকাতের দল? জানতে ইচ্ছে হয়ঃ অপরিপক্ব, ক্ষমতালোভী, অটোক্র্যাটিক, স্বার্থপর, অদূরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং নিজ জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা এই রকম একটি অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কি কোন সম্ভবনা বা পথ নেই?
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যেকেই কম বেশী সরকারের আসনে বসে অথবা ক্ষমতার বিশেষ চর্চার (unique exercise of power) মাধ্যমে দেশ শাসন এবং দেশের মধ্যে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পেয়েছে । আওয়ামীলীগ দেশ শাসন করেছে প্রায় ২৬ বছর (১৯৭১,১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪,২০১৮, ২০২৪), বিএনপি করেছে প্রায় ১৬ বছর (১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১), জাতীয় পার্টি এককভাবে শাসন করেছে ৯ বছর আর আওয়ামীলীগ কর্তৃক গঠিত মন্ত্রী সভায় যোগ দিয়ে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে শাসন করেছে আরও ১০ বছর (১৯৯৬, ২০১৪); সব মিলিয়ে ১৯ বছর। ২০০৬-২০০৮ পর্যন্ত কেয়ারটেকার সরকারের নামে আর্মিদের মাইনাস-টু ফর্মুলার বিশৃঙ্খল এবং নীচু মানের শাসনও আমরা দেখেছি।
বামপন্থী সুবিধাবাদী সেক্যুলার চাটার দলের কথা আর নাইবা বললাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা আর সেক্যুলারিজম এর নামে সংখ্যালঘু এই রাজনৈতিক টাউটরা এমন কোন সরকার নেই যাদের কাছে সুবিধা নেয়নি এবং তাদেরকে বিভ্রান্ত করেনি। বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের গাছ লাগিয়েছে আওয়ামীলীগ, লালন-পালন করেছেও তারা – আর এরই ফল বাকশাল, একদলীয় শাসন এবং গত ১৬ বছরের ফ্যাসিজম। আর এটা আমদানি করা হয়েছে ইন্ডিয়া থেকে। ভবিষ্যতেও যারাই এই গাছ লাগাবে এবং এর চর্চা করবে বা বর্তমানে করছে – সে যেই হোক ফ্যাসিজম ছাড়া এ জাতিকে আর কিছুই দিতে পারবে না। আমাদের একটা কথা বুঝতে হবে যে সেক্যুলারিজম আর ফ্যাসিজম অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। এটা আমাদের মত দেশের জন্য এক কঠিন বাস্তবতা। ইন্ডিয়ার সেক্যুলারিজমের দিকে তাকান। বিজেপি এবং কংগ্রেস জাতি-স্বার্থে একটা আরেকটার অল্টার ইগো বা প্রতিচ্ছবি অথচ সেক্যুলারিজমের কথা বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে। তারা চায় আমরা তাদের চেয়েও খারাপ সেক্যুলার হয় যেখানে একজন আরেকজনকে খুন করব, ধর্ষণ করব এবং স্লেভ বা গোলাম-বাঁদি করে রাখব। বাংলাদেশে সেক্যুলারভিত্তিক দলগুলো যতবার ক্ষমতায় এসেছে ততবারই এদেশে ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পৃথিবীতে এমন একটা সেক্যুলার দেশ দেখাতে পারবেন না যারা রেসিস্ট না। আর বাংলাদেশে আপনি কি আমাকে এমন একটা সেক্যুলার নেতা দেখাতে পারবেন যে ফ্যাসিস্ট অথবা রেসিস্ট না এবং বিশেষ করে ইসলামের প্রতি এদের বিদ্বেষ বা ঘৃণা নেই? যারা ইন্ডিয়াকে দেশের শত্রু মনে করবে আবার একই সাথে সেক্যুলারিজম ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা চাইবে তারা আজ হোক কাল হোক ইন্ডিয়ার গোলামে পরিণত হবেই হবে। আওয়ামীলীগই এই দেশে সন্ত্রাস এবং অসৎ রাজনীতির বীজ লাগিয়েছে। মূলতঃ সেক্যুলারিজম এর উপর ভর করেই আওয়ামীলীগ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যবসা করেছে এবং দেশের সমাজ, অর্থনিতি, রাজনীতি এবং নৈতিকতার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। আওয়ামীলীগের পুনর্বাসন মানেই হলো আরও ভয়ংকরভাবে রক্তপিপাসু ফ্রাংকেনস্টাইন দৈত্যের ফিরে আসা যে তার নিজের মালিককেই নির্মমভাবে খুন করতে দ্বিধা করে না।
জামায়াত ইসলামী এককভাবে কখনই ক্ষমতায় আসেনি; মাত্র একবার ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে বিএনপির সাথে (২০০১)। কিন্তু ক্ষমতায় না আসলেও প্রত্যেকটা সরকারের সময়েই (১৯৮৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত) তাঁরা ক্ষমতার বিরল চর্চা করেছে যা বাংলাদেশের অন্য কোন রাজনৈতিক দল করেনি। আপনি এমন একটা ব্যাংক দেখাতে পারবেন না যেটা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামীলীগের বা বিএনপির। হয়ত তাদের কোন এক নেতা বা নেতারা একটি ব্যাংকের ডাইরেক্টর বা মালিক ছিল; কিন্তু জামায়াতে ইসলামিই বাংলাদেশে সম্ভবত একমাত্র সংগঠন রাজনৈতিকভাবে যাদের ব্যাংক ছিল। যদিও এটা কাগজে কলমে নেই কিন্তু একথা কারোই অজানা নেই যে সারা দেশের জেলা, উপজেলা এবং পৌর এলাকায় ছড়িয়ে থাকা শত শত ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী মেডিক্যাল সেন্টার/কলেজ এবং ইবনে সিনার মত প্রতিষ্ঠানগুলো জামায়াতে ইসলামীর লোকজনেরাই পরিচালনা করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন পার্টি — আওয়ামীলীগ অথবা বিএনপি ততদিন কিছুই বলেননি যতদিন জামায়াতকে তাদের প্রয়োজন হয়েছে। দেখুন, যখনই আওয়ামীলীগ এর কাছে জামায়াতের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গিয়েছে তখনই তারা জামায়াতের লোকজন নিয়ন্ত্রিত ইসলামী ব্যাংককে ধ্বংস করার জন্য গিলে ফেলেছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিদায় নিয়েছে এবং জামায়াত ক্ষমতার ইউনিক এক্সারসাইজ আবার শুরু করেছে। এরূপ ব্যাংক একটি বড় উদ্যোগ যার মাধ্যমে গ্র্যাজুয়েশন করা দেশের সকল মতের মেধাবী তরুণদের কর্মসংস্থান হবার কথা ; কিন্তু প্রশ্ন হল সারা দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের বিনিয়োগকৃত এই প্রতিষ্ঠানে দেশের আপামর জনতার চাকুরী এবং লেন-দেনের অধিকার সংরক্ষিত হচ্ছে কিনা, এটা কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের বা তাদের গুটিকয়েক ব্যাক্তিকে সুবিধা দিচ্ছে কিনা । উপরন্ত, মুষ্টিমেয় কিছু লোক বা কোন দলকে পুঁজিবাদী করে তুলছে কিনা এবং সর্বোপরি এখানে জাস্টিস বা সুবিচার হয় কিনা।
যেহেতু সরকার গঠনের জন্য আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি উভয়কেই জামাতের সমর্থন নিতে হয়েছে, সেহেতু এই দীর্ঘ সময়ে জামাত তাঁদের পরিচালিত ব্যাংক, মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশন এর মত অনেক প্রতিষ্ঠানে (কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া) বিনা বাধায় এককভাবে তাঁদের লোকজনকে নিয়োগ দিয়েছে। তারা সবার জন্য দরখাস্ত ওপেন করে দিয়েছে কিন্তু ফাইনাল নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যদের জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়ে (লোক দেখানো কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া) শুধুমাত্র নিজেদের মতাদর্শের লোকজনকে চাকুরী দিয়েছে। এবং এক্ষেত্রে কোন সরকারই বৈষম্যের প্রশ্ন তুলেনি বা তুলতে পারেনি। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে ছাত্রলীগ ছাড়া ছাত্রদল বা শিবির ব্যাকগ্রাউন্ডের কেউ যতই মেধাবী হোক না কেন কারোই সরকারী চাকুরী হয় না, বিএনপি ক্ষমতায় আসলে ছাত্রদল ছাড়া ছাত্রলীগ বা শিবির ব্যাকগ্রাউন্ডের কোন মেধাবীদেরই ভাগ্য খোলে না। জামায়াত ক্ষমতায় না থেকেও তাদের জনবল দ্বারা চলা জাতীয় মানের শত শত প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবির ছাড়া ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের কোন ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরই চাকুরী হয় না। এগুলো সবই বৈষম্য কিনা?
রাষ্ট্র স্বীকৃত এবং অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে চাকুরির ক্ষেত্রে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে দল-মত-বর্ন ভেদে মেধার ভিত্তিতে সকল নাগরিকের চাকুরী পাবার অধিকার আছে কিনা? যদি না থাকে তবে, এটা বৈষম্য কিনা এবং এ বৈষম্য দূরীকরণে রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা আছে কি না? জামায়াতের গত ২০ বছরের (১৯৮৫-২০০৮) নিয়োগ পদ্ধতির উপর সার্ভে রিসার্চ করলেই আসল সত্য বেরিয়ে আসবে। যা বলার তা হল জামায়াত অন্যদের মতই ক্ষমতার চর্চা করেছ ক্ষমতার মসনদে না বসেই এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থেকে এইরকম ইউনিক চর্চা কোন রাজনৈতিক দলই করতে পারেনি।
সমাজে অসমতা নিরসনে, দেশে বৈষম্য দূরীকরণের ধারণা দিতে এবং তরুণদের মধ্যে তাদের গ্রহণ যোগ্যতা বৃদ্ধিতে জামায়াতের জন্য এটা ছিল এক বিরাট সুযোগ; কিন্তু জামায়াত কি সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পেরেছে? ইসলামী নামের প্রতিষ্ঠানে যদি অন্যদের মতই বৈষম্য হয় তবে এখানে ইসলাম থাকে কিনা এবং এই ধারণাকে তরুণ সমাজ গ্রহণ করবে কিনা । জামায়াতের অসম্ভব রকম সম্ভবনা আছে কিন্তু ইসলাম এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠানকে বাক্সবন্দী না করে কাজের মাধ্যমে এটা প্রমাণ করতে হবে যে তারা বৈষম্য বিরোধী এবং সমানভাবে সবার অধিকারকে রক্ষা করে। জামায়াতের নতুন তরুণ নেতৃত্ব কি এই সত্যকে গ্রহণ করবে? বাংলাদেশের ছোট বড় সব ইসলামী দলগুলোই মোটামটি এই রোগে আক্রান্ত। ইনসাফ ব্যাতিত যত ঐক্যই হোক না কেন খুব বেশী দিন তা টিকবে বলে মনে হয় না।
জিয়াউর রহমান হলেন বাংলাদেশের এক কিংবদন্তী যিনি মেরিটোক্রাসিতে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু সেই বি এন পি আর এখন নেই। বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন এমন শুনেছি যে বিএনপির মধ্যে একজনই বিএনপি করেন তিনি হলেন বেগম খালেদা জিয়া। অনেকেই বলেন যে এই পার্টির ৫০% এরও বেশী টপ নেতারা শুধু ভারতের দালালই নয়, রীতিমত চর এবং পেইড-এজেন্ট । আর সেই কারণেই সাধারণ মানুষের সমর্থন-ভরা এই দলটি ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে কোন কার্যকরি আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারেনি। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হল জাতীয়তাবাদী এই দলটির মহাসচিব পর্যায়ের নেতারা ফ্যাসিস্টের পুনর্বাসনের দায়ীত্ব জনগণের উপর ছেড়ে দিয়েছে । যে জনগণের উপর আপনাদের এত ভরসা এবং যাদের মাইন্ডসেট আপনারা এত বুঝেন, সেই জনগন কি গত ১৭ বছরে একটি বার আপনাদের ডাকে সাড়া দিয়েছে? আওয়ামী জাহেলিয়াত যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বের নামে সাগর চুরি আর ফ্যাসিজম কায়েম করেছে ঠিক একই ভাবে বি এন পিও যেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের ভালবাসা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠা করতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সম্ভাবনাময় এই দলটিকে ভারতীয় চরমুক্ত করতে না পারলে তা অচিরেই আর একটি ফ্যাসিস্ট শক্তিতে রূপান্তরিত হবে। কিন্তু বি এন পি কি এই রিস্ক নিবে? তাদের কি সেই স্ট্রেন্থ বা শক্তি আছে?
ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি আওয়ামীলীগের পথেই হাঁটছে। ৭০ দশকের শুরু/মাঝামাঝি পর্যন্ত আওয়ামীলীগ কক্ষনই একটি সেক্যুলার রাজনৈতিক দল ছিল না। সে সেক্যুলার রূপ গ্রহণ করে ৭০ দশকের শেষ দিকে আর ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে — মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সে তার মুসলিম চরিত্রটি পুরোটাই হারিয়ে ফেলে। আর সবার শেষে সে রূপান্তরিত হয় এক দানবীয় ফ্যাসিস্টে । আধুনিক বাংলাদেশের অন্যতম স্থপতি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরে, এমনকি কিঞ্চিৎ রক্ষণশীল এবং ডানপন্থী বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম টার্মের পর থেকে এই দলটিতে ক্রমবর্ধমানভাবে সেক্যুলারিস্টদের প্রভাব বেড়েই চলেছে এবং অনেকের ধারণা সে সময় খুব বেশী দূরে নয় যখন (মুসলিম আওয়ামীলীগ বা পরে) আওয়ামীলীগের মতই এরাও একসময় সেক্যুলার একটা খোঁয়াড়ে পরিণত হবে। এক্ষেত্রে ৯০% সম্ভবনা হলো তারা ভারতে যে সেক্যুলারিজম বহাল আছে, সেক্যুলারিজমের সেই ফ্যাসিস্ট আইডিয়াটাই ধারণ করবে । মনে রাখতে হবে যে ভারতে যখন যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন বাংলাদেশের প্রতি তাদের নিরাপত্তা, কুটনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় নীতির কোন পরিবর্তন হবে না। তারা খুব ভাল করেই জানে ছলে, বলে এবং কৌশলে বাংলাদেশের কোন শ্রেণীর নেতাদের সহজেই কেনা যায় যার প্র্যকটিস তারা গত ৬০ বছর ধরে সফলতার সাথে করে আসছে। বিএনপি যে ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগের মতই হবে তার আরও একটি সম্ভবনা হলো এই দলটির না আছে কোন সুস্পষ্ট কালচারাল বা সাংস্কৃতিক স্ট্যান্ডার্ড বা ধারণা যা সেক্যুলারিজমের সাথে তাদের সম্পর্ককে পরিষ্কার করে আর না আছে আদর্শগতভাবে সেক্যুলারিজমের ব্যাপারে কোন স্পষ্ট অবস্থান । বিপুল সাধারন-মানুষের ভালবাসা এবং সমর্থন নির্ভর এই দলটি সুনির্দিস্টভাবে এ ব্যাপারে কিছু ভাবছে কিনা তা আমরা জানিনা।
সেক্যুলারিস্ট আওয়ামী ফ্যাসিস্ট এবং তার সহযোগী ইনু-মেননদের মত জঙ্গি সেক্যুলাররা বাংলাদেশের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছে একের পর এক। নিরীহ বিহারীদের গণহারে হত্যা ও ধর্ষণ করা, বাকশাল প্রতিষ্ঠা, লুটপাটের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ আনা, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড, দেশকে ভারতের কাছে ইজারা দেওয়া, গনতন্ত্র হত্যা, ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠা করা, ফ্যাসিস্ট কায়দায় জামায়াত নেতাদের বিচারের নামে হত্যা করা, শাপলা চত্বরে ব্ল্যাক-আউট করে নিরীহ মানুষকে রাতের অন্ধকারে হত্যা করা, ৫৭জন দেশপ্রেমিক অফিসারকে খুন করা, পুকুর চুরি করে দেশের টাকা বিদেশে পাচার-এত কিছুর পরও কিছু নেতারা বলেন যে ফ্যাসিস্টকে আবার নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে বিচারের আগেই এবং তাদের বিচারের ভার আইন এবং জনগণের উপর ছেড়ে দিতে হবে। তার মানে কি এই যে আইন এবং জনগন যদি ফ্যাসিস্টকে পুনর্বহাল করার জন্য রায় দেয় তাহলে আপনি তাকে ওয়েলকাম করবেন? ধর্ষক, গুণ্ডা, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা এবং লুণ্ঠনকারী ক্রিমিনালদের বিচার আগে নাকি তাদের বিচারকে একপাশে সরিয়ে রেখে জন্য নির্বাচন আগে?
পৃথিবীতে কোন ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসক এবং তার দোসরদের বিচারের আগে নির্বাচন হয়েছে এমনটা দেখাতে পারবেন? জার্মানী অথবা ইতালি? ইতালিতে তো ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি এবং তার সহযোগী মন্ত্রিদের লাশ লোকজনকে দেখানোর জন্য উৎসব মুখর পরিবেশে মিলান শহরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। ফ্যাসিস্টের ১৫০০০ সহযোগীকে নির্বাসন অথবা মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল এবং নারী কলাবরেটর বা সহযোগীদের মাথা ন্যাড়া করে শহরের বড় বড় রাস্তায় ঘুরানো হয়েছিল। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিনঃ একজন ফ্যাসিস্ট খুনির বিচার আগে হয় নাকি তার পুনর্বাসন আগে হয়? আপনারা যদি পুনর্বাসনই আগে চান, তাহলে আপনাদের নেতা হবার দরকার কি? নতুন বাংলাদেশে কি এই ধরণের মেরুদণ্ডহীন, ফ্যাসিস্ট-বান্ধব নেতার দরকার আছে?
কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। এদেশে কিসের সংখ্যা বাড়েনি? আমাদের এখানে তুরাগের তীরে সারা দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সম্মেলন হয়। দিন দিন মুসল্লির সংখ্যা বেড়েই চলেছে কিন্তু দেশের উন্নয়নে কি ভূমিকা আছে আমাদের এই ভাইদের? উম্মাহর একতা যদি উম্মাহকে খারাপি এবং দুর্নিতি দমনে সহয়তা না করে তাহলে এই একতার ধারণা দিয়ে আমাদের লাভটা কি? এই যে রাজনৈতিক দলগুলো ১৫/২০/২৬ বছর ধরে ক্ষমতার চর্চা করল, আমাদের রাষ্ট্র পেয়েছেটা কি? এদেশে তো দুর্নিতি, খুন, গুম, ধর্ষণ, অবিচার, জুলুম, হয়রানি, সুদ, ঘুষ, যেনা, ব্যাভিচার, মিথ্যাচার, আত্মীয়করণ, দলীয়করণ – বেড়েই চলেছে। মানুষের চরিত্রের কি তেমন কোন পরিবর্তন করতে পেরেছে আমাদের সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও গুলো? কোন একটি প্রতিষ্ঠান দেখাতে পারবেন যেখানে এদেশের সাধারণ মানুষের প্রতি জাস্টিস বা সুবিচার হয়? তাহলে আমাদের এত এত রাজনৈতিক দল এবং ইসলামী মূল্যবোধ ও সেক্যুলার ঘরনার এনজিও গুলোর অর্জনটা কি? ধারাবাহিকভাবে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং এনজিও গুলো তাদের ব্যাক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থপরতা, অপরিপক্বতা ও দুর্বত্তায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামোকে এতটাই দুর্বল করে তুলেছে যে গত শেষ ১৬ বছরের ফ্যাসিজমের কারণে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বই একপ্রকার যায় যায় অবস্থা হয়েছিল। রাষ্ট্র বিনির্মাণে এবং একটি টেকসই ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে যে সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো পেয়েছিল তা কি তাদের যোগ্যতা বা ব্যর্থতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়? তাদেরকে কি আবারও ক্ষমতায় এনে পরীক্ষার প্রয়োজন আছে? দেশ এবং দেশের প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তাদের গতানুগতিক পদ্ধতি (Traditional way) যে উন্নয়নের অন্তরায় এটা কি আরও ব্যাখ্যা করে বলতে হবে?
তাদের লজ্জাজনক ব্যর্থতাটা একটু গভীরভাবে ভেবে দেখুন। আওয়ামী ফ্যাসিজমকে তাড়ানোর জন্য বিএনপি এবং জামাত সহ ২০ টি দল প্রথমদিকে একজোট হয়ে কম চেষ্টা করেনি। বিএনপি পরে ড. কামাল হোসেনের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে দেওলিয়া এবং চরম ব্যর্থ প্রাক্তন আওয়ামী- সেক্যুলারদের সাথে গাঁট বেঁধেছে ফ্যাসিস্টকে বিদায়ের জন্য; কিন্তু কোনই কাজ হয়নি। পরে আবার বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টির একাংশ, আরও অনেক ইসলামী এবং বামপন্থী দল এমনকি খানকার পীর সাহেবরাসহ সবাই যুগপৎ ভাবে আন্দোলন করেছে আওয়ামী ফ্যাসিস্টকে তাড়ানোর জন্য। কিন্তু রেজাল্ট কি? রেজাল্ট হল, বিরোধীরা যুগপৎ আন্দোলনে যত বড় হয় ফ্যাসিজম তত বেশী শক্তিশালী হয়। সেক্যুলার বাকশালী আওয়ামীলীগের কাছে তারা পাত্তাই পায়নি। কেন? আমরা জানি হাজার হাজার সশস্ত্র সৈন্যে ঘেরা শক্তিশালী নবাবের ট্র্যাজিক মৃত্যুর জন্য একজন মীরজাফরই যথেষ্ট।এই মীরজাফররা দিনের বেলায় উন্মুক্ত ময়দানে দেখায় তারা মুজলুমের বন্ধু আর রাতের বেলায় মিলিত হয় তাদের ফ্যাসিস্ট কর্তাদের সাথে। আমাদের এটা বুঝতে হবে যে গত পাঁচ/ছয় দশক ধরে সরকার পরিবর্তন, সমাজ উন্নয়ন এবং সুখী বাংলাদেশের জন্য একটা বিধিবদ্ধ ট্র্যাডিশন আমরা ফলো করছি এবং এই ট্র্যাডিশনাল বা গতানুগতিক পদ্ধতি বাংলাদেশে আর কাজ করবে না।
যায় হোক, অবশেষে আল্লাহ কারিম এই শিকড়-গড়া ফ্যাসিস্টকে উৎখাত করার জন্য পছন্দ করলেন একদল তরুণকে যা আমাদের স্বপ্নের মধ্যেও ছিল না। এখানে সাইন বা ইশারাটা কি? আমার ভুল হতে পারে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, ইশারাটা হল এই যে, রেজিম পরিবর্তনের জন্য আমরা ফ্যাসিস্ট বিরোধীরা কক্ষনই উপযুক্ত ছিলাম না । আর এজন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ মানবতার মুক্তির জন্য ঐ ছোট্ট একটা দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিকভাবে প্রচারবিমুখ, অকপট, মেধাবী তরুণের দলকে পছন্দ করেছেন যারা সবাকে সংগঠিত করেছে এবং শহীদি শারাব পানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্টের পতন ঘটিয়েছে।
যা বুঝতে হবে তা হলঃ এই নতুন প্রজন্ম শুধু ভারত-পালিত এবং আশ্রিত একটি কঠিন বিলজিবাব (Beelzebub — the prince of demons) ফ্যাসিস্টকেই বিদায় করেনি, তাঁরা বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির বার্তা নিয়ে এসেছে। সেটা কি? সেটা হল গত ৫৪ বছর ধরে যারা রাষ্ট্র শাসন করেছে তারা একটা ফিক্সড-মাইন্ডসেট নিয়ে আছে । কাঁচা কঞ্চিকে বাকানো যায় কিন্ত পাকা কঞ্চি বাকাতে গেলে তা ভেংগে যায়। নতুন বাংলাদেশ গড়তে পুরানো এই সব পাকা কঞ্চির আর প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রের এইসব কারিগরদের আমরা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দেখেছি; তাদের এখন বিদায় নেওয়া উচিৎ এবং নতুনভাবে আবার সবকিছু বিনির্মান করতে হবে নতুন কারিগরদের দিয়ে। তবে এই কারিগরদের খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন আবার সেক্যুলার আর ভন্ড ভাববাদীদের চকচকে চটকদার ফ্যাসিজমের গর্তে পা না দেয়। তারাই পারবে যদি তাঁরা সুবিচার করতে পারে এবং সবার অধিকারকে রক্ষা করতে পারে।
আমাদের তরুণদের একটি কথা বুঝতে হবে যে সেক্যুলারিজম একটি রোগের সাময়িক এবং ফেইক বা ভুয়া উপশম মাত্র, তা কক্ষনই স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয়; বরং দীর্ঘ মেয়াদে তা ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সার তৈরি করে যা গোটা দেহের লক্ষ লক্ষ কোষকে কলুষিত করে মেরে ফেলে। বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করার মানেই হল ধোঁকাবাজি এবং ফ্যাসিজমের রাজনীতি করা। আমাদের এ জমিনে এই প্রচেষ্টা লক্ষণ সেন থেকে শুরু করে হাসিনা – এমন কেউ ই সফল হতে পারেনি কারণ আমাদের জমিন, আবহাওয়া, লক্ষ বছর ধরে প্রবাহিত হওয়া আমাদের ধমনীর রক্ত, মন, মগজ, আত্মা কোনকিছুই সেক্যুলারিজমের সাথে যায় না। সুতরাং এই স্বপ্ন পরিহার করে যথাযথভাবে পরস্পরের হক আদায়, সবার জন্য সুবিচার এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিৎ।
তাহলে আমি কি একথা বলছি যে বাংলাদেশের এই ৫৪ বছরের রাজনৈতিক দলগুলো একেবারেই অচল হয়ে গেছে বা তাদের দ্বারা কিছুই হবে না? না, না, আমি সে কথা বলছি না। আমি বলছি যে, ইতিমধ্যেই তাদের গতানুগতিক বা ট্র্যডিশনাল রাজনৈতিক ধারা এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার পদ্ধতি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। হয়ত তারাই আবার এই বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে পারবে যদি তারা সত্যিকার অর্থে তাদের ট্র্যাডিশনকে ভাংতে ও বদলাতে পারে এবং নতুনভাবে তা নির্মান করতে পারে। কিন্তু এই আর্টিকেলটা যখন পড়ছেন তখন পর্যন্ত বাস্তবিকভাবে আপনি কি দেখেছেন যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাঁদের মেজাজ, অতি-রাজনীতি, গতানুগতিক দলীয় প্রপাগান্ডা, এবং কর্ম-কান্ডে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে? অফিস আদালত এবং মাঠ পর্যায়ে সাধারণ বনি আদমদের সাথে তাঁদের আচার-আচরনের কি কোন পরিবর্তন হয়েছে? ফ্যাসিস্ট পতনের পরেই দখল, পূনর্দখল, খুনি এবং ফ্যাসিস্ট সেক্যুলারদের প্রতি মাত্রারিক্ত নমনীয়তা, আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া, নিজেদের স্বার্থে ক্ষমা, ও জুলুমের বিচার হবার আগেই ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতায়নের মৌন সমর্থন ও পুনর্বাসন করা — এসব কিসের আলামত তা আপনারাই বিচার করেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পরিবর্তনের সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ কারণ আমাদের দেশের এই দলগুলো গত ৫৪ বছর ধরে কক্ষনই তাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কর্মীদের মাইন্ডসেট বা মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য কাজ করেন নাই। ক্ষমতায় যেতে হবে, নিজেকে এবং নিজের দলকেই সবকিছু করতে হবে এবং ‘আমরাই শ্রেষ্ঠ অন্যরা সব অধম’ এই ফিক্সড মাইন্ডসেট বা আবদ্ধ মানসিকতাই এদের সবাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আওয়ামী ফ্যাসিজম রাতারাতি আকাশ থেকে পড়েনি – এটা দীর্ঘ রাজনৈতিক অনুশীলন ও অভ্যাসের একটি পরিণতি মাত্র। ফ্যাসিস্ট পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বর্তমান তরুণ সমাজের সুবিধা হল তাদের অধিকাংশই ওপেন-মাইন্ডসেট (Open-mindset) বা উন্মুক্ত মানসিকতা ধারণ করে এবং রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট বিরোধী মোটামুটি সব রাজনৈতিক শ্রেণীকেই ইনট্রিগেইট বা একীভূত করে তাঁরা তাঁদের সেই সামর্থ্যের প্রমান দিয়েছে। হোক তাঁরা তরুণ, দেশ এবং দেশের উন্নয়ন ও সার্বভৌমত্ব তাঁদের হাতেই সবচেয়ে বেশী নিরাপদ।
যদি প্রশ্ন করি আচ্ছা এই প্রমাণিত অচল এবং ব্যার্থ গতানুগতিক ধারা বা ট্র্যাডিশনাল ওয়ে ভাঙবে কারা? উত্তরে বলব, এটা ভাঙবে বিএনপি, জামাত, আওয়ামীলীগ, হেফাজত এবং অনান্য সব ইসলামী এবং ডান-বাম পন্থী দলগুলো থেকে আসা বিপ্লবমনা, খাঁটি দেশপ্রেমিক তরুণের দল যারা যোগ দিবে সেই তরুণের দলে মূলতঃ যাদের নেতৃত্বে ভারত-আশ্রিত-সেক্যুলার ফ্যাসিস্ট উৎখাত হয়েছে। এটা কি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। ফ্যাসিস্টের পতনের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে তার প্রমান আমরা পেয়েছি। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যানারে থাকা তরুণরা ৩৬ জুলাইয়ের আগে ১৬ বছর ধরে আন্দোলন করে কোন সফলতার মুখ দেখেনি এবং দেখার কোন সম্ভবনাও ছিল না । অথচ যখনই তাঁরা (নিজেদের দল থেকে একেবারে বেরিয়ে না এসে বা দলীয় আদর্শ ত্যাগ না করেও) অন্য অরাজনৈতিক ফ্যাসিস্টবিরোধী তরুণদের সাথে এক হয়ে আন্দোলন করেছে তখনই তারা স্বৈরাচারের উপরে জয়লাভ করেছে।
আমাদের একথা বুঝতে হবে যে গত ৫৪ বছর ধরে প্রায় সকল বড় এবং মাঝারি দলগুলো দেশের উত্তোরত্তর উন্নয়নে ব্যার্থ হয়েছে। এমনকি ফ্যাসিস্টের এই শেষ ১৬ বছরের শেষ পর্যায়ে এসেও রাজনৈতিক দল গুলোর নেতৃত্ব দেশের চরম ক্রান্তিকালে ছাত্রদের ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনে মৌখিক সমর্থন ছাড়া তেমন কোনই গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। সে সময়ের পত্র-পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই এ সত্যতার প্রমান পাওয়া যাবে। চরম বাস্তবতা হল এরা ১৫/২০/২৬ বছর ধরে ক্ষমতার মসনদে থেকেও না পেরেছে দেশের টেকসই উন্নয়ন করতে, না পেরেছে মানুষের চরিত্র বা ফিক্সড-মাইন্ডসেট বদলাতে আর না পেরেছে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে। সুতরাং, এখন হয় তাঁদের পুরান রাজনীতি পরিত্যাগ করে নতুন রাজনীতি করতে হবে, অথবা নিজের দলীয় আদর্শ পরিত্যাগ না করেই একটি নতুন পথ বের করতে হবে যাতে করে সবাই মিলে ৩৬ জুলাইয়ের মত ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন এক বাংলাদেশ বিনির্মান শুরু করা যায়।
উপসংহারে বলব, এ কথা কি অস্বীকার করা যায় যে আপামর জনতার সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকলে ৩৬ জুলাই বিপ্লব কখনই সফল হতো না? বিরোধী দলগুলো গত ১৬ বছরে তাঁদের আন্দোলনে কখনও এককভাবে আবার কখনও সবাই জোট বেঁধে সাধারন মানুষকে সম্পৃক্ত করার কম চেষ্টা করে নাই। কিন্তু এই সাধারন অরাজনৈতিক জনতা এতগুলো বিরোধী দলের ঔ ডাকে কখনই সাড়া দেয়নি। কেন? অনেক কারণের একটি হল তাদের প্রতি এই আপামর সাধারন জনতার অনেক অনেক সিমপ্যাথি ছিল কিন্তু কোন বিশ্বাস ছিল না। এ সকল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা গত ৫৪ বছর ধরে কতবার এদের কাছে ভোট চাইতে গিয়েছে আর তারাও কতবার তাদের ভোট দিয়েছে! অর্থ্যাৎ, মানুষ তাদেরকে অনেক দেখেছে, বার বার দেখেছে এবং রাজনীতিতে তাদের উপর মানুষের ভরসা উঠে গেছে । মুজলুম রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর প্রতি সহানুভুতি থাকা এবং তাদেরকে বিশ্বাস করা দুটো আলাদা ব্যাপার – এখানেই লুকিয়ে আছে নুতুন বন্দোবস্তের প্রয়োজনীয়তা এবং ধারণা। কিন্তু এই তরুণ ছাত্রছাত্রীদের হাতে হ্যামিলিওয়নের কি বাঁশি ছিল যে তাদের ডাকে সবাই ঝাপিয়ে পড়ল? হ্যাঁ, এই অপরিচিত তরুণদের কথা এবং মলিন মুখগুলোকেই মানুষ বিশ্বাস করেছে এবং ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে যেতে প্রেরণা যুগিয়েছে। আধুনিক ইতিহাসের জঘন্যতম ফ্যাসিস্ট বিদায় নিয়েছে এটা যেমন সত্য ঠিক একইভাবে আমাদের সিংহভাগ তরুণ আমজনতা গত ৫৪ বছরের ট্র্যাডিশনাল রাজনৈতিক ধারাকে প্রত্যাখান করেছে – একথা রাজনৈতিক দলগুলো এখনও বুঝেছে বলে মনে হয় না।
-(লেখক, শিক্ষাবিদ, সাবেক সহঃ অধ্যাপক, ডি আই ইউ)