বাংলাদেশের ২০২৩ সালের বইগুলো লেখা, সম্পাদনা এবং সার্বিক তত্ত্বাবধান একদিকে বাংলাদেশের সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধ, সংস্কৃতি, নৈতিকতা, চেতনা ও মূল্যবোধ পরিপন্থী এবং অন্যদিকে এটা অসত্য তথ্যে ভরা, একপেশে, প্রচন্ডভাবে ইসলামোফোবিক এবং রেসিস্ট একটা প্রজেক্ট। এ কথা যে সত্য তাঁর প্রমান কি? এটা জানার সহজ প্রক্রিয়াই বা কি? এর জন্য আট ধরনের রিসার্চ স্ট্র্যাটেজির (Denscombe, 2017)মধ্যে আপনি যদি প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণীর যে কোন দুইটা ক্লাসের মাত্র চারটা বই নিয়ে একেবারে নূন্যতম একটা কেইস স্টাডি করেন, তাহলে খুব সহজেই তা বুঝতে পারবেন। এসব বিষয়গুলো এতটাই খোলামেলা এবং নির্লজ্জভাবে সন্নিবেশিত বা উপস্থাপন করা হয়েছে যে এ জন্য আপনাকে ইন-ডেপথ বা গভীরতর কোন আলোচনাতেও যেতে হবে না । আমি প্রাইমারী থেকে ক্লাস ওয়ান এবং সেকেন্ডারী থেকে ক্লাস সেভেনের বই থেকে কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় আপনাদের সামনে ক্রিটিক্যালি বা সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে উপস্থাপন করব; পাশাপাশি সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয় কিছু কমন বা সাধারন বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করব। মনে রাখবেন রাষ্ট্র যদি একটি বাগান হয় তবে শিক্ষাক্রম বা কারিকুলাম হল তার মালি। একজন মালি যদি ফুলের পরিবর্তে বিষবৃক্ষের চাষাবাদ করে তবে তা থেকে যে যে নির্যাস তৈরি হবে তা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র সবারই মৃত্যুর কারণ হবে; লাভবান হবে শুধু বিষ কারবারীরা।
ভয়ের ব্যাপার হল এই কারিকুলামের মাধ্যমে একটি অদক্ষ আত্ম-পরিচয়হীণ, গোলাম এবং ইসলামোফোবিক সেক্যুলারাইজড জেনারেশন তৈরি হবে যারা ইউরোপের ডানপন্থী বা ভারতের আর এস এস এর সেক্যুলারদের থেকেও হবে বেশী ইসলাম বিদ্বেষী। এর থেকেও ভয়াবহ হল, এরা হবে মেধাহীন এক গোলাম জাতি যাদের বিক্রি হবার মত যোগ্যতা থাকবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে। দেখুন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও বিশ্বনেতা, মুক্তি-দূত, দেশনেতা, জননেতা, নেত্রী, আর গণতন্ত্রের মানসকন্যাতে পরিপূর্ণ একটি দেশে মেয়েদের বাদীগিরী করার জন্য ভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের অনুরোধ করতে হয়, তাদের সাথে চুক্তি করতে হয় এবং যে দেশে মানব পাচারকারী হিসাবে এমপি পর্যন্ত বিদেশের মাটিতে দণ্ডিত হয়। সেই সাথে এটাও কি ঠিক নয় যে বিদেশ থেকে বেশীরভাগই নিম্নশ্রেণীর শ্রমিক, গরীব আর নির্যাতিত কামলাদের পাঠানো (রেমিট্যান্সের) টাকাটাই হয়ে উঠে দেশের সর্বোচ্চ আয়ের মাধ্যম? বিদেশীরা আসে আমাদের দেশে বিনিয়োগ করে লাভ করতে আর আমরা যাই কামলা দিতে? বিগত ৫০ বছরের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের এই বিক্রি হওয়া কামলা আর নীতিভ্রষ্ট নাগরিক ছাড়া আর কীইবা বানাতে পেরেছে?
কৃষক, কামলারা তো আর চুরি, পাচার, লুণ্ঠন, ব্যাংক লোপাট, ঘুস বা ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে না – এসব করে তো শিক্ষিত লোকেরাই। গত ৫০ বছরের শিক্ষা আমাদের জনগণকে না করতে পেরেছে মালিক, না করতে পেরেছে ভাল শ্রমিক, না করতে পেরেছে দেশপ্রেমিক। দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, এই ৫০ বছরে প্রত্যেক সরকারের আমলেই দেশের এবং সাধারন মানুষের সম্পদ এদেশের শিক্ষিত রাজনীতিক আর উচ্চ পদস্থরা যেভাবে চুরি এবং ডাকাতি করেছে তাতে কি এই উপসংহারে আসা খুব অযৌক্তিক? বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা পরিস্থিতিকে করবে আরো ভয়াবহ এবং শোচনীয়।
বর্ণবাদী এবং ত্রুটিপূর্ণ বর্তমান এই শিক্ষাক্রমকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে এখান থেকে নিষ্পাপ শিশুদের বের হবার কোন রাস্তা নেই কারন ১০ টি সাবজেক্ট এর মধ্যে ইসলাম ধর্মকে পরীক্ষার বাইরে রেখে শিখনকালীন মূল্যায়নের মধ্যে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে সামাজিক বিজ্ঞান নামের ইসলামোফোবিক এই বিষয়টি বাধ্যতামূলক পরীক্ষার মধ্যে এনে বাচ্চাদেরকে তা শিখতে বাধ্য করা হয়েছে। এরা ক্ষমতাসীন সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ, সেক্যুলারিজম এবং তাদের কতিপয় নেতাকে ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করে চির অমর করার টোপ দিয়েছে আর সরকার এই টোপ দারুণভাবে গিলেছে বলেই মনে হচ্ছে। সরকারের তৈরি এই ফ্রাংকেনস্টাইন যে ইতিমধ্যেই তাদেরকে গিলে ফেলেছে তা বোধ হয় এখনও তাঁরা টের পাচ্ছে না। টাকা-পয়সা, জমি-জাতি ও গয়নাগাটি হাইজ্যাক বা ডাকাতি হলে তা অনেক সময় ফিরে পাওয়া যায় কিন্তু কারো যদি দর্শন, জ্ঞান, ইতিহাস, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং ঐতিহ্য গুম বা অপহৃত হয় এবং তদস্থলে জাল, বিদ্বেষপূর্ণ কিছু দিয়ে রিপ্লেস বা পূর্ণ করা হয় তবে সে জাতিকে গোলাম হয়ে চিরতরে হারিয়ে যেতে হয়।
ইংরেজরা এ দেশে এসে ইসলাম বিমুখ এবং তাদের দাস কিছু কেরানী বানানোর শিক্ষা চালু করেছিল। অক্সফোর্ড এর আদলে শিক্ষা ব্যবস্থা সাজানোর ফলে ধর্ম বিমুখ লোক তৈরী হলেও কিছু কেরানীর প্রডাকশন বা উৎপত্তি হয়েছিল কিন্তু বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সেই কেরানীও তৈরি হবে না। গত ১০/১৫ বছরে যে প্রডাকশন হয়েছে তাঁর দিকে একটু নজর দিলেই সেটা বুঝা যায়। ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে এই দেশের কোন অভিভাবক নেই। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই ধ্বংস করা হয়েছে; কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দেশীয় গুপ্ত ডাকাতেরা এখানেই তৃপ্ত নয়; এখন আবার সেই ধ্বংসস্তূপকে নতুনভাবে পুড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। অথচ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কত পণ্ডিত আছেন, আছেন কত অভিজ্ঞ সচিব, কত দেশপ্রেমী অফিসার, আইনবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আলেম উলামা আর শক্তিশালী তরুণ সমাজ। বুঝলাম গুম এবং চাকরী হারাবার ভয় আছে, কিন্তু সরকার বিরোধী আন্দোলনে না গিয়েও তো এই দানব এবং অপশিক্ষা বিরোধী আন্দোলনে সবাই এক হওয়া যায়। এটা তো আমাদের জীবন, বিশ্বাস, অস্তিত্ব এবং পরবর্তী বংশধরদের ভবিষ্যতের সাথে সরাসরি জড়িত। এটা তো একটা সমূলে ধ্বংসকারী বন্যার মত এক মহা সংকট; এই মুহূর্তেও যদি এক না হওয়া যায় তবে আর কবে এক হওয়া যাবে?
এ এক আজব শিক্ষাক্রম। জাতীয় শিক্ষাক্রম পামলেটের ৮৪ পাতায় দেখুন প্রথম শ্রেণীর বাচ্চাদেরকে নৃত্য এবং গান/সঙ্গীত শেখানো হবে। প্রথম শ্রেণীর শারীরিক শিক্ষায় এই নৃত্য শেখানো হবে (দেখুন, শিক্ষক সহায়িকা -প্রথম শ্রেণী, ৬ নং বই)। পৃথিবীর ১০২ টি দেশের কারিকুলাম ঘেঁটে এই শিক্ষাক্রম করা হয়েছে; এর মধ্যে এমন কোন দেশ আছে যেখানে প্রথম শ্রেণীর বাচ্চাদের নৃত্য শিখানো হয়? ২০২৩ সালে প্রথম শ্রেণীর জন্য সঙ্গীতের বই ছাপানো হয়েছে (দেখুন, শিক্ষক সহায়িকা -প্রথম শ্রেণী, ৫ নং বই); এখানে প্রথম শ্রেণীর বাচ্চাদেরকে সঙ্গীতের দাদরা, কাহারবা, একতাল, ত্রিতাল, তেওড়া, ঝাঁপতাল, রূপক, ঝম্পক, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগ … শিখতে হবে। ব্রিটেনের মত উন্নত দেশগুলোতে মিউজিক ক্লাস শুরু হয় তৃতীয় শ্রেণিতে; তাও আবার সব স্কুলেই এটা বাধ্যতামূলক নয়। খোদ ভারতে যেখানে নৃত্য চলচ্চিত্র শিল্পের অন্যতম একটি প্রধান দর্শক এবং বাজার আকর্ষণ সেখানেও তো প্রথম শ্রেণী থেকে বাচ্চাদেরকে সঙ্গীত বা নৃত্য শেখানো হয় না। তাহলে বাংলাদেশে কেন এটা বাধ্যতামূলক করা হল? ভাল মত খেয়াল করুন: একটি বাচ্চা যখনই নাচ এবং সঙ্গীত শিখবে তাকে দেশ এবং বিদেশের নৃত্যশিল্পী এবং গায়ক-বাদকের সাথে স্বাভাবিকভাবেই পরিচিত হতে হবে; সে নিজে নিজেই এতে মোটিভেটেড বা উৎসাহিত হবে। অবধারিতভাবেই সে ইউটিউব, আকাশ বা সোশাল মিডিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে যাবে। বুঝতে পারছেন তো আমাদের এই বাচ্চারা আগামী ১০ বছর পর কোথায় গিয়ে পৌঁছবে? নৃত্য বা সঙ্গীত কখনোই কোর একাডেমিক সাবজেক্ট নয়; না প্রাইমারীতে, না সেকেন্ডারিতে -পৃথিবীর কোন দেশেই নয়। যারা এডাল্ট তারাই সঙ্গীতের জগতে একবার ঢুকলে লেখাপড়া চুলোয় তুলে, আর এই বাচ্চারা জীবনের একেবারে শুরুতেই সঙ্গীত চর্চা করবে; মানে জীবনের শুরুটাই তাদের ডিস্ট্র্যাকশন বা উন্মত্ততা দিয়ে। সংগীত একটি বিনোদনের বিষয়; এটা কখনই একাডেমিক্যালি কোন কোর সাবজেক্ট বা মূল বিষয় নয়। সঙ্গীত বাচ্চাদের লেখাপড়াকে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলবে কারণ এগুলোর জন্য অতিরিক্ত সময় দিতে হবে; অন্যান্য বিষয়গুলো যেখানে শুধুমাত্র পড়তে এবং লিখতে হবে; সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সেখানে পড়তে, শুনতে, শুনাতে, গাইতে এবং লিখতে হবে ; সবকিছু মিলিয়ে এটা বাচ্চাদের বোঝা ভারী করবে এবং নার্ভকে সিরিয়াসলি এফেক্ট করবে। শুধু কি তাই? এই গানের ব্যাপারে দেশের বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর আবশ্যকীয় ধর্মীয় অনুভূতি তথা হারাম-হালাল বা বৈধ-অবৈধর প্রশ্ন জড়িত আছে। বাংলাদেশের মত দেশে এটা বাচ্চারা শিখবে কি শিখবে না তা নির্ধারণ করবে তাদের অভিভাবকরা এবং বাচ্চারা নিজে যখন তারা সিদ্ধান্ত নেবার মত যথেষ্ট বড় হবে। ইসলামোফোবিক সেক্যুলার একটি জেনারেশন তৈরি করার জন্য আর কত প্রচেষ্টা এরা করবে!
আপনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি বইয়ে লক্ষ্য করবেন, যে সকল ছবি বা ইমেজ ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে মুসলিম বা ইসলামী সংস্কৃতির অনুপস্থিতি। যেমন: প্রত্যেকটি মেয়ের ছবিই হল শাড়ি পরে, চুল বের করে এবং কিছু আছে হাফ বা অর্ধ সালোয়ার কামিজ পরে কিন্তু তাদের মাথায় কোন স্কার্ফ বা কাপড় নেই; আবার কপালে টিপ দেওয়া মেয়েদের ছবি আছে, শিখদের ছবি আছে, উপজাতি মেয়েদের ছবি আছে। এতে আমাদের কোন আপত্তি নেই, কিন্তু আপত্তি হল হিজাব পরিহিত একটি মেয়ের ছবিও আপনি পাবেন না। এরা কেমন সেক্যুলার বুঝে আসে না। ব্রিটেনের মত দেশে যেখানে মাত্র ৪.৪% মুসলিম সেখানকার স্টেশন, এড, স্কুল ম্যাগাজিন, এডমিশন গাইড, এবং বইগুলোতে মুসলিম মেয়েদের বোরকা পরিহিত ছবি দেয়া হয় কিন্তু ৯০% মুসলিমদের দেশে যেখানে লক্ষ লক্ষ মেয়েরা বোরকা পরে সেখানে একটি বোরকা পরা ছবি দিতেও এদের এত ভয়? কোথাও আপনি নামাজের ছবি পাবেন না, মসজিদের ছবি পাবেন না, মুসলিম পরিবারের ছবি পাবেন না, ঈদে কোলাকুলির ছবি পাবেন না, টুপি মাথায় একজন শিক্ষক অথবা দাড়িওয়ালা তরুণের ছবি পাবেন না। শিক্ষার মাধ্যমে যদি মূল্যবোধ, সচেতনতা এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে হয় তবে তো লেসন বা পাঠগুলোকে বাস্তব জীবনের আলোকে উপস্থাপন করতে হবে এবং সেখানে অনুপাতের ভিত্তিতে সকল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব এবং অংশগ্রহণ থাকতে হবে। একটি বিশাল এবং প্রধান জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য, মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতিকে লুকিয়ে বা বাদ দিয়ে সংখ্যালঘুর মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরা এবং চাপিয়ে দেওয়ার মানে হলো এই সব কচি কাচা বাচ্চাদের সাথে প্রতারণা করা; এই দেশ এবং এর ঐতিহ্যের ব্যাপারে তাদেরকে মিথ্যা ধারনা দেওয়া এবং এটা তাদের পরিচয় মুছে দেবার একটা হীন প্রচেষ্টা। এটা বাচ্চাদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা; এটা অসাংবিধানিক, অনৈতিক এবং অন্যায়।
প্রশ্ন আসতে পারে, সামান্য ছবিগুলো নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কি আছে? দেখুন আমরা যারা নার্সারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তারা সবাই জানি যে একটা ক্লাসে যে কোন পাঠ বা লেসনকে বাস্তব, লাইভ বা জীবন্ত করতে হলে সেই লেসনকে কনটেক্সুয়ালাইজড বা প্রাসংগিক করতে হয় পরিচিত বা জানা কোন কিছুর আলোকে। এর আলোকেই সেখানে একটা পরিবেশ তৈরি করতে হয়; আর বইয়ের ছবিগুলো হল ভিজুয়াল রিপ্রেজেন্টেশন এবং সেই কনটেক্সুয়ালাইজেশন যার মাধ্যমে বাচ্চারা বাস্তব জগতের শিক্ষা গ্রহণ করে। বহুল আলোচিত একটি প্রবাদ আছে: একটি ছবি এক হাজার শব্দের চেয়ে ও বেশি কথা বলে (A picture speaks more than a thousand words)। আর বাচ্চারা যেহেতু ছবি দেখতে ভালবাসে এবং সহজেই আকৃষ্ট হয়; সেহেতু এই ছবিগুলোকে সেক্যুলাররা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছার মোক্ষম অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে।
এটা এমন একটা শিক্ষাক্রম যেখানে মুসলিম এবং ইসলামী মূল্যবোধকে কোন স্পেস বা জায়গা দেওয়া হয়নি। একটি কারিকুলামে অবশ্যই কিছু ইনক্লুশন এবং এক্সক্লুশন থাকবে কিন্তু একচেটিয়া একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি এক্সক্লুড করে দিলে তাকি কেবলমাত্র একটি জনগোষ্ঠীরই কারিকুলাম হয় না ? এবং তাতে কি সত্য বলে কিছু থাকে?
এই শিক্ষাক্রম বা কারিকুলামের আরও একটি খারাপ দিক হল এর মাধ্যমে মুসলিম বাচ্চারা নিজেরাই নিজেদের গালি দিবে এবং গোটা পরিকল্পনাটা সেভাবেই করা হয়েছে। বই লেখকদের ভাষা শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। ন্যূনতম ভদ্রতাটাও বজায় রাখেনি। তারা চতুর্থ শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের আমাদের ইতিহাস অধ্যায়ের ৭৯ পাতায় বলছে ‘শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ চতুর্দশ শতকে বাংলার সিংহাসন দখল করেন’– এর মাধ্যমে ইতিহাসের এই অন্যতম সফল এবং আমাদের এই বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বাধীন ঘোষণাকারী এই মহানায়ককে একজন দখলদার হিসাবে বাচ্চাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ দিল্লি তাঁকে প্রথম সপ্তগ্রামে নিয়োগ দেন একজন গভর্নর হিসাবে; সেখান থেকেই পান্ডুয়াকে রাজধানী করে তিনি বাংলাকে স্বাধীন সালতানাত হিসাবে ঘোষণা দেন। তাহলে তিনি দখল করলেন কখন এবং কিভাবে?
মূলতঃ তারা সরাসরিই যেটা বলছে তা হল এই সকল মুসলিম শাসকরা ছিল উচ্চভিলাসী, ক্ষমতালিপ্সু, বহিরাগত এবং দখলদার। তাদের কথা হল যে, তুরস্ক বা আরব বিশ্ব থেকে এই ইসলামী সেনাপতিরা কেন বাংলাদেশে এসে এখানকার জনগণকে ইসলামে দীক্ষিত করল, কেন এখানকার শাসনভার গ্রহন করে সেন শাসনকে থামিয়ে দিল? ইসলামফোবিক এই সেক্যুলাররা যেটা ইমপ্লাই বা ইংগিত দিচ্ছে তা হল ইসলাম একটি বাহিরাগত ধর্ম এবং এটা আমাদের ভূলে যেতে হবে। বিষয়টি হয়েছে ঠিক ইসরাইলের ইহুদী এবং প্যালেস্টাইনের মুসলিমদের মত। কিভাবে?
ঠিক এই সময়ে যারা প্যালেস্টাইনে বসবাস করছে তারা মুলতঃ কেননাইট ডিসেন্ডেট বা কেননাইট বংশোদ্ভূত। খ্রিস্টের জন্মের ২০০০ বছর আগে থেকেই এদের ইতিহাস পাওয়া যায়, বাইবেলে কমপক্ষে ১০০ বার এদের রেফারেন্স এসেছে। ইহুদী, পারসিয়ান, গ্রীস এবং রোমানরা এইখানে একের পর এক যুদ্ধ করেছে কিন্ত শান্তি আনতে পারে নাই কারন এরা একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে এবং কেউ কাউকে তাদের অধিকার দিতে চায়নি। যারাই যখন অন্যপক্ষকে পরাজিত করে ক্ষমতায় এসেছে, তারাই তখন ম্যাসাকার বা গণহত্যা চালিয়েছে। অবশেষে মুসলিমরা প্যালেস্টাইন বিজয় করলে খ্রিস্টিয়ান, ইহুদী এবং সামারাতিয়ান — সবারই অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় (Moshe, 1997)। মুসলিমদের জয়ের পরেই প্যালেস্টাইন খিলাফত তথা গোটা এলাকার জন্য সোনার খনি এবং সবচেয়ে শান্তি এবং উর্বর জমিনে পরিণত হয় (প্রাগুপ্ত) কারন মুসলিমরা ম্যাসাকার তো দুরের কথা বরং এলাকার উন্নয়ন করেছে, মানুষের অধিকার এবং মূল্যবোধকে সম্মান করেছে; ভালবাসা দিয়ে মানুষের মন জয় করেছে। ফলে আস্তে আস্তে স্থানীয় লোকজন ইসলামকে জেনেছে এবং ভালবেসেছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এবং ইহুদি-খ্রীস্টিয়ান শোষকদের হাত থেকে মুসলিম শাসকরা প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করে একে রূপান্তর করে সাহিত্য, সম্পদ, এবং সম্প্রীতির কেন্দ্রস্থলে। কিন্তু যখনই এটা আবার খ্রীস্টিয়ান এবং ইহুদীদের হাতে গেছে আবার ও সেই ম্যাসাকার বা গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। ইহুদীদের এখানে আসার, কলহ, মারামারি, ম্যাসাকার করার এবং একেবারে চলে যাবার ইতিহাস আছে কিন্তু কেননাইটরা প্যালেস্টাইন কক্ষনই ত্যাগ করেনি। জায়োনিস্ট বা বর্তমানের কনভার্টেড ইহুদীদের এখানে কোন কালে আসার তো প্রশ্নই আসে না।
যায় হোক, ইসলাম আবির্ভাবের পর প্রায় শতভাগ কেননাইট বা ফিলিস্তিনরাই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে আরব পরিচিতি ধারণ করে। এবং এরাই এখানকার আদি বাসিন্দা। কিন্ত পূর্বের মতই ইহুদী এবং জায়োনিস্টদের কথা হল: ইসলাম এখানকার ধর্ম না – এটা বহিরাগতদের ধর্ম আর সেই কারনে খোদার দেওয়া প্রতিশ্রুত এই ভূমি তাদেরকে ছেড়ে দিতে হবে যেহেতু কোন এক সময়ে তাদের পূর্ব-পুরুষেরা এখানে বসতবাড়ি করেছিল। তাহলে, এই প্যালেস্টাইনরা কি ইসরাইল-আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স এর তোপের মুখে পড়ে বহিরাগত হয়ে যাবে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হবার কারনে? গত তেরশ বছর ধরে তারা ইসলাম প্র্যাকটিস করেছে যা তাদের বাপ দাদাদের ধর্ম ছিল না; তাই বলে কি এটা তাদের বাহিরের ধর্ম হয়ে যাবে এবং এই কারনে তারা ধর্ম ত্যাগ করবে এবং তাদের নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে? মুসলিমরা নির্যাতিত এবং চলমান যুদ্ধরত পক্ষদের পরাজিত করে মজলুমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে তাঁরা উচ্চভিলাসী এবং বহিরাগত হয়ে গেল?
বাংলাদেশের অবস্থা এর থেকে ভিন্ন কোথায়? পাল এবং সেনরা কি বহিরাগত ছিল না? তাদের বাড়ি কি আমাদের বাংলাদেশে ছিল? তারা কি জোর পূর্বক তাদের ধর্ম আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল না? তারা কি জনগণের কাছ থেকে জোর পূর্বক চাঁদা আদায় করত না? তাদের ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালনের জন্য তারা কি ম্যাসাকার বা গণহত্যা করেনি? এরা এতবড় স্বার্থপর এবং কাপুরুষ ছিল যে নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদে জনগণকে তাদের প্রাসাদ আক্রমণকারী অল্প কয়েকজন সৈন্যদের হাতে ফেলে রেখে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছিল; নূন্যতম প্রতিরোধও গড়ে তুলেনি। দেশপ্রেম আর জনগনের প্রতি ভালবাসার কি অপূর্ব নজির!! কিন্তু মুসলিম শাসকরা এসে কি করেছে? মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে; স্বৈরতন্ত্রের চোখে ঘৃণিত এবং তাদের হাতে দলিত-মথিত মানুষকে ভালবেসে বুকে তুলে নিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে। এখানকার মানুষদেরকে নিয়ে এই দেশের সীমানা বাড়িয়েছে। এই বিশ্ব নায়কেরা মরুভূমিতে ফুল ফুটিয়েছে, আগাছা কেটে ফসল ফলিয়েছে, জালিমের গর্দান কেটে মজলুমকে ক্ষমতার আসনে বসিয়েছে। এটাই ছিল এই বহিরাগতের পোষাক; এটাই ছিল তাঁদের উচ্চাভিলাষ এবং এসব কারনেই প্যালেস্টাইনের মতই আমাদের পূর্ব পুরুষেরা তাদের ধর্ম গ্রহন করেছে।
ঘৃণা, বিদ্বেষ, অহংকার, লুট-পাট, শ্রেণী-বৈষম্য, শোষণ– এসব শয়তানের ধর্ম; হোক সে বহিরাগত (outsider) আর ঘরের লোক (insider)। ধর্ষক- সে পাকিস্তানী হোক আর ভারতীয় হোক আর বাংলাদেশী হোক; মুসলিম হোক আর হিন্দু হোক আর খ্রিস্টান হোক- সবাই সমান। ধর্ষক আমার ভাই হলেই তাতে ধর্ষিতার সম্মানহানি এবং যন্ত্রণা কম বা বেশী হয় না। বরং আমাদের স্বাধীন সীমানায় আমার ভাই হবার কারনে শাস্তিটা তার বেশী হওয়া উচিত কারন সে আমার বোনের আমানতের খেয়ানত করেছে; তাঁকে ধোঁকা দিয়েছে।
ঠিক প্যালেস্টাইনের মতই আমাদের ইসলামোফোবিক সেক্যুলাররা এখানে বর্তমান ইহুদীদের মত পূর্বের অরাজকতাপুর্ন শাসন ফিরিয়ে আনতে চায়; সেজন্যই তারা বার বার প্রতিটা ক্লাসের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে এইসব নায়কদেরকে কাপুরুষ হিসাবে চিত্রিত করেছে এবং আমাদের কোমলমতি শিশুদের মগজ ধোলাই করছে।
শিক্ষা প্রত্যেকটি শিশুর নাগরিক অধিকার কিন্তু শিক্ষার নামে এই নিষ্পাপ শিশুদের মাথার মধ্যে যে ঘৃণার বীজ বপন করা হচ্ছে তাতে ধ্বংসের জন্য বাহির থেকে কাউকে আসতে হবে না; এরা নিজের আগুনে পুড়ে নিজেরাই মরবে। ধর্মীয় উন্মাদনা যেমন নিন্দনীয় তেমনি অধর্মীয় উন্মাদনাও নিন্দনীয়। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় এই অধর্মীয় উন্মাদনার সাথে যুক্ত হয়েছে রেসিজম, ইসলামোফোবিয়া, ধর্মীয় বৈষম্য, ঘৃণার বিষ বাষ্প এবং অসত্য তথ্য। এটা কোন প্রকারেই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু শুধু মাত্র বক্তৃতা -বিবৃতিতে কাজ হবে না। এদের বিরুদ্ধে শক্ত একটা ঐতিহাসিক আন্দোলন দরকার। এক সরকার যাবে আর এক সরকার আসবে; কিন্তু এই ঘৃণা-প্রচারকদের (hate-preachers) খুব একটা বেশী যাবে আসবে না। সেই জন্য এদের বিরুদ্ধে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের এই শিক্ষা আন্দোলনে এমনভাবে শরীক হওয়া দরকার যাতে করে শিক্ষাক্রমের ব্যাপারে সংসদে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা মালা পাশ হয় যেখানে এই ইসলামোফোবিক সেক্যুলারদের চিরতরে কবর রচিত হয়। প্যালেস্টাইন একদিনে জায়নিস্টদের হাতে যায়নি; এর পিছনে ছিল তাদের দীর্ঘ সময় এবং ষড়যন্ত্র। আমরা যে আমাদের দেশকে, মানুষকে, ধর্মকে, নিষ্পাপ শিশুদেরকে এবং আমাদের পরবর্তী বংশধরদেরকে ভালবাসি তার প্রমান আমাদেরকে এখনই দেখাতে হবে।