মুক্তিযুদ্ধ, চেতনা, মূল্যবোধ এবং শিক্ষা রূপকল্প

Share this post

এটা ঠিক যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ না হলে আমরা আজকের বাংলাদেশ পেতাম কিনা তা অনিশ্চিত; আর তা পেলেও হয়ত আরও রক্তবন্যা বইত অথবা অনেক বেশী সময় লাগত। আবার এইটাও ঠিক যে বখতিয়ার খিলজী লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে এই বঙ্গদেশ জয় না করলে আজকের এই বাংলাদেশ না হবার সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশী। ঠিক একইভাবে আবার ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হবার সময় তৎকালীন নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশকে শুধুমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার কারনে পাকিস্তানের সাথে একীভূত না করে ভারতের অংশ হয়ে থাকলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের কোন অস্তিত্বই থাকত না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের এই জেনারেশনের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট, ঠিক একইভাবে ১২০৩ সালের বঙ্গবিজয় এবং ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য ছিল টার্নিং পয়েন্ট। ১৯৭১ সালের ঘটনাই আমাদের একমাত্র এবং মূল চালিকাশক্তি নয়; ১২০৩ এবং ১৯৪৭ সালের ঘটনাও সমভাবে আমাদের অন্যতম মুল চালিকাশক্তি ; এ রকম অনেক স্পিরিট বা চালিকাশক্তির ফল আমাদের এই আজকের স্বাধীন মাতৃভূমি– বাংলাদেশ। এগুলোকে বিভক্ত করে দেখলে আমরা এক আত্মভোলা জাতিতে পরিণত হব এবং আমাদের চেতনা হবে অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত এবং ত্রুটিযুক্ত। শিশুকাল, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য- এগুলোর যে কোন একটি যেমন একজন মানুষের সম্পূর্ণ জীবনের প্রতিফলন নয় ঠিক একইভাবে একটি সাহসী জাতি তার উত্থান এবং পতনের ইতিহাসে শুধুমাত্র একটি ধাপ বা কালকেই সকল মূল্যবোধ বা চেতনার মানদণ্ড হিসাবে দেখতে পারে না। এটা করা এক ধরণের ফুলিশ রোমান্টিকতা যা অল্প সময়ের জন্য খুবই রোমাঞ্চকর কিন্তু কখনই তা দীর্ঘমেয়াদী বা সার্বজনীন নয়। আমরা জানি আমাদের এই মাতৃভূমিকে কত দস্যুরা কব্জা করতে চেয়েছে কিন্তু বারে বারে তাদের হাত থেকে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা কিভাবে আমাদের আজকের এই জীবনকে এই সময়টাতে এগিয়ে দিয়েছে।

আজকের এই বাংলাদেশ শুধুমাত্র ১৯৭১ সালেই স্বাধীন হয়নি। এই সুজলা, সুফলা সোনার দেশটি এর আগেও একবার স্বাধীন হয়েছিল শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের নেতৃত্বে ১৩৪২ সালে। সেটি হয়েছিল দিল্লীর মসনদে অধিষ্ঠিত মুসলিম শাসকদেরই বিরুদ্ধে। কোন সে চেতনা আর মূল্যবোধ যার তাড়নায় তিনি দিল্লির সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আমাদের এই বাংলাদেশকে সর্ব প্রথম স্বাধীন বাঙ্গালা বলে ঘোষণা করেছিলেন? সেদিন নিশ্চয়ই এই বাংলার জনতা ১৯৭১ সালের মতই আনন্দিত ছিলেন এবং বিজয়ের আনন্দে সিক্ত ছিলেন এবং এর জন্য তাদেরকে কম সংগ্রাম এবং রক্ত দিতে হয়নি। কিসের চেতনায় সম্রাট আওরঙ্গজেব তার ভাগনা বুজুর্গ উমেদ খাঁকে চট্টগ্রাম পাঠিয়েছিলেন যিনি ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রামকে খুনি মগদের হাত থেকে স্বাধীন করেছিলেন? কিসের মূল্যবোধ এবং চেতনায় উমেদ খাঁ এবং সুবাদার শায়েস্তা খাঁ বংগদেশকে এক সোনার দেশে পরিণত করেছিলেন যখন এক টাকায় ১৬ মন চাউল পাওয়া যেত? ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি এইসব চেতনার ধারাবাহিকতা নয়? ঈসা খাঁ, তিতুমীর, খান জাহান আলী, ফকির মজনু শাহ, দুদু মিয়া, হযরত শাহজালাল (রহঃ), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবর রহমান, জিয়াউর রহমান– এই সব ব্যাক্তির কিসের চেতনায় এবং মূল্যবোধে লড়াই করেছেন? কিসের তাড়নায় তারা অনেকেই নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বাংলার এ জমিনকে রক্ষা করার জন্য জীবন দিয়েছেন? ইতিহাসের একটিমাত্র এবং কেবলমাত্র একটি ঘটনা কি একটি জাতির সকল চেতনা আর মূল্যবোধ নির্ধারণ করতে পারে? হতে পারে কোন ঘটনা বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনটি কম। কিন্তু তাই বলে তো একটি ঘটনাই সকল চেতনার মানদণ্ড হতে পারে না। মুলতঃ চেতনা কোন বিচ্ছিন্ন অনুভূতি বা বোধশক্তি নয় এবং তা রাতারাতি তৈরি হয় না। একটি জাতির সব চেতনাই একটির সাথে অন্যটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যারা একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটিকে একমাত্র চেতনা বা মূল্যবোধ মনে করে এবং তা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে চায় এরা এ জাতির প্রতিনিধিত্ব করে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হবে ত্রুটিপূর্ণ, অসম্পূর্ণ এবং একপেশে। এটাকে অবশ্যই হতে হবে হলিস্টিক বা সামগ্রিক।

আমরা গভীর বা সাধারণভাবেও যদি পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখব যে, অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১২০৩, ১৩৪২, ১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৪৭ এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের চেতনার মধ্যে তেমন কোন ফারাক নেই। এ সবই ছিল অত্যাচার, জুলুম এবং শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রাম। এগুলো সবই ছিল জালিম শাহীর গোলামী থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম। শোষকরা কখনও ছিল আর্য সেন, কখনও মোগল, কখনও মগ, কখনও ব্রিটিশ, কখনও পিণ্ডি। মুলতঃ ক্ষমতালোভী এই সব স্বৈরাচাররা যে দেশের, বর্ণের আর জাতেরই হোক না কেন সবাই হল ভিন্ন ভিন্ন বোতলে একই মদ, একই দৈত্য। আমাদের আজকের চেতনা এবং মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে যুগে যুগে এই অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে নির্যাতিত হয়ে, জেল খেটে এবং লড়াই করে। আমাদের মানচিত্র, পানি, সম্পদ, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিশ্বাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা এবং পারিবারিক মূল্যবোধকে এই জালিমরা ধ্বংস করতে চেয়েছে, বদলিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্ত আমাদের পূর্বপুরুষেরা এসব রুখে দিয়েছেন। আমরাও ইন-শা-আল্লাহ রুখব কারন, আমরা তাদের মত রুখে দেবার এই চেতনাকে ধারণ করি।

ইসলামের বিরুদ্ধে সেক্যুলারদের একটা বড় অভিযোগ এই যে পাকিস্তানী শাসকরা ছিল মুসলিম এবং তারা ইসলামকে ব্যবহার করেছে। এটা তো স্বতঃসিদ্ধ সত্য যে ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) একত্রিত হয়ে একটি রাষ্ট্র হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। সে সময় যদি পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের ৯০% লোক মুসলিম না হয়ে হিন্দু হত তবে কি তারা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়ে একীভূত হত? মুসলিম হবার কারণেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেই সময় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকরা আমানতের খেয়ানত করেছে এবং শোষণ করেছে। কিন্তু এটা কি গত ১৪০০ বছরের ইতিহাসে নতুন কিছু?

১৭৫৭ সালে কি মীরজাফরের গাদ্দারীর কারনে পলাশীর পতন হয়নি? সে কি একজন হিন্দু নামধারী ছিল? মীরজাফর মুসলিম হয়ে গাদ্দারীর কারণে এখন কি আমরা সবাই ইসলাম বিরোধী হয়ে যাব? গাদ্দার জগৎ শেঠ এবং উমিচাঁদের হিন্দু হবার কারনে আমরা কি সবাই হিন্দু বিরোধী হয়ে যাব? ইয়েমেনে ১০ লক্ষ বনি আদম মারা গেছে। যে সৌদি, আমিরাতি এবং মিশরীয় শাসকরা নিরপরাধ ইয়েমেনীদের বম্বিং করে মারছে তারা কি মুসলিম নামধারী নয়? এখন এই কারনে কি সকল মুসলিম ইয়েমেনীরা ইসলাম বিরোধী চেতনা ধারণ করবে? সেক্যুলাররা কক্ষনই দেখে না যে ইসলাম মজলুমদের প্রতিনিধিত্ব করে, জালিমের নয়। মুসলিম নামধারী জালিম এবং স্বৈর শাসকরা যেমন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য ইসলামকে ব্যবহার করে ঠিক একইভাবে সেক্যুলাররা ইসলামকে জুলুমের পোশাক পরিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেয়, ধর্মহীন করে। জালিমদের ইসলামের প্রতিনিধি হিসাবে তুলে ধরে ইসলামের ব্যাপারে ঘৃণা ছড়িয়ে দেয় অথচ ইসলামের আবির্ভাবই হয়েছে জালিমদের থেকে মজলুমদের বাঁচাতে; শয়তানের থেকে বড় জালিম আর কে হতে পারে? বস্তুত: এই সেক্যুলাররা হল আর এক জালিম এবং স্বৈরাচার। বুঝতে হবে আওয়ামী লিগের মিছিলে বিএনপির কেউ জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে গাড়ি পোড়ালে সেটা আওয়ামী লীগের দায় না; আবার বিএনপির মিছিলে আওয়ামী লীগের কেউ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে ফায়ার করলে তার দায় বিএনপির না। জালিমরা ভাল স্লোগান দিলেই তা ইসলামিক হয়ে যায় না।

সমস্যা হল বাংলাদেশ তথা আমাদের এই উপমহাদেশের সেক্যুলারদের মুল চেতনাই হল ইসলাম বিরোধীতা। সেক্যুলারদের মধ্যেও অনেক পার্থক্য আছে। এই যেমন ধরেন ব্রিটেন এবং ফ্রান্স পাশাপাশি দুই দেশ; কিন্তু তাদের সেক্যুলার চেতনা এবং মূল্যবোধ এক নয়। যেমন ব্রিটেনে মেয়েরা বোরকা পরতে পারবে, মুখ ঢাকতে পারবে, বোরকা পরে আরগোস, প্রাইমার্ক, মার্কস এন্ড স্পেনসার এর মত কোম্পানিগুলোতে মেয়েরা চাকরী করতে পারবে; স্কার্ফ পরে মেয়েরা পুলিশ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেল, প্রশাসন, পার্লামেন্ট, বিচার বিভাগ সব জায়গাতেই কাজ করতে পারবে, নির্বাচিত হতে পারবে– কোন সমস্যা নেই– এটাই তাদের সেক্যুলার চেতনা বা মূল্যবোধ। কিন্তু ফ্রান্সে? ফ্রান্সে আপনি মুখ ঢাকলে জরিমানা দিতে হবে, না হয় জেলে যেতে হবে এবং হিজাব পরে কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন না তাদের সেক্যুলার চেতনা এবং মূল্যবোধের কারনে। ইউরোপের সেক্যুলারিজমের উদ্ভব খ্রিস্টিয়ান ধর্মের বিপরীতে হলেও তারা ধর্মকে একটা স্পেস দেয় এবং ফ্রান্সের মত ব্যতিক্রম ছাড়া মাইনরিটি বা সংখ্যালঘুদের ধর্ম কর্ম পালনে বাধা প্রদান করে না। কিন্তু বাংলাদেশের সেক্যুলাররা খুবই ফ্যানাটিক, অসহিষ্ণু এবং ইসলাম ধর্মবিদ্বেষী। তারা ধর্মকে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মকে কোন স্পেসই দিতে চায় না; বরং পারলে কিভাবে এটাকে বিকৃত এবং ধ্বংস করা যায় সেই চেষ্টায় থাকে।

এখন বলা হচ্ছে যে ১৯৭১ সালের চেতনা হল সেক্যুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষতার চেতনা এবং এই মূল্যবোধ ধারণ করেই আমাদের শিক্ষা রূপকল্প হতে হবে। এইটা একটা ডাহা মিথ্যা কারন, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ থেকে মুক্ত হবার জন্য; ইসলাম ধর্ম থেকে বেরিয়ে গিয়ে সেক্যুলার হবার জন্য নয়। এমন নয় যে পাকিস্তানী শাসকরা খুব ধর্মভীরু ছিলেন, ধর্মীয় নেতা ছিলেন এবং তারা ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ছিলেন অত্যাচারী, মদ্যপ এবং নাম সর্বস্ব মুসলিম। ঐ সময়ের পেপার পত্রিকা পড়লে আমরা দেখতে পাই যে তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পাকিস্তানী ক্ষমতাসীনদের সাথে সবচেয়ে ভাল সম্পর্ক ছিল আওয়ামী লীগের। পাকিস্তানী শাসকদের সাথে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব ছিল ক্ষমতার। তারা কেউই এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা ইসলাম বিনাশের কোন ইস্যুতে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। ইসলাম কোন ইস্যুই ছিল না এখানে। অথচ যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে পাকিস্তানী শোষকদের পরিবর্তে ইসলামকেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে সেক্যুলাররা গোটা দৃষ্টিকেই অন্যদিকে নিয়ে গেছে।

পরবর্তীতে স্বাধীনতার বিষয়টা আসলে কেউ যদি ইসলামের নামে জালিম আর শোষকদের পক্ষ অবলম্বন করে তবে সে ইসলামের বিপক্ষেই অবস্থান নেয় কারন ইসলাম কখনই কাউকেই মজলুমের পরিবর্তে জালিমের পক্ষ নেবার লাইসেন্স দেয় না। স্বাধীনতার পরে এর জন্য ইসলামকে দায়ী করার অর্থ হল একধরনের হিপোক্রেসি এবং যারা এটা করেন তারা রেসিস্ট, ইসলামোফোবিক। ইসলাম যে ইহসান, সততা, সুবিচার, সমতা, দণ্ডবিধি, ভাতৃত্ববোধ এবং অন্য ধর্মের প্রতি সম্মানের কথা বলে সেটা যদি থাকত তবে যুদ্ধ বিগ্রহের কোন অস্তিত্বই থাকত না। যাই হোক, একজন অসাধু ব্যক্তি সাধুর অবয়ব ধরলে বা পোশাক পরলেই সে সাধু হয়ে যায় না। সেক্যুলাররা যতই ইসলামকে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যবহারের চেষ্টা করুক না কেন সেটা কক্ষনই পারবে না কারন আমাদের এই মুলুকে ইসলাম এবং স্বাধীনতা এক অবিচ্ছেদ্য গাঁথা পতাকা। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এই জমিনে জালিম আর স্বৈরাচারদের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে তাদের জান, মাল, ইজ্জত দিয়েছেন তাদের জমিন, ধর্ম, বিশ্বাস, মূল্যবোধকে রক্ষা করার জন্য। এগুলোকে তারা সামান্য ক্ষমতা আর পয়সার লোভে বিক্রি করে দেননি, বরং জীবন দিয়ে রক্ষা করেছেন। এখান থেকেই তৈরি হয়েছে আমাদের চেতনা এবং মূল্যবোধ।

১৯৭১ সালে এবং এর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ১২০৩ সাল থেকে বা তারও আগে থেকে যে আত্মত্যাগ করেছে সেগুলোর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আমাদের চেতনা এবং মূল্যবোধ। এগুলোকে বাদ দিয়ে কোন শিক্ষা রূপকল্প মেনে নেওয়া যায় না– এতে আমাদের জাতিসত্তার বিনাশ ঘটে এবং আমরা পরিচয়হীণ এক জাতিতে পরিণত হই। বর্তমান বাংলাদেশে যদি কিছু সেক্যুলার নাগরিকের কিছু দাবী থাকে তাতেও কোন সমস্যা নেই। আনুপাতিক হারে তাদের কথাও শিক্ষা রূপকল্পে থাকতে পারে কিন্তু আমাদের মুল চেতনাকে কক্ষনই বাদ দিয়ে নয়। এ কথা প্রমান করা যাবে যে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান নায়ক শেখ মুজিবর রহমান কক্ষনই এই রকম সেক্যুলার বাংলাদেশের (ডেইলি স্টার, ২০১৫, ২০২১) কথা বলেন নাই যদিও তার নাম ভাঙ্গিয়ে এবং তাঁকে ব্রান্ড হিসাবে ব্যবহার করে সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীনতার মুল চেতনাকেই পরিবর্তন করে ফেলেছে। তিনি ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহারের বিপক্ষে ছিলেন এবং তাতে তো দোষের কিছুই নেই। তিনি সেক্যুলারিজমের এক নতুন ব্যাখ্যা দেন যেখানে তিনি ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অভ্যাসগুলোকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন (প্রাগুক্ত)। মনে রাখতে হবে তাঁর সেক্যুলারিজমের এই নতুন ধারনা বা ব্যাখ্যা এসেছে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পরে। যুদ্ধের আগে খোদ সেক্যুলারিজম শব্দটিই কক্ষনই কোন দফা, সুপারিশ বা ইশতেহারে ছিল না।

১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবশ্যই একটি চেতনা ছিল। এ কথা বলা যাবে না আমাদের ভোটের অধিকার ছিল না, সে সময় ফেয়ার ইলেকশন হয়েছিল বলেই তো আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করেছিল। যাই হোক, আমরা ছিলাম অবহেলিত, বঞ্চিত এবং শোষিত; আমাদেরকে একই দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মত দেখা হত। স্বাধীনতার চেতনাটা মুলতঃ এখান থেকেই শুরু হয়। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা বা রূপকল্পে বার বার এই কথাটা আসছে যে এই শিক্ষা ব্যবস্থা হবে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে। এটা খুবই প্রাসঙ্গিক এবং যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সাথে সাথে আরও যে মুক্তিযুদ্ধগুলো আমাদের পূর্বপুরুষরা করেছেন সেই চেতনাগুলোকে কবর দেওয়া হবে তাতো মানা যায় না।

দেখুন মুক্তিযুদ্ধের যে মূল্যবোধ গত ১২ টি বছর ধরে আমরা দেখেছি তাতে এই মূল্যবোধ মুক্তিযুদ্ধ তো দুরের কথা স্বাভাবিক যুদ্ধের মূল্যবোধ বা চেতনার মধ্যেও পড়বে না। খেয়াল করুন, মুক্তিযুদ্ধের নামে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ধর্ষণের সেঞ্চুরি হয়, সুন্দরী মেয়েদের বেছে বেছে নেতাদের মনোরঞ্জন করতে বাধ্য করা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে সিট বাণিজ্য করা হয়, ব্যাংক লুটপাট হয়, রাজকোষ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা চুরি হয়, আইনের অপপ্রয়োগ হয়, নিয়োগ বাণিজ্য হয়, ধর্মকে নোংরা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, গরীব মানুষের ট্যাক্স আর উন্নয়নের নামে বিদেশ থেকে ঋন এনে দেশে বিদেশে আলিশান বাড়ি কেনা হয়, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করলেই স্বাধীনতা বিরোধী ট্যাগ দেওয়া হয়, জেলে ভরা হয়। সমালোচনার স্বাধীনতা নেই, মত প্রকাশের অধিকার নেই, সরকারী/বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোকে দুর্নীতির আখড়া করা- এগুলো নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ বা চেতনা ছিল না। ফলে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেছে একটা ব্রান্ড যার নাম ভাঙ্গিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে, মানুষকে মারা হচ্ছে, তাদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বানানো হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা নামটি ধারণ করে যে যেভাবে পারে দুর্নীতি করে যাচ্ছে, রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে – এগুলো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফল। শিক্ষা ব্যবস্থাতেও এই চেতনার অপব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অব্যবস্থাপনা, ঘুষ, দলীয় নিয়োগ এবং বাণিজ্যের কথা কে না জানে? এসমস্ত প্রতিষ্ঠানে যারা সবচেয়ে অনিয়ম করে তারা হল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী। তাদের জন্য সব জায়েজ। শিক্ষাক্রমে এই রকম চেতনার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কী? এই চেতনা আর মূল্যবোধ দিয়ে আমরা শিক্ষা রূপকল্প বাস্তবায়ন হয়ত করতে পারব কিন্তু যা তৈরি হবে তা সব আগাছা, বীজ বা ফসল নয়।

মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা হল শোষণ থেকে মুক্তি, দুর্নীতি থেকে মুক্তি, দরিদ্রতা থেকে মুক্তি, অশিক্ষা, কুশিক্ষা থেকে মুক্তি, অসমতা এবং জুলুম নির্যাতন থেকে মুক্তি। এই চেতনা এবং মূল্যবোধ হবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ এবং এর চেতনার ব্রান্ডকে ব্যাবহার করে শোষণকে পাকাপোক্ত করা হয়েছে; দেশ দুর্নীতির মহাসমুদ্রে পরিণত হয়েছে; দরিদ্রতা থেকে জাতি মুক্তি পায়নি; অশিক্ষা-কু শিক্ষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। শিক্ষার মান এতই নিম্নে নেমে গেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে ৯০% ছাত্র ছাত্রীরা নূন্যতম মার্কস নিয়ে পাশ করতে পারে না; রাষ্ট্রে একশ্রেণীর মানুষের টাকা রাখার জায়গা নেই আর এক শ্রেণীর সিংহভাগ মানুষই দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করছে, আর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, রাজনৈতিক এবং আন্তঃ দলীয় খুনাখুনি একটা সাধারন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা, সম্পদ, চাকুরী, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন সকল ক্ষেত্রে শোষণ এবং বৈষম্য সাধারন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে কোথায়?

আশ্চর্যের বিষয় হল যে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় তখনই এই ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ এবং এর চেতনার কথা যারা বলেন তাদের পক্ষে শিক্ষা ব্যবস্থা কতটুকু অর্থবহ, সুষম, এবং যুগোপযোগী করা যাবে তা সহজেই বুঝা যায়।

মনে রাখতে হবে যে শিক্ষা রূপকল্প হতে হবে সুবিবেচনাপূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ, তথ্যসমৃদ্ধ যা আমাদের গোটা ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং চেতনাকে ধারণ করে। এখানে অবশ্যই সুবিচার করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগলিক এবং দার্শনিক ঘটনাসমূহ, পরিবর্তন বা কালগুলোকে তাদর উচ্চতা অনুযায়ী উপস্থাপন করতে না পারলে বা এড়িয়ে গেলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হবে প্রতারণামূলক এবং অসম্পূর্ণ।

সার কথা হল, বাংলাদেশ শুধু ১৯৭১ এর চেতনাকেই ধারণ করে না, এ চেতনা শুরু হয়েছিল বখতিয়ার খিলজী এবং তারও অনেক আগে থেকে। আর আমাদের যে মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে তা শুধুমাত্র ইংরেজ শাসনের শুরু থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই ২শ বছরের নয়; এর শুরু অনেক আগে থেকে। আমাদের চেতনা এবং মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে আমাদের হাজার বছরের যুদ্ধ, ত্যাগ, ধর্ম, মুসলিম জাতিসত্তা, মানবিকতা, একসাথে বসবাস করার মানসিকতা, ভিন্ন বিশ্বাস এবং একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা, সহযোগিতা এবং ভালবাসার ভিত্তিতে। এসব কিছুর ভিত্তিতেই হতে হবে আমাদের শিক্ষা রূপকল্প।

Dr Md Azabul Haque

Share this post

Leave a Reply