আপনারা ‘স্ট্যাচু অভ লিবার্টি’ (The Statue of Liberty) বা ‘স্বাধীনতার মূর্তির’ কথা হয়ত সবাই জানেন। এটাকে কিন্তু কেহই ‘স্কালপচার অভ লিবার্টি’ (The Sculpture of Liberty) বা ‘স্বাধীনতার ভাস্কর্য’ বলে না যদিও এটা যিনি তৈরী করেছেন সেই ফ্রেডারিক অগাস্তে বারথল্ডি (Frederic-Auguste Bartholdi) একজন স্থপতি বা স্কাল্পটর হিসাবেই বিখ্যাত। আমেরিকাকে দেওয়া ফ্রান্সের এই উপহারটি আসলে একটি স্থাপত্যকলা তথা ভাস্কর্যকর্ম যা মূলতঃ একটি মানবমূর্তি বা স্ট্যাচু; এটাকে কেউ ভাস্কর্য না বলে মূর্তিই বলে। এই আমাদের পাশের দেশ ভারত বা ইন্ডিয়ার গুজরাটে ২০১৮ সালে সরদার বল্লভভাই প্যাটেল এর মূর্তি তৈরি করা হয়েছে যেটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দ্যা স্ট্যাচু ওভ ইউনিটি’ (The Statue of Unity) বা ‘ঔক্যের মূর্তি’; এটাকেও কিন্তু ‘ঐক্যের ভাস্কর্য (The Sculpture of Unity)’ না বলে ‘ঐক্যের মূর্তিই’ বলাই হয়। চীনে অবস্থিত ‘স্পিং টেম্পল বুদ্ধা’ (Spring Temple Buddha) যা পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম স্থাপত্যকলা তাকেও কিন্তু ভাস্কর্য না বলে মূর্তিই বলা হয়। রাশিয়ার ‘দ্যা মাদারল্যান্ড কলস’ (The Motherland Calls) হল পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম স্ট্যাচু যাকে ভাস্কর্য না বলে মূর্তিই বলা হয়। এ রকম প্রচুর জ্বলন্ত উদাহরণ দেওয়া যাবে।
ঠিক একই ভাবে এইসব দেশে এমনকি ইউরোপে অনেক বিশাল বিশাল হিন্দু টেম্পল বা গীর্জা পাওয়া যাবে যেগুলোতে দেবদেবীদের প্রচুর মূর্তি আছে কিন্তু সেইগুলোকে কক্ষনই আমরা ভাস্কর্য বলি না। ইন্ডিয়াতে আমাদের প্রচুর হিন্দু ভাই বোনেরা সারা বছর ধরেই প্রায় পূজা-পার্বন করেন এবং সেই লক্ষ্যে রাম, সীতা, লক্ষণ, হনুমান, রাঁধা, কৃষ্ণ, শিবসহ অনেক দেবতার মূর্তি তৈরী করেন এবং তাঁদের পুজা-অর্চনাও হয়, কিন্তু এগুলোকে কি কেউ ভাস্কর্য বলে? না। এগুলোকে সবাই মূর্তিই বলে যদিও এগুলো ভাস্কর্য্যের পদ্ধতির মাধ্যমেই তৈরি হয়।
তাহলে প্রশ্ন হল কেন ‘‘দ্যা স্ট্যাচু অভ লিবার্টির’, ‘দ্যা স্ট্যাচু ওভ ইউনিটি’, ‘‘দ্যা স্প্রিং টেম্পল বুদ্ধা’ বা ‘দ্যা মাদারল্যান্ড কলস’কে ভাস্কর্য না বলে মূর্তি বা স্ট্যাচু বলছে। এরা কি মুর্খ না কি গাঁজা খেয়েছে? জ্বি না, তাঁরা সঠিকটাই বলছে। স্কাল্পচার (sculpture) বা ভাস্কর্য হল শক্ত বস্তুকে একটি আকৃতি দেওয়ার একটি শিল্প বা আর্ট যা কোন বস্তু, ব্যাক্তি, আদর্শ বা ধারণার প্রতিক হিসাবে কাজ করে। সহজ ভাষায়, ভাস্কর্য হল একটি পক্রিয়া বা পদ্ধতি (an art of forming solid objects…); এটা কোন বস্তু নয় (যদিও অনেকে এর সাথে দ্বিমত করতে পারেন)। আমাদের ভুলটা এখানেই। আমরা গড়ছি মূর্তি বা স্ট্যাচু আর বলছি স্কাল্পচার বা ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের মাধ্যমে যা করা হয় তা হল স্ট্যাচু বা মুর্তি; ভাস্কর্য্যের মাধ্যমে তো আর ভাস্কর্য করা যায় না। আর মানব আকৃতির ক্ষেত্রে, স্কাল্পচার বা ভাস্কর্য যেহেতু শক্ত বা কঠিন বস্তুকে মানব আকৃতি দেবার একটি কলা বা শিল্প আর স্ট্যাচু যেহেতু শতভাগ সেই শিল্প বা কলা যা রড, সিমেন্ট, বালি, কংক্রিট, মাটি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হয় সেহেতু এটাকে মূর্তি বলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
আসলে মানব আকৃতির সকল ভাস্কর্যখচিত কাজই মূর্তি কারণ সকল মূর্তিকেই ভাস্কর্য্যের মাধ্যমেই তৈরি হয়ে আসতে হয়। আর এজন্যই এসবের নামকরন করা হয়েছে স্ট্যাচু দিয়ে। নামকরণে এরা কোন ছলচাতুরী বা ভণ্ডামির আশ্রয় নেয়নি। ধন্যবাদ নামকরণকারীদের।
এখন প্রশ্ন হল সব মূর্তিই পুজার জন্য তৈরি হয় কিনা। খোদার করুনা এবং অবদানের জন্য আমরা যেমন তাঁকে গ্লোরিফাই করি ঠিক একইভাবে মানুষের মধ্যে কেউ বিশেষ অবদান রাখলে তাঁর কর্মকে স্মরনীয় রাখা বা তাঁর মহৎ কাজকে গ্লোরিফাই করার জন্যই সাধারণতঃ তাঁর মূর্তি বানান হয়। আর ধীরে ধীরে নিরব এবং মানুষের তৈরি এই প্রাণহীন মূর্তিগুলোই একসময় হয়ে উঠে প্রচন্ড শক্তিশালী এবং সম্মানের বস্তু; মানুষ ফুল দিয়ে, মালা দিয়ে, গান দিয়ে, সম্মান বা গার্ড ওভ ওনার দিয়ে, প্রচুর টাকা পয়সা খরচ করে এর সামনে অনুষ্ঠানাদি করে; বিশেষ দিনে জমায়েত হয়;, নিজেদের ভালবাসার তীব্রতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা করে; ঐদিন ভাল পোশাক-আশাক পরে এটাকে স্মরণ এবং সম্মান করে; নিষ্প্রাণ মূর্তি না চাইলেও সে অটোম্যাটিক্যালি গ্লোরিফাইড বা দেবত্বপ্রাপ্ত হয়; কখন কখন এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে আমরা আমাদের খোদাকেও এতটা গ্লোরিফাই করি না; অনেক সময় আমরা নিজের অজান্তেই মূর্তির বন্দনায় এবং প্রশংসায় ডুবে যায়; আলো-বাতাস-পানি আর আসমান ও জমিনের খোদা নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখে না; অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্ন মত থাকতে পারে। আমরা কবর বা মূর্তির সামনে বিভিন্ন কর্মততপরতার সাথে সাথে তাকে মৃত্যুঞ্জয়ী, চিরভাস্বর, অনন্ত, অনির্বান – এই সব শব্দ ব্যাবহার করে দেবত্ব আরোপ করি – বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা দরকার।
কিন্ত ইউরোপের মূর্তিগুলোর সাথে দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মূর্তির কিছু স্পষ্ট পার্থক্য আছে। এসব মূর্তির মধ্যে কোন মূর্তিকেই কোন বিশেষ দিনে ফুল দেওয়া হয় না, তাঁদের সামনে গান গাওয়া হয় না বা শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রদর্শনি প্রতিযোগিতাও হয় না। গত ১৪ বছরের লন্ডনী হায়াতে আমি কখনও দেখি নাই। এদের মধ্যে অনেক মূর্তিই অনেকের কাছেই হিংসা, শোষক, নিপীড়ন আর দখলদারিত্বের প্রতিক হয়ে আছে। যেমন ধরুন রবার্ট ক্লাইভের স্ট্যাচু বা মূর্তি যা লন্ডনের হোয়াইট হলের কিংস চার্লস স্ট্রিটে স্থাপিত। ব্রিটিশ সরকার এসব মূর্তিগুলো করেছে তাঁদের ইতিহাস এবং ব্যাক্তি চরিত্রকে গ্লোরিফাই করার জন্য।
কিন্তু আমাদের দেশের মুর্তি বা স্ট্যাচুগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। সরকারী, বিরোধী দল আর সিভিল সোসাইটি্র চরম পূজনীয় নেতা, গ্রীক দেবদেবী বা মহান দার্শনিক –যাদের মুর্তি সারা দেশে ছড়িয়ে আছে এবং বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস এবং জন্মদিন গুলোতে এ সকল মুর্তি বা স্ট্যাচুর পায়ে ও গলায় মালা দেবার জন্য নেতা কর্মীদের হাজার হাজার টাকার বাজেট, সময়, শ্রম এবং চিন্তা খরচ করতে হয়; কোথাও কোথাও আবার মারামারিও হয়। গ্রীক পুরানিক দেবতারাও বাস্তবিক অর্থে এভাবে পুজিত হয় না ! বছরে তিনি চারদিন এসব মুর্তি বা স্ট্যাচুর ভীষন কদর; নেতা-কর্মি থেকে শুরু করে প্রশাসনের পাক পেয়াদা পর্যন্ত । কিন্ত আফসোর বিষয় হল বছরের বাকী দিনগুলো এই মুর্তি বা স্ট্যাচুগুলো বৃষ্টিতে ভেজে; ঝড়ে ধুলো জমে চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায়; পাখীদের পাবলিক টয়লেট হিসাবে ব্যবহার হয় কিন্তু এসবের ভালবাসা বা যত্ন নেবার কোন হদিস নাই। বিশেষ ভালবাসা এবং সম্মান শুধু তিন দিনের জন্য !
মূর্তি গড়া যদি মুসলমানদের জন্য বৈধ হত তবে প্রত্যেক মুসলিমই সম্ভবত রাসুল (সাঃ) এর একটি মূর্তি গড়ে নিজের কাছে রাখত। কিন্তু ইসলামে মূর্তি অবৈধ বলে কি রাসুল (সাঃ) এর প্রতি আমাদের ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং দোয়ার কোন কমতি বা ঘাটতি আছে? মোটেই না। রাসুল (সাঃ) এর কোন মূর্তি নেই বলে তো আর তাঁর পারিবারিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা একাডেমিক গুরুত্ব কমে যায়নি; বরং বেড়েই চলেছে। ঠিক একইভাবে মূর্তির পরিবর্তে আমাদের জাতীয় নায়কদেরকে কি আমরা আমাদের হৃদয় দিয়ে ভালবাসতে এবং সম্মান করতে পারি না? দোয়ার মাধ্যমে কি আমরা এই ধারা বজায় রাখতে পারিনা? মূর্তি ভেঙ্গে বা ধ্বংস হয়ে গেলে সব শেষ হয়ে গেল, যা দোয়া এবং দাওয়ার মাধ্যমে কখন শেষ হয় না। কিন্তু বেকুবদের এ কথা বুঝাবে কে?