রাসুল(সাঃ)ও হযরত জুয়াইরিয়াহ(রাঃ)এর বিবাহঃ একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

Share this post

সমালোচক এবং জ্ঞানপাপীরা প্রায়ই বলে থাকেন যে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) হযরত জুয়াইরিয়াহর (রাঃ) সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে জোর করে যুদ্ধ-জয়ের রাত্রিতে বিয়ে করেন। আসুন দেখি আসলে কি ঘটেছিল??

রাসুল (সাঃ) বনি মুস্তালেকের যুদ্ধে তখনই অবতীর্ন হন যখন তিনি একাধিক সূত্রে এ খবরের সত্যতা যাচাই করে নিশ্চিত হন যে, স্বয়ং বনি মুস্তালেক সরদার হারিস বিন আবি যেরার তার নিজ এবং অন্যান্য আরব গোত্রের লোকজন নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মদিনা আক্রমণ করতে সম্পুর্ন প্রস্তুত হয়ে গেছে । তাদের যুদ্ধ যাত্রা প্রতিহত করতে রাসুল (সাঃ) তাঁর বাহিনী নিয়ে রওয়ানা হন এবং ঠিক যুদ্ধের আগের দিন শক্রদের থেকে দূরে তাদের সীমানায় তাঁবু খাটান। বনি মুস্তালেক সরদার চাইলে এ যুদ্ধ এড়াতে পারত কিন্তু তারা কোন প্রকার আলোচনার পরিবর্তে যুদ্ধ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় এবং মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। খুব বেশী ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই এ যুদ্ধে তাদের অগ্রগতি থামিয়ে দেওয়া হয় এবং মুসলিমরা বিজয়ী হয়। এ যুদ্ধে একজন মুসলিম শহীদ হন (মোবারকপুরী, ২০০৩) এবং দশ জনের মত শক্র সৈন্য নিহত হয় (লিংস ২০০৬)।

হযরত জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) ছিলেন এই বনি মুস্তালেক সরদার হারিস বিন আবি যেরারের কন্যা। তাঁর ঘটনাটি বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থ থেকে যা জানা যায় তা হলো এই যেঃ বনি মুস্তালেকের এই যুদ্ধে মুসলিমদের কাছে তাদের পরাজয়ের পর অন্যান্য যুদ্ধের মতই মাল এবং বন্দী ভাগ বাঁটোয়ারা হয় এবং স্বাভাবিক নিয়মেই হযরত জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) ছাবেত ইবনে কয়েসের মালিকানাধীন হন। হযরত ছাবেত ইবনে কয়েস তাকে মাকাতেব করে নেন। ‘মাকাতেব’ হল সেই ক্রীতদাস বা দাসী যারা মালিকের সাথে এই মর্মে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে, নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করলেই মুক্তি পেয়ে যাবে। হযরত জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) গোত্র সর্দারের কন্যা হওয়াই তাঁর মুক্তির জন্য উচ্চ মুল্য নির্ধারণ করা হয়।

বন্দী হবার পর হযরত জুয়াইরিয়ার (রাঃ) সামনে দুটি পথ ছিলঃ হয় তাঁকে এই উচ্চ মুল্য পরিশোধ করতে হবে অথবা এই মুল্য তাঁর পক্ষে কেউ পরিশোধ না করা পর্যন্ত তাঁকে হযরত ছাবেত ইবনে কয়েসে (রাঃ) এর অধীনে একজন দাসী হয়ে থাকতে হবে। প্রথমটি অসম্ভব ছিল কারণ তিনি সহ প্রায় দুইশত পরিবার বন্দী হয়েছিলেন এবং ঠিক সেই মুহুর্তে কারো কোন খোজ নেওয়াও সম্ভব ছিল না। আমরা ঠিক জানিনা যে হযরত জুয়ারিয়াহ (রাঃ) জানতেন কিনা যে যুদ্ধে তাঁর গোত্র পরাজিত হলেও তাঁর বাবা বেঁচে আছেন এবং তাঁর মনে এই আশা ছিল কিনা যে নিশ্চয়ই তাঁর বাবা অথবা তাঁর কোন আত্মীয়, (যদি তাঁর বাবা মারা যান) তাঁকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিবে। তিনি হযরত ছাবেত ইবনে কয়েস এর কাছ থেকে মুক্তির জন্য কিছু দিন অপেক্ষা করতে পারতেন, কিন্তু সেটাকে তিনি ভাল মনে করেননি।

তিনি তাঁর বিষয়টিতে হস্তক্ষেপের জন্য কারো কাছে না গিয়ে সরাসরি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লিমের কাছে গেলেন এবং বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসুল, আমি জুয়াইরিয়াহ- গোত্র প্রধান হারিসের কন্যা। আমার দুর্দশা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন । পণবন্দীর মুল্য পরিশোধের ব্যাপারে সাহায্যের জন্য আমি আপনার কাছে এসেছি (লিংস ২০০৬)”। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লিম তাকে বললেনঃ “তুমি কি তার থেকেও ভাল কিছু চাও?” জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) সেটা কি জানতে চাইলে তিনি প্রস্তাব দিলেনঃ “ আমি তোমাকে পনবন্দীর টাকাটা দিয়ে দিই এবং তুমি আমাকে বিয়ে কর”। এই ‘ভাল’টা কি এবং এবং এই বিয়ের প্রস্তাবটা কি নিছক বিয়ের জন্যই না কি আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর অন্য কোন বড় এবং সৎ পরিকল্পনা ছিল? আমরা সেটা দেখব।

আল্লাহ এবং রাসুলের (সাঃ) এর শক্ররা চাই যে আল্লাহ এবং রাসুল (সাঃ) তাদের মত করে কাজ করুক এবং তাদের মত কথা বলুক। বিধায়, তারা বলেঃ ‘আল্লাহ তার রাসুলকে এটা না বলে এটা কেন বললেন না এবং রাসুল এটা না করে কেন এটা করলেন না’। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর কোন সুন্নাতের গঠন এবং বিশ্লেষণমূলক আলোচনা ব্যতীত রাসুলকে (সাঃ) গালিগালাজ এবং তাঁকে অপমানজনক কথা বলাটা তাদের এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারা আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) এর অস্তিত্ব এবং চরিত্র নিয়ে কথা বলে ও ব্যঙ্গ করে। কিন্তু তারা একটা বিষয় কখনই বুঝেনা তা হল আল্লাহ রাসুল (সাঃ) কে একটি মাত্র জাতি, একটি মাত্র সময় বা একটি মাত্র দেশের জন্য পাঠাননি, তাঁকে পাঠানো হয়েছে তাঁর সময় থেকে দুনিয়ার শেষ সময় পর্যন্ত। সুতরাং তাঁর আলোচনা হতে হবে একটা ব্যপক পরিসরে সত্যিকার অর্থে যা ধারন করার কোন সামর্থ্য আমাদের নাই কারণ আমাদের জ্ঞান একটা নির্দিস্ট স্থান, জাত এবং সময়ের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং আমরা কখনই অতীত এবং ভবিষ্যৎকে দেখতে পাইনা বা ধারন করতে পারিনা। শুধুমাত্র আমাদের সময়, জাতি এবং দেশ দিয়ে রাসুলকে (সাঃ) বুঝলে হবে না; তাঁকে বুঝতে হবে সমসাময়িক সেই অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এর নিরিখে। মনে রাখতে হবে যে রাসুল (সাঃ) এর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর তাৎপর্য কখনই শেষ হয়না ।

এখানে যেটা উল্লেখযোগ্য তা হল, হযরত জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) হযরত ছাবেত ইবনে কয়েস (রাঃ) কে এ কথা বলেননি যে ঠিক আছে তুমি আমাকে কিছু সময় দাও আমি আমার বাবার কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে তোমাকে দিচ্ছি অথবা আমি তোমার কাছে মুক্তি প্রার্থনা করছি। অথচ রাসুল (সাঃ) এর অধীনে ঠিক যুদ্ধ শেষে একজন যুদ্ধবন্দীর, সে পুরুষ হোক আর মহিলা হোক, মালিক পরিবর্তনের অধিকার ছিল আর সে কারণেই জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) এই স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। মুনাফিকদের জানা উচিত যে, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ই হলেন সর্ব প্রথম ব্যক্তি যিনি যুদ্ধে পনবন্দিদের জন্য ইনসাফ ভিত্তিক একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম করেন এবং বন্দীদের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন।

হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ) ছিলেন ভীষণ বুদ্ধিমতি এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্না । গোত্র প্রধানের কন্যা হওয়াই রাসুল (সাঃ) এবং সাহাবী আজমাঈনদের ব্যপারে তাঁর মোটামুটি একটা ধারণা ছিল। তৎকালীন আরবে গোত্র-যুদ্ধের কারণে তিনি পণবন্দীর নিয়ম কানুন জানতেন। তিনি জানতেন যে রাসুল (সাঃ) তাঁর হয়ে তাঁর মালিককে মুক্তিপণ দেওয়া মানে হল রাসুল (সাঃ) তাঁর মালিক হয়ে যাওয়া। সবকিছু জেনে শুনেই তিনি রাসুল (সাঃ) এর কাছে আসেন এবং তাঁকে অত্যন্ত সম্মান এবং ভদ্রতার সাথে তাঁর হয়ে হযরত ছাবেত (রাঃ) কে মুক্তিপণ পরিশোধের আবেদন জানান। একজন মানুষের প্রতি নিগূঢ় বিশ্বাস এবং ভরসা তৈরি না হলে এটা কি করে সম্ভব হয়? প্রশ্ন আসতে পারে যে রাসুল (সাঃ) ছিলেন যুদ্ধের নেতা সুতরাং তাঁর কাছে যাওয়া ছাড়া সে আর কাছ যাবে? ভাল কথা। এমন অবস্থাতে যুদ্ধের নেতা সুবিবেচক, সহজগম্য এবং দয়াশীল না হলে তো থাকে ভয় পাওয়া এবং তাঁর দ্বারা নিগৃহীত হবার কথা এবং এই রকম একটা পরিস্থিতিতে চরম আস্থা না থাকলে অনেকটা দাবীর মত করে এ কথা কখনই বলা সম্ভব না যে, ‘আমার পণবন্দীর মূল্যটা আপনি পরিশোধ করে দিন’।

অন্যদিকে রাসুল (সাঃ) হযরত জুয়াইরিয়াকে (রাঃ) আগে থেকে কখনই চিনতেন না। এই প্রথম রাসুলের (সাঃ) সামনে আসার পরেই তাঁকে তিনি দেখেন এবং তাঁর ব্যপারে সম্পুর্নভাবে ওয়াকিবহাল হন। মুনাফিদের প্রশ্ন ‘কেন আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তাঁর পনবন্দীর টাকা দিয়ে তাঁকে তাঁর বাবার কাছে পাঠিয়ে দিলেন না? তিনি তো আল্লাহর রাসুল (সাঃ); কেন তিনি এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন না?’ আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তো যুদ্ধ করেছিলেন শান্তির জন্য। আর হযরত জুরাইরিয়াহ (রাঃ) কে তাঁর বাবার কাছে ফিরিয়ে দিলেই তিনিসহ তাঁর গোটা গোত্র মুসলিম হয়ে যেতেন না বা তারা শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতেন না। আর শান্তিই যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় তবে এ যুদ্ধের মানে কি? আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এটা ভাল করেই জানতেন। আসুন আমরা দেখি তিনি কিভাবে এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

আমরা দেখব মুনাফিকরা কখনই খেয়াল করেনা যে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তাদের এই দৃষ্টান্ত থেকে অনেক অনেক বেশী ভাল কিছু করেছিলেন। সেটা কি?

রাসুল (সাঃ) মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করলে এমনিতেই হযরত জুয়াইরিয়ার (রাঃ) মালিক হয়ে যেতেন, কিন্তু তিনি মালিক হওয়ার পরিবর্তে তাঁকে একটি সম্মানজনক এবং মর্যাদাপুর্ণ সম্পর্কের প্রস্তাব দেন। সাথে সাথে, যে কোন যুদ্ধ পরবর্তি পরিস্থিতিতে একজন বন্দীর জন্য এটাই ছিল সর্বোচ্চ নিরাপত্তার, স্বাচ্ছন্দ্যের এবং স্বাধীনতার। লক্ষ্য করুন রাসুল (সাঃ) প্রথমেই তাঁকে তাঁর স্ত্রী হবার প্রস্তাব দেন নাই অথবা এ কথা বলেন নাই যে, ঠিক আছে আমাকে বিয়ে করার শর্তে তোমার টাকাটা আমি পরিশোধ করে দিব। রাসুল (সাঃ) তাঁর মুক্তির টাকা দেবার বিষয়টি প্রথমে নিশ্চিত করেন এবং প্রস্তাবটা দেন ঠিক তাঁর পরে। এটা ছিল প্রস্তাব এবং এতে না করার সুযোগ ছিল। কিন্তু জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) এই প্রস্তাবে সানন্দে রাজী হন। কিন্তু তাই বলে কি তখনই রাসুল (সাঃ) তাঁকে বিয়ে করেন? না, তা করেন না। পরের দিন জুয়াইরিয়ার (রাঃ) বাবা গোত্র-সরদার হারিস তাঁর মেয়ের মুক্তিপণ নিয়ে হাজির হন। এবং কি ঘটল?

রাসুল (সাঃ) জুয়াইরিয়ার (রাঃ) বাবা হারিসকে ফিরিয়ে দিতে পারতেন যেহেতু তাঁর এবং জুয়াইরিয়ার (রাঃ) মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে একটি চুক্তি এবং বোঝাবুঝি হয়েছে। কিন্তু রাসুল (সাঃ) তা না করে তাঁর বাবাকে মুক্তিপণ দিতে বলেন। তাঁর মানে হল, তখনও জুয়ারিয়াহ (রাঃ) এর সুযোগ ছিল আল্লাহর রাসুলকে (সাঃ) বিয়ে না করে বাবার কাছে ফিরে যাওয়া এবং এ সুযোগ রাসুল (সাঃ) ই তৈরি করে দিয়েছিলেন।

এদিকে হযরত জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) এর বাবা সরদার হারিস বিন আবি যেরার যে পরিমান মুক্তিপণ দেবার জন্য নিয়ে এসেছিলেন, তার মধ্যে থেকে আসার পথে সবচেয়ে সুন্দর এবং দামী দুটি উট, যা দেখে তিনি নিজেই মুগ্ধ হয়েছিলেন তা আকিক উপত্যকায় অত্যন্ত গোপনে লুকিয়ে রেখে এসেছিলেন। ঐ দুটি উট বাদে অন্যসব উট দিয়ে সে রাসুল (সাঃ) কে বললেনঃ ‘ হে মুহাম্মাদ, এই সমস্ত মুক্তিপণ নিয়ে আমার মেয়েকে মুক্তি দাও’। রাসুল (সাঃ) তখন তাঁকে বললেন, ‘সমস্ত মুক্তিপণ? কোথায় তোমার সেই দুটি উট যা আকিকে লুকিয়ে রেখেছো?’ এর পরে রাসুল (সাঃ) সেই দুটো উটের লাগাম থেকে শুরু করে উটকে বাঁধার রশির পর্যন্ত বিস্তারিত বর্ননা দিলেন যা শুনে সরদার হারিসের আর বুঝতে বাকি রইল না যে মুহাম্মদ (সাঃ) সত্যিই আল্লাহর রাসুল এবং নবী। তিনি তৎক্ষণাৎ শাহাদাহ পড়ে মুসলিম হন এবং তাঁর দুই সন্তানও শাহাদাহ পড়ে ইসলামে দাখিল হন। এরপর তিনি উট দুটো আনালেন এবং রাসুলকে (সাঃ) দিলেন। এরপরে রাসুল (সাঃ) হযরত হারিস বিন আবি যেরাকে তাঁর কন্যা জুয়াইরিয়াহকে তাঁর সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।

লক্ষ্য করুন, এখানেও রাসুল (সাঃ) হযরত হারিসকে একথা বলেন না যে তোমার মেয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে এবং সে আমাকে বিয়েতে রাজী হয়েছে সুতরাং তাঁকে আমার হাতে তুলে দাও। বরং তিনি আবারও বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে হযরত হারিসকে (রাঃ) হাঁ অথবা না বলার একটা সুযোগ করে দেন। হযরত হারিস (রাঃ) রাসুলের (সাঃ) প্রস্তাবে আনন্দচিত্তে রাজী হবার পরই রাসুল (সাঃ) এবং হযরত জুয়াইরিয়ার (রাঃ) মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হয়।

এরপরে যখন এটা জানাজানি হয়ে যায় যে বনি মুস্তালিক বিবাহসূত্রে আল্লাহর রাসুলের আত্মীয়, তখন যে সকল বন্দীদের তখনও মুক্তিপণ নির্ধারতি হয়নি তাদের প্রায় একশত পরিবারকে আনসার এবং মুহাজিররা বিনা মুক্তিপণে মুক্ত করে দেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) এর মতে তিনি হযরত জুয়াইরিয়ার (রাঃ) চেয়ে এমন কোন ভাল মেয়ে দেখেননি যে তাঁর গোত্রের কাছে এতটা আশির্বাদ হয়েছে।

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এই ‘ভাল’ টার কথাই বলেছিলেন এবং যুদ্ধের পরিবর্তে সবাকেই মুক্তি দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠাই ছিল হযরত জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) কে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর বিয়ের প্রস্তাবের অন্যতম একটি কারন। এবং এভাবেই আল্লাহর রাসুল (সাঃ) শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

প্রশ্ন আসতে পারে, আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়াটা হযরত হারিসের (রাঃ) পক্ষে সম্ভব ছিল না আর সে জন্যই তিনি রাজী হয়েছিলেন। জ্ঞানপাপীরা এমনটাই দাবি করে। এমন একটি, শুধুমাত্র একটি ঘটনাও কি সমালোচকরা দেখাতে পারবে যে বিয়েতে রাজী না হবার কারণে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কারো উপর কোন প্রতিশোধ নিয়েছেন? কক্ষনই তা পারবে না।

কিন্তু হযরত হারিস বিন আবি যেরার কি তাঁর মেয়ে হযরত জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) এর বিনা অনুমতিতেই জোর করে তাঁকে রাসুল (সাঃ) এর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন? এ প্রশ্ন অবান্তর তিনটি কারণেঃ এক, হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ) আগেই মতামত দিয়েছিলেন; দুই, বাবা হিসেবে আমাদের সবার মতই তিনি তাঁর মেয়ের স্বভাব, চরিত্র এবং মতামত সম্বন্ধে খুবই ভাল জানতেন। তিনি তখনও গোত্রপতি এবং মেয়ের মতের বিপরীতে বিয়ে দিবে এটা অবান্তর এবং যুক্তিহীন। তিন, মনে রাখতে হবে, হযরত জুয়াইরিয়াহ (রাঃ), তাঁর বাবা হযরত হারিস (রাঃ) এবং তাঁর দুই ভাই – এই চার জনই আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর প্রস্তাবটি শুনেন এবং খুশি মনে মেনে নেন। বিয়ের মত একটি চুক্তিতে কনেসহ চার জন ব্যাক্তির খুশি মনে মেনে নেওয়াটা কি তাদের মতামত বা সিদ্ধান্ত দেবার বিষয়টাকে পরিষ্কার করে না এবং তাঁর জন্য এই চারজন ব্যাক্তিই কি যথেষ্ট নয়?

একটু চিন্তা করেলই বুঝা যায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কীভাবে সমস্ত বিষয়টা ঘটিয়েছেন। অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে যে মনসতাত্বিক ব্যাপারটা আমাকে ভাবায় তা হোল, আল্লাহর রাসুল (সাঃ)এবং জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) যদি তাঁর বাবার আসার আগেই বিয়ে করতেন, তবে তাঁর (জুয়াইরিয়া রাঃ) মনের ভিতর ছোট-খাট কষ্ট থাকতে পারত আবার তাঁর বাবাও এই কষ্টটা অনুভব করতে পারত; কিন্তু আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বার বার তাঁদেরকে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং বন্দী জুয়াইরিয়াহ এবং শক্র সরদার হারিস বিন আবি যেরারকে ছোট না করে, দুরে না ঠেলে আপন করে নেবার চেস্টা করেছেন এবং নিয়েছেন। আর এর ফলে তাঁদেরকে কোন ভাবেই নিজেদেরকে বন্দী বা অধীনস্থ ভাববার মত মানসিক কষ্ট পেতে হয়নি।

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) যে দৈহিক সৌন্দয্যের পূজারী ছিলেন না তার হাজার হাজার প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে একটি ঘটনা সমালোচকদের সুপথের সন্ধান দিতে পারে যদি তারা তা বুঝতে পারে। আমরা সবাই দাতা হাতেম তাঈর কথা জানি। তিনি আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর সমসাময়িক ছিলেন। হাতেম তাঈর শাসনাধীন এলাকা ছিল মদীনার উত্তের । তিনি ছিলেন তাঈ গোত্রের প্রধান। তাঁর গোত্রের লোকজন পৌত্তলিক বা মূর্তিপূজা করলেও তিনি এবং তাঁর সন্তান খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী ছিলেন বলে জানা যায় (লিংস ২০০৬, পৃ-৩২৮) । আসুন দেখি তাঁর সুন্দরী কন্যাকে নিয়ে কি ঘটেছিল?

মক্কা বিজয় থেকে ফিরে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ছয় মাস মদীনায় ছিলেন এবং এ সময় তিনি ছোট-খাট কয়েকটা অভিযান চালিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে তিনি হযরত আলীকে (রাঃ) লোহিত সাগরের তীরে কাদিদ নামক জায়গায় মানাত নামের মূর্তি ধবংস করার জন্য পাঠিয়েছিলেন যা তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। আরবের তিনটি প্রধান মূর্তির মধ্যে শুধু একটি ধ্বংস করতে বাকী ছিল আর সেটি ছিল তাইফের আল লাত। এছাড়া, তাঈয়ের লোকজনের মূর্তিপূজার মুল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ফালস বা কালাস নামের একটি (প্যাগান বা মুশরিক) দেবতার মূর্তি । রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এই মূর্তি ধ্বংসের জন্যও হযরত আলী (রাঃ) কে পাঠিয়েছিলেন । আলী (রাঃ) এই মূর্তি ধবংশ করে ফিরে আসার সময় অনেক পণবন্দী এবং মালামাল নিয়ে আসেন। এর মধ্যে হাতেম তাঈর কন্যা ছিলেন যার ব্যাপারে হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ ‘তাঁর চুল ছিল লাল, ঠোট ছিল চেরির মত, চামড়া ছিল মসৃণ, ঘাড় ছিল সরু, নাক ছিল সুন্দর, লম্বা গড়ন, উঁচু মাথা, এবং সোজা গড়ন চেহারা’। সোজা কথায় তিনি ছিলেন অসাধারন সুন্দুরী এক মহিলা। এর পরে আলী (রাঃ) বলেনঃ আমার মনে হল আমি রাসুল (সাঃ) বলি, ‘হে রাসুল (সাঃ), গণিমতের মধ্যে থেকে এই মেয়েটিকে আমাকে দিন। কিন্তু তাঁর অলংকারপূর্ণ কথা শুনে আমি তাঁর সৌন্দয্যের কথা ভুলে গেলাম। সে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কে বললঃ হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ), আপনি আমাকে মুক্তি দিন এবং আরবের লোকজনের অশালীন দৃষ্টিপাত থেকে আমাকে মুক্ত করুন। আমার বাবা ছিলেন পবিত্র বস্তুর অভিভাবক, তিনি দুঃস্থদের কষ্ট লাঘব করতেন, ক্ষুধার্তকে খাবার দিতেন, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দিতেন, উদার আতিথেয়তা করতেন, সবচেয়ে সুন্দর খাবার পরিবেশন করতেন, দেশের বাহিরে শান্তি বিস্তৃত করতেন এবং দরিদ্রের মিনতি কখনই ফিরাতেন না। আমি সেই হাতেম তাঈর কন্যা (ইবনে কাছির, প্রথম খন্ড, পৃ-৭৭)।

একথা শুনে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বললেনঃ হে বালিকা, এসবই তো বিশ্বাসীদের বর্ননা। আজ যদি তোমার বাবা আমাদের সামনে হাজির হত, তবে তাঁর প্রতি আমরা নিঃসন্দেহে দয়াশীল হতাম। এরপর রাসুল (সাঃ) বললেনঃ তাঁকে মুক্ত করে দাও। তাঁর বাবা ছিলেন এমন একজন লোক যে ভাল কাজ করতে ভালবাসত আর আল্লাহতায়ালা ভাল কাজ ভালবাসেন (ইবনে কাছির, প্রথম খন্ড, পৃ-৭৭)। এর পরে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) একটি উট এবং সুন্দর পোষাক উপহার দিয়ে তাঁকে নিতে আসা তাঁর পরিচিত একজনের মাধ্যমে তাঁর বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন (লিংস, পৃ-৩২৯)।

হাতেম তাঈর সুন্দরী কন্যাও কিন্তু হযরত জুয়াইরিয়াহ (রাঃ) এর মত একজন যুদ্ধ-পণবন্দী ছিল এবং তিনিও আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) কাছে সাহায্যের জন্য এসেছিলেন। হাতেম তাঈর কন্যাকে চাইলেই কি আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতেন না বা জোর করে দাসী হিসাবে রাখতে পারতেন না? কিন্তু তাঁর প্রতি আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) এই ব্যবহারে কি প্রমাণ হয়? সমালোচক এবং জ্ঞানপাপীরা আশা করি এর উত্তর খুঁজে পাবেন এবং নিজেদের শোধরাতে পারবেন।

মুহাম্মাদ (সাঃ) যে স্বাধীনভাবে মেয়েদের সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করেছেন এমন অনেক নজীর আমাদের হাতে আছে; এমনকি তা যুদ্ধবন্দী নারীদের ক্ষেত্রেও। আর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বনু তামিম গোত্রে সাফিয়া নামের একজন তরুণী যুদ্ধবন্দী হিসাবে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর হাতে আটক হন। যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী বিজয়ী মুসলিমরা তাঁকে ফিরত দিতে বাধ্য নয়, তবুও রাসুল (সাঃ) তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব করলেন এবং বললেনঃ ‘ তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও নাকি তোমার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চাও?’ সে তাঁর স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চাইলে রাসুল (সাঃ) তাঁকে সসম্মানে তাঁর স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেন যদিও তাঁর গোত্রের লোকজন রাসুলের (সাঃ) প্রস্তাবে রাজী না হবার কারণে তাঁকে ভৎসনা করেছিল (তাবারী, পৃ-১৯৯)।

রাসুল (সাঃ) বন্দীদের প্রতি ছিলেন প্রচন্ড সহানুভূতিশীল এবং তাদের অধিকারসহ সার্বিক ব্যাপারে তিনি ছিলেন পরিপূর্ন হক আদায়কারী। । একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। তাকিফের যুদ্ধে জিরানাহ উপতক্যায় আল্লাহর রাসুল (সাঃ) অনেক বন্দী এবং মাল সামগ্রী পেয়েছিলেন। এদের মধ্যে প্রায় ৬০০ জন ছিল নারী এবং শিশু । রোদের তাপ ছিল এবং তাঁদের অধিকাংশেরই পরনে ছিল অপর্যাপ্ত পোশাক। রাসুল (সাঃ) খুজা গোত্রের একজনকে মালামালের টাকা দিয়ে প্রত্যেকের জন্য মক্কা থেকে একটি করে নতুন পোশাক কিনে এনে তাদের সবাকেই দিয়ে দিলেন (লিংস, পৃ-৩২১)।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের রাসুল (সাঃ) এর উপর রহমত বর্ষন করুন।

কাজেই আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর বিরুদ্ধে হযরত জুয়াইরিয়া (রাঃ) কে জোর করে বিয়ে করার যে অভিযোগ তোলা হয় তা সম্পুর্নভাবে অজ্ঞতাপ্রসূত, ভিত্তিহীন এবং শক্রতামূলক ।

রেফারেন্সঃ

১ Lings, Martin. Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources Inner Traditions, 2006 Vermont UK

২) আর রাহীকুল মাখতুম, আল্লাম ছফিউর রহমান মোবারকপুরী (বাংলায় অনুবাদ-খাদিজা আখতার রেজায়ী), আল কোরাআন একাডেমী লন্ডন, ঢাকা, ২০০৩

৩) Tabari, Imam Mohibuddin (694 AH). The Mothers of the Believers Darul-Ishaat, Karachi-Pakistan, 2010 [তাবারী, ইমাম মহিবুদ্দিন, দা মাদার অভ দি বিলিইভারস, (৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ),ইংরেজিতে অনূদিত, দারুল ইশাত করাচি,২০১০]

(এ লেখার কোন অংশ লেখকের অনুমতি ব্যতীত বই আকারে ছাপান যাবে না। তবে লেখকের নাম সহ শেয়ার করা যাবে এবং রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। এই লেখা আরো পরিমার্জনা শেষে বই আকারে প্রকাশিত হবে ইন-শা-আল্লাহ)

Dr Md Azabul Haque

Share this post

Leave a Reply