ভূমিকা
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং হযরত যাইনাব (রাঃ) এর বিবাহ- একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ …….
কিছু গবেষক, উৎসাহী এবং জ্ঞানপিপাসু তরুণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাথে হযরত আয়েশা এবং যাইনাব (রাঃ) এর বিয়ে নিয়ে অনেক সঙ্গত এবং অসঙ্গত প্রশ্ন করে এবং এ বিষয়ে তাঁরা অনেকেই জানতে চায়। কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে তাঁদের মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি কাজ করে। আর কিছু সমালোচক এবং ইসলামের শক্ররা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে, সম্ভবতঃ, সবচেয়ে বেশী গালি দেয় এই দুটি বিয়ে নিয়ে। এগুলোকে তারা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং ইসলামদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে জঘন্য অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে। এ অধ্যায়ে আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে যাইনাব(রাঃ)-এর বিয়ে নিয়ে একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করব। আমরা আরও দেখব, বিরুদ্ধবাদীরা কিভাবে কোরআনের একটি সম্পুর্ন আয়াতের খণ্ডিত ও অসম্পুর্ন অংশ ভুলভাবে এবং সেই সাথে একাটি জাল হাদিসকে যুগ যুগ ধরে এই অসৎ কাজে ব্যবহার করে আসছে ।
তাদের অভিযোগটা কি? তারা বলে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁর পালকপুত্র হযরত যায়েদ (রাঃ) এর স্ত্রী হযরত যাইনাব(রাঃ)-কে কৌশলে জোরপুর্ব্বক বিয়ে করেছেন যা খুব সহজেই ভিত্তিহীন এবং অযৌক্তিক বলে প্রমাণ করা যায়।প্রকৃতপক্ষে, চরম বাস্তব সত্য হল ঠিক এর উল্টোটা। অর্থ্যাৎ, এ বিয়ের কথা তিনি কখনও ভাবেনও নাই এবং এতে তিনি রাজিও ছিলেন না, বরং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজে যাইনাব(রাঃ) এর সাথে তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। যাই হোক, অভিযোগকারিদের মধ্যে অধিকাংশরাই মুল ঘটনা সম্পর্কে সম্পুর্ণ অজ্ঞ; কিছু অংশ ভুলভাবে জ্ঞাত; কিছু অংশ রাসুলুল্লাহকে (সাঃ) নিষ্পাপ এবং নির্দোষ জেনেও তাঁর উপর দুর্নাম আরোপ করে; আর এর সাথে আছে অমুসলিম ও কপট মিশনারিজরা যারা সেবা ও ধর্ম প্রচারের আড়ালে গল্প বানিয়ে, যতভাবে পারা যায়, ততভাবে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর চরিত্রকে কলুষিত করছে বিরামহীনভাবে। এসব ঘটনাই বিস্তারিতভাবে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করব ইন-শা-আল্লাহ ।
অনেকের মতে এই অপপ্রচার ব্যাপকভাবে শুরু হয় পাশ্চাত্য থেকে যা তারা সফলভাবে সারা দুনিয়াই ছড়িয়ে দিয়েছে। পাশ্চাত্যের অনেক ব্যক্তি যাদেরকে অনেকেই বড় পণ্ডিত বলে মনে করেন তারাও এর বাহিরে নন। যেমন ভলতেয়ার এবং প্রিডঅ (আর্মস্ট্রং, পৃ-২২৮) অত্যন্ত বাজে ভাষায় রাসুলুল্লাহর (সাঃ) চরিত্র হনন করেছেন।
প্রথমেই অভিযোগের প্রেক্ষাপটের উপর একটু আলোকপাত করা যাক।
২ . অভিযোগের প্রেক্ষাপট
হযরত যাইনাব(রাঃ) ছিলেন আব্দুল মুত্তালিবের আপন নাতনী; আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এর আপন ফুফু ( লিংস, পৃ- ১১৬) উমাইমাহর কন্যা এবং শহিদদের নেতা হযরত হামজা (রাঃ) এর আপন ভাগিনি। চাচা আবু জাহেল এবং আবু লাহাব রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে কষ্ট দিলেও অন্য চাচা হামজা (রাঃ) এবং আবু তালিবের মত তাঁর ফুফু উমাইমাহ তাঁকে ভীষণ স্নেহ করতেন এবং রাসুলুল্লাহর সাথে তাঁদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। রাসুল হবার আগে থেকেই মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সকল আত্মীয় স্বজনদের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। আর স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ফুফু উমাইমাহ এবং ফুফাত ভাই বোন আবদল্লাহ, আবু আহমেদ, যাইনাব এবং হামনাহর (লিংস,পৃ- ১১৬) সাথে ফুফাত ভাইবোন হিসাবে সুসম্পর্কের ব্যাপারটা ব্যাতিক্রম কিছু ছিল না। সুতরাং যাইনাব (রাঃ) রাসুলুল্লাহর কাছে অপরিচিত কোন চরিত্র ছিলেন না। উল্লেখ্য যে ইসলামের প্রাথমিক বিপদকালীন সময়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর চাচাদের তুলনায় ফুফুদের কাছ থেকেই সহযোগীতা বেশী পেয়েছেন এবং ফুফু উমায়মাহ ছিলেন তাঁদের অন্যতম ।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ২৫ বছর বয়সে ( রাসুলের জন্ম ৫৭০ সনে+ বিয়ে ২৫ বছর বয়সে=৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে) যখন খাদিজা (রাঃ) কে বিয়ে করেন; তখন যাইনাব (রাঃ) (জন্মগ্রহণ করেন ৫৮৯ খ্রিষ্টাব্দে) এর বয়স ছিল (৫৯৫-৫৮৯=) ৬ বছর (মতান্তরে ৮ বছর) । খাদিজা (রাঃ) মারা যান ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে (লিংস, পৃ- ৯৮); তখন যাইনাব (রাঃ) এর বয়স ছিল ৩০ বছর। তিনি তখনও অবিবাহিত ছিলেন। খাদিজা (রাঃ) এবং আবু তালিব কয়েক মাসের ব্যবধানে একই বছরে মারা যান এবং রাসুল (সাঃ) তাঁর ৪ জন এতিম বাচ্চাকে নিয়ে জীবনের চরম এক সংকটময় অবস্থায় পড়েন। এ বিপদের মুহুর্তেও রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি তাঁর ফুফু উমাইমাহ এবং ফুফাত ভাই বোনদের সহানুভুতির কোন ঘাটতি ছিল না। এ সময়গুলোতে নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ(সাঃ)এর সাথে যাইনাব(রাঃ) অনেক বার দেখাসাক্ষাৎ এবং সালাম আদান প্রদান হয়েছে। সে সময়ে আপন ফুফাত বোন যায়নাবকে বিয়ের সুযোগ থাকলেও তিনি কক্ষনই তা চিন্তা করেননি। এবং আমরা কোন সিরাতে এই ধরণের কোন ঘটনারই বর্ননা পাই না।
দ্বিতীয় আকাবার অব্যবহিত পরেই রাসুলুল্লার (সাঃ) উৎসাহে অন্যান্য মুসলিমদের মত যায়নাবও (রাঃ) ৬২২ (লিংস, পৃ-১১৬) খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পরিবারের সাথে মদিনায় হিজরত করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৩ মতান্তরে ৩৬ বছর। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হিজরতকারী এবং আত্মীয়দের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক রাখতেন। এ সময় যাইনাব (রাঃ) মদিনায় হিজরত করে একটা নতুন পরিবেশ এবং সমাজে খাপ খাওয়াতে কষ্ট হলেও তাঁকে বিয়ে করার নিয়ত, চিন্তা বা বাসনা কক্ষনই রাসুলুল্লাহর মনের ভিতর উদ্রেক হয়নি। বরং কিভাবে যাইনাব (রাঃ) কে সৎপাত্রে দান করা যায় বা ভাল একজন মুসলিমের সাথে বিয়ে দেওয়া যায় – এ ব্যাপারে তাঁর পেরেশানি ছিল।
যায়েদ (রাঃ) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর পালকপুত্র এবং আল্লাহর রাসুল তাঁকে খুবই ভালবাসতেন। তাঁর চরিত্র, আনুগত্য, পরহেজগারিতা, আল্লাহভিতি – সর্বোপরি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)তাঁর প্রতি খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর ফুফাত বোন যায়নাবের জন্য যায়েদ (রাঃ)কে পছন্দ করলেন। তিনি নিজেই এ প্রস্তাব পাঠান এবং এ বিয়ের ব্যাপারে চরম আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু এ বিয়েতে যাইনাব (রাঃ) নিজেসহ তাঁর (সালাবি, পৃ-১৪২৩) পরিবার আপত্তি তুললেন এই বলে যে তারা চায় কুরাইশ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত সম-বংশ মর্যাদায় কারো সাথে যাইনাব (রাঃ) এর বিয়ে হোক ।
যাইনাব (রাঃ) এবং তাঁর পরিবারের এই আপত্তির প্রেক্ষাপটে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শক্তভাবে তাঁর প্রিয় হাবিবকে সমর্থন করে সমস্ত মানবজাতিকে নির্দেশ দেনঃ ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মু’মিন পুরুষ কিংবা মু’মিনা নারীর সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবেনা। কেহ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সেতো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট (কোরআন ৩৩:৩৬)’।
অবশেষে যাইনাব (রাঃ) এই বিয়েতে রাজী হন এবং বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু বিয়ের পরে যায়েদ এবং যায়নাবের পরিবারে প্রায়ই ঝগড়া-ঝাটি লেগে যেত এবং তা কখনও কখন যায়েদ (রাঃ) এর জন্য চরম মানসিক কষ্টের কারণ হত। যাইনাব(রাঃ) যায়েদ (রাঃ) এর বংশ মর্যাদা নিয়ে কথা তুলতেন এবং যায়েদ (রাঃ) এই বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে প্রায়ই জানাতেন (মাআরেফুল ক্বোরআন, পৃ-১০৮৩)। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে যায়েদ (রাঃ) যাইনাব (রাঃ) কে তালাক দেবার সিদ্ধান্ত নেন এবং তা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে পেশ করেন।
ইতিমধ্যেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে জানান যে, পালকপুত্রের বিধান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বাতিল করেছেন; কোরআনের সেই নির্দেশনা হলঃ ‘পালকপুত্র এবং তাঁদের পালক পিতা মাতারা মুলতঃ দ্বীনী ভাই এবং বন্ধু (৩৩:৫)’; সেই সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরও জানান যে হযরত যাইনাবএবং যায়েদ (রাঃ) এর মধ্যে তালাক হয়ে যাবে এবং তাঁর সাথে যাইনাব (রাঃ) এর বিয়ে হবে (মাআরেফুল ক্বোরআন, পৃ-১০৮৩) ‘যাতে মু’মিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব নারীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মু’মিনদের কোন বিঘ্ন না হয় (৩৩:৩৭)’। এ আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসুলের মাধ্যমে এ বিয়ে সংঘটিত করেছেন মুমিন এবং মুমিনাদের জীবনকে নির্বিঘ্ন বা সহজ করার জন্য।
এখন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যান এই ভেবে যে, তিনি নিজে যদি যায়েদ (রাঃ) এর স্ত্রী যাইনাব(রাঃ)কে বিয়ে করেন তবে লোকজন কি মনে করবে; মক্কার মুশরিক, মুনাফিক এবং ইসলাম বিরোধীরা বিষয়টাকে ঘোলাটে করবে এবং তাঁর চরিত্রে কালিমা লেপন করে এটাকে ইসলাম প্রচার এবং প্রসারের বিপক্ষে তা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবে। আর তাছাড়া তিনি জানতেন যে তালাক দেওয়া আল্লাহর কাছে খুব ঘৃণিত কাজগুলোর একটি। ফলে তিনি যায়েদ (রাঃ) কে সবর বা ধৈয্য ধরার পরামর্শ দেন এবং তালাক দিতে বারংবার নিষেধ করে সংসার জীবন চালিয়ে যেতে বলেন । কিন্তু পরিস্থিত ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকে এবং তা যায়েদ (রাঃ) এর জন্য সহ্যের বাইরে চলে যায়। ফলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে এবং যাইনাব (রাঃ) তাঁর মায়ের কাছে চলে যান। কয়েক মাস এভাবেই চলে যায়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই বার তাঁর রাসুলকে বলেন যে হে রাসুল আপনাকে তো এই বিষয়টি আমি আগেই জানিয়েছি যে পালকপুত্র কখনই আপনার পুত্র নয়; সে আপনার মুসলিম ভাই এবং বন্ধু, এবং পালক পুত্রের এ প্রথাকে আমি বাতিল ঘোষণা করলাম। আপনাকে আমি এসমস্ত বিষয় জানানোর পরেও আপনি এই বিষয়টা গোপন করলেন লোকজন কি বলবে এই ভয়ে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসুলকে ভালবাসার শাসনে বলছেন যে, যে বিষয়টি আমি প্রকাশ করতে চাই এবং যে নিয়ম আমি বাতিল করলাম কেন আপনি সেই বিষয়টি প্রকাশ না করে আপনার মনের ভিতরে রেখে দিলেন; বিষয়টি কেন আপনি তখনি যায়েদসহ অন্যান্যদেরকে না জানিয়ে মনের মধ্যে গোপন করে রাখলেন? কেন আপনি আমার পরিবর্তে লোকজনকে ভয় করলেন?
এর পরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এই আয়াতের কথা সবার কাছে প্রকাশ করলেন এবং যাইনাব (রাঃ) কে যায়েদ (রাঃ) কর্তৃক তালাক দেবার বেশ কয়েক মাস পরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সরাসরি নির্দেশে তাঁকে বিয়ে করেন (৩৩:৩৭)। এখন আসুন আমরা দেখি মুল অভিযোগ, তাদের ভিত্তি এবং অসারতা।
৩. অভিযোগের প্রথম ভিত্তি ও তার অসারতা
রাসুলুল্লাহর (সাঃ) উপর এই দুর্নাম আরোপ করতে গিয়ে সমালোচকরা প্রধানতঃ দুইটি তথ্যসূত্রের অপব্যাখ্যা করে- একটি কোরাআন থেকে আর একটি রাসুল (সাঃ)এর সুন্নাহ বা জীবনাচারন থেকে। এগুলো আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থাপন করব ইন-শা-আল্লাহ। তাদের উদ্দেশ্য যে কুৎসিত তার প্রমাণ হল, যদিও সুরা আহযাবের ৪, ৫ এবং ৩৮ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসুল (সাঃ)-কে সুস্পষ্টভাবে দায়মুক্ত করেছেন, তারপরেও সমালোচকরা ঔ একই আয়াতসুমহের রেফারেন্স দিয়ে সম্পূর্নভাবে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মুসলিমদের বিভ্রান্ত করে থাকে । আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে খুব সহজভাবে এগুলো এনেছেন এবং আশা করি এসব বুঝতে আপনাদের মোটেই কোন সমস্যা হবে না ইন-শা-আল্লাহ।
লক্ষ্য করুন, নীচের এই তিনটি আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কিভাবে পালকপুত্রের সংস্কৃতি বাতিল করছেন; পালক পুত্র এবং পালক পিতাকে একে অপরের মুসলিম ভাই এবং বন্ধু বলে ঘোষণা দিচ্ছেন এবং পালকপুত্রের স্ত্রীকে তালাক দেবার পর তাঁর স্ত্রীকে বিয়ে করা পালক পিতার জন্য বৈধ করছেন। এবং এই নির্দেশ শুধুমাত্র রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্য নয় সকল মুসলিমদের জন্যই করা হয়েছে।
আর তিনি তোমাদের পালকপুত্র বা পোষ্যদেরকে তোমাদের পুত্র করেননি। এগুলো তোমাদের মুখের কথা। আর আল্লাহই সত্য কথা বলেন। আর তিনিই সঠিক পথ দেখান। (সুরা আহযাবঃ৩৩-৪)
তোমরা তাদেরকে ডাক তাদের পিতৃ পরিচয়ে; আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা অধিক ন্যায় সঙ্গত, যদি তোমরা তাদের পিতৃ-পরিচয় না জান তাহলে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই অথবা বন্ধু । (সুরা আহযাবঃ৩৩-৫)
অতঃপর যায়িদ যখন তার (যাইনাবের) সাথে বিয়ের সর্ম্পক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম (তোমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম), যাতে মু’মিনদের পোষ্য পুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহ সূত্র ছিন্ন করলে সেই সব রমনীকে বিয়ে করায় মু’মিনদের জন্য কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকরী হয়েই থাকে। (সুরা আহযাবঃ৩৩-৩৭)
কিন্তু এসব সুস্পষ্ট আয়াত বা নির্দেশের দিকে বিরুদ্ধবাদীদের কোন খেয়াল নেই। তাদের অপব্যাখ্যার কেন্দ্র হল নীচের এই আয়াত যার মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে চায় যে ‘রাসুলুল্লাহ হযরত যাইনাব (রাঃ) কে বিয়ের করার ইচ্ছা বা বাসনা মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন (নাউজুবিল্লাহি মিন যালেক) এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করছেন।‘
স্মরণ কর, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করছ, তুমি তাকে বলেছিলেঃ তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর। তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন রেখেছ আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন; তুমি লোকদেরকে ভয় করছিলে, অথচ আল্লাহকে ভয় করাই তোমার পক্ষে অধিকতর সঙ্গত। (সুরা আহযাবঃ৩৭)
এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সেই বিষয় গোপনের কারণ বলছেন যা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মানুষের ভয়ে করেছিলেন; আমরা এই বিষয় এখনই তুলে ধরব।
রাসুল (সাঃ) এর বিরুদ্ধে এই বিষেদাগার বানোয়াট কেন এবং কিভাবে বলছি এবার তা দেখুনঃ
লক্ষ্য করুন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এখানে বলছেনঃ
১) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) লোকদেরকে ভয় করেছিলেন– এই ভয়ের কারণে তিনি কি করেছিলেন?
২) অন্তরে কিছু গোপন করেছিলেন – এটা গোপন করে তিনি কি করেছিলেন?
৩) তিনি যায়েদ (রাঃ) কে বলেছিলেনঃ তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর।
এখন গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন হল আপনি যদি লোকজনের ভয়ে মনের ভিতর কিছু গোপন করে আপনার কাছে বারংবার আসা কাউকে প্রত্যেকবার পরামর্শ দেন যে ‘তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ, তাঁর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ কর না এবং আল্লাহকে ভয় কর’ তবে এই গোপন করার বিষয়টা কি হতে পারে? যাকে আপনি পরামর্শ দিচ্ছেন, তাঁর স্ত্রী থেকে দূরে থাকা নাকি তাঁকে বিয়ে করার চিন্তা করা? এখন কেউ যদি অভিযোগ করে যে আপনি তাঁর স্ত্রীর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করতে চান বলেই তাঁকে বার বার বলছেন যে ‘তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ, তাঁকে তালাক দিও না এবং আল্লাহকে ভয় কর।‘ তবে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী ব্যক্তিকে আপনি পাগল বা উন্মাদ ছাড়া আর কি বলবেন?
৪) তাহলে জিজ্ঞাসা হল রাসুলুল্লাহ (সাঃ) অন্তরে কি গোপন করে রেখেছিলেন? এগুলো হল — প্রথমতঃ ‘পালকপুত্র এবং তাঁদের পোষ্য বা পালক পিতা মাতারা মুলতঃ ধর্মীয় ভাই এবং বন্ধু (৩৩:৫)’; দ্বিতিয়তঃ পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করার ব্যাপারে সামাজিক নিষেধাজ্ঞা দূরীভূত করা হল (৩৩:৩৭) এবং তৃতিয়তঃ হযরত যাইনাবএবং যায়েদ (রাঃ) এর মধ্যে তালাক হয়ে গেলে তাঁর সাথে যাইনাব (রাঃ) এর বিয়েতে কোন সমস্যা নেই (৩৩:৩৭)।
৫) জানার বিষয় হল তাহলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কেন লোকজনের ভয়ে এই বিষয়টা গোপন করে মনের মধ্যে রেখেছিলেন?
আমরা আগেই বলেছি যে তাঁর ভয়টা ছিল এই যে পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করেল মক্কার ইসলাম বিরোধী লোকজন এটাকে খারাপ চোখে দেখবে এবং তথাকথিত পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ের অজুহাতে তাঁর চরিত্রের উপর দুর্নাম রটিয়ে দ্বীনের প্রচারকে বাধাগ্রস্ত করবে। যেখানে তিনি নিজেই তাঁর পালকপুত্র যায়েদের জন্য যায়নাবকে ঠিক করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর মোহরানা পরিশোধ করেছেন (মাআরেফুল ক্বোরআন, পৃ-১০৮২) সেখানে তিনি কি করে আবার যাইনাব (রাঃ) কে বিয়ে করবেন? তিনি বিব্রতবোধ করছিলেন। তিনি যায়েদ (রাঃ) কে বিয়ে বিচ্ছেদ থেকে বিরত রেখেছিলেন এইটা ভেবে যে প্রথমতঃ সময় গড়ালেই স্বামী-স্ত্রীর এই সমস্যা চলে যাবে এবং দ্বিতীয়তঃ তালাক আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দীয় একটি কাজ।
খেয়াল করুন, এখানে যদি যাইনাব(রাঃ) এর প্রতি রাসুল (সাঃ) এর ‘ভালবাসা বা বিয়ে করার বাসনা মনের মধ্যে রাখার’ অর্থে বলা হত তাহলে তাঁকে লোকভয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হত না কারণ তিনি তো যায়েদ (রাঃ) কে বিয়ে বিচ্ছেদ না করে তাঁর স্ত্রীকে রাখার এবং আল্লাহকে ভয় করার মাধ্যমে সংসার জীবন চালিয়ে যাবার নির্দেশই দিয়েছিলেন। তিনি লোকজনের ভয়ে এবং বিব্রতকর এক পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হবার জন্যই যাইনাব(রাঃ) এর সাথে তাঁর নিজের বিয়ে এড়াতে চেয়েছিলেন, তাহলে তাঁর ‘ মনের মধ্যে ভালবাসা’ গোপন করার বিষয়টা এখানে আসল কিভাবে? এটা কি করে হয় যে একদিকে রাসুলুল্লাহ যাইনাব(রাঃ) এর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে অন্তরে ভালবাসা লুকিয়ে রেখেছেন, আর অন্যদিকে যায়নাবের স্বামী তাঁকে (যাইনাবকে) তালাক দেবার জন্য রাসুলুল্লাহ(সাঃ)এর অনুমতি চাইছেন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্বয়ং নিজে তাঁকে (রাসুলুল্লাহকে) যায়নাবের জন্য মনোনীত করার পরেও তিনি তা এড়ানোর চেষ্টা করছেন? ‘যাইনাব(রাঃ) এর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে আর অন্তরে ভালবাসা লুকিয়ে রেখে তিনি যায়েদ (রাঃ) কে তালাক না দিয়ে সংসার চালিয়ে যেতে বলেছেন’ এটা তো একজন বিকারগ্রস্ত উন্মাদও বিশ্বাস করবে না। এখানে নিশ্চয়ই অন্য কোন বিষয় কাজ করেছে যাতে রাসুলুল্লাহ এমনটি করতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা সেটা আরও স্পষ্ট করেই দেখব ইন-শা-আল্লাহ। সুতরাং নিন্দুকেরা যে বলে রাসুল (সাঃ) এর মনের মধ্যে যাইনাব(রাঃ) এর জন্য গোপন বাসনা লুকিয়ে ছিল তা সম্পূর্নটাই বানোয়াট, যুক্তিহীন এবং মিথ্যা।
কপটদের দ্বারা কোরআনের একটি সুরার সম্পুর্ন আয়াতের একটি খণ্ডিত অংশের ব্যবহার দেখে আমাদের মত সাধারণ মানুষদের মনে হতে পারে এই সমালোচকরা কোরআনকে সত্য গ্রন্থ বলে মনে করে; কিন্তু তারা কি আসলেই কোরআনে বিশ্বাস করে? মোটেই না। তারা কোরআনের কোন নির্দেশনাই মানে না; বাস্তবে তারা হয় অমুসলিম না হয় মুনাফিক কারণ রাসুল (সাঃ) কে গালি দিয়ে, তাঁর চরিত্র হনন করে কিভাবে কেউ একজন মুসলিম হতে পারে? যায় হোক, এরা কোরআনের আয়াতকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে এবং বেছে বেছে শুধু কিছু খণ্ডিত বা আংশিক আয়াত নেয় যেগুলো দিয়ে সহজেই আমজনতাকে ভুল বুঝিয়ে তা রটনার কাজে ব্যবহার করা যায়; তারা কক্ষনই পুরো আয়াত বলে না এবং এর অর্থ গ্রহণ করে না। এই তীব্র কোরাআন এবং ইসলাম বিরোধিরাই আবার কোরআনের আংশিক আয়াতকে ইসলাম এবং তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।কি প্রকাশ্য কপটচারিতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নোংরামি ও অভদ্রতা! আবার ডজন ডজন আয়াত যেগুলো সুস্পষ্টভাবে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর চারিত্রিক উজ্জ্বলতা এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে, সেগুলো সতর্কতার এড়িয়ে চলে। যেমন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসুলের চরিত্রের ব্যাপারে কোরআনে অনেক জায়গায় সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দিয়েছেন। সুরা ‘কলম’ এ মহান আল্লাহ তাঁর রাসুলের ব্যাপারে বলছেনঃ
নূন; কলমের কসম এবং তারা যা লিখে তার কসম!
তোমার রবের অনুগ্রহে তুমি পাগল নও।
তোমার জন্য অবশ্যই আছে অফুরন্ত পুরস্কার,
তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। (৬৮: ১-৪)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেখানে তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে অত্যন্ত সহজ, সরল, সাবলিল এবং স্পষ্ট ভাষায় ‘অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী’ বলছেন সেখানে এই কপটরা কোরআনের একটি খণ্ডিত বাক্য দিয়ে অপব্যাখ্যা করছে যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর মনের ভিতর যাইনাব (রাঃ) এর জন্য খারাপ বাসনা চেপে রেখেছিল যা তিনি তাঁকে [যাইনাব (রাঃ)] বিয়ে করে চরিতার্থ করেন (নাউজুবিল্লাহ বিল্লাহ মিন যালেক)। এটা ছিল রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে তাদের প্রথম অভিযোগ। এবারে আসুন দেখি দ্বিতীয় অভিযগটা কি?
৪. অভিযোগের দ্বিতীয় ভিত্তি ও তার অসারতা
দ্বিতীয়ত, তারা এর সমর্থনে বিতর্কিত, মনগড়া এবং তৈরী করা একটি হাদীসের রেফারেন্স দেয়। এটা যে জাল, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অযৌক্তিক তা আপনি অল্প চিন্তাতেই বুঝতে পারবেন। আসুন দেখি এটা বুঝা আসলেই সহজ কিনা।
তারা বলে যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কোন একদিন অপরাহ্নে যায়েদ (রাঃ) এর খোঁজে তাঁর বাসায় যান। সেদিন যায়েদ (রাঃ) বাসায় ছিলেন না। এ সময় তাঁর স্ত্রী হযরত যাইনাবঘর থেকে বের হয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে স্বাগত জানান এবং বসার জন্য অনুরোধ করেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সেটা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করেন। এ সময় মেহমানের আগমন প্রত্যাশিত ছিল না বলে যাইনাব(রাঃ) খুবই সংক্ষিপ্ত পোষাকা পরে ছিলেন (আর্মস্ট্রং, পৃ-২২৮)। অন্য সিরাতে বলা আছে তিনি হালকা বা পাতলা পোশাকে সজ্জিত (lightly clad) ছিলেন (লিংস, ২১৯)। তিনি যখন দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তখন যাইনাবের উজ্জ্বল চেহারায় এক উৎফুল্ল অভ্যর্থনা লক্ষ্য করলেন। তাঁর এ সৌন্দর্য্যে তিনি মুগ্ধ হলেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন যে, গৌরব সেই অসীম আল্লাহর যিনি মানুষের হৃদয়কে ঘুরিয়ে দেন বা হস্তান্তর করেন (প্রাগুপ্ত)। যায়েদ (রাঃ) বাসায় ফিরলে যাইনাব (রাঃ) আদ্যপান্ত সব তাঁকে জানান। এসব শুনে যায়েদ (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে যান এবং বলেন হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমার বাসায় গিয়েছেন কিন্তু ভিতরে বসেন নাই। আপনি আমার মা-বাবার থেকেও আমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। হে রাসুল, যাইনাব কি আপনাকে পছন্দ করেছে? যদি তাই হয়, তবে তাঁকে আমি আপনার জন্য তালাক দিয়ে দিব। প্রত্যুত্তরে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেন, ‘তাঁকে তালাক দিও না, তোমার কাছেই রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর’। পরের দিন যায়েদ (রাঃ) আবার ও তালাকের কথা বললে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একইভাবে তাঁকে তালাক থেকে বিরত থেকে আল্লাহকে ভয় করতে বলেন। এর পরে সংসারে ক্রমবর্ধমান অশান্তির প্রেক্ষাপটে যায়েদ (রাঃ) যাইনাবকে তালাক দিতে বাধ্য হন এবং এর বেশ কয়েক মাস পরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)তাঁকে বিয়ে করেন। মোটামুটি এই গল্পটাই সিরাত লেখক বা সমালোচনাকারীরা বলে থাকে।
এই বানোয়াট গল্প দিয়ে তারা প্রমাণ করতে চায় যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) চারিত্রিক ভাবে দুর্বল বা খারাপ স্বভাবের ছিলেন (নাউজু বিল্লাহি মিন জালিক)। আবার এটা কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলতে না চাইলেও এ গল্প শোনার পর সবার মনে রাসুলের ব্যাপারে একটা খারাপ ধারণা স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায়। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে রাসুলুল্লাহকে সর্বোত্তম আদর্শ বলে আখ্যায়িত করছেন। তাহলে তাদের এই হাদিস, গল্প বা ব্যাখ্যা কি সম্পুর্ণভাবে কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়?
বানোয়াট কেন এবং কিভাবে বলছি এবার তা দেখুনঃ
প্রথমতঃ নিন্দুকেরা বলছে যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন যায়েদের বাসায় তাঁর খোঁজে যান তখন এমন একটা সময় ছিল যখন যাইনাব (রাঃ) কোন মেহমান আশা করছিলেন না বা মেহমান আসার জন্য এটা কোন উপযুক্ত সময় ছিল না (প্রাগুপ্ত)। যায়েদ (রাঃ)ও বাসায় ছিলেন না । ফলে তিনি সংক্ষিপ্ত পোষাকে বের হয়েছিলেন যেটা দেখে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মুগ্ধ হয়ে গেলেন (প্রাগুপ্ত)। খেয়াল করুন, অসময়ে এবং স্বামী না থাকা অবস্থায় কেউ দরজায় আঘাত করলে একজন বুদ্ধিমতি পরহেজগার মেয়েমানুষ কি কখনই সংক্ষিপ্ত পোশাকে আগন্তুককে অভ্যর্থনা জানাবে নাকি শালীনতার সাথে পোশাক পরে আসবে? এবং যাইনাব (রাঃ) যেহেতু হাশিম বংশের কুরাইশ গোত্রের মেয়ে হওয়ার সাথে সাথে একজন হিজরতকারী সাহাবীও ছিলেন, কী করে তাঁর মত অভিজাত, সংযমী, বুদ্ধিমতী এবং আত্মসচেতন ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীর অনুপস্থিতিতে এবং অসময়ে হালকা এবং আকর্ষনীয় পোশাকে একজন আগন্তকের সামনে আসলেন? এটা কী আজগুবি এবং বানোয়াট নয়?
দ্বিতীয়তঃ যদি যাইনাব (রাঃ) সংক্ষিপ্ত পোশাকেই থাকতেন এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে দেখে মুগ্ধ হতেন তবে যেহেতু তাঁরা দুজন বাদে বাসায় কেউ ছিলেন না তাহলে তো এটা তাঁরা দুজন বাদে আর কারোরই জানার কথা না। কিন্তু এ কথা তো যাইনাব (রাঃ) অথবা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) অথবা কোন সাহাবী (রাঃ) এমনকি স্বয়ং যায়েদ (রাঃ)ও তাঁদের জীবিত কালীন সময়ে কক্ষনই বলেননি যে তাঁরা একে অপরকে এভাবে দেখেছে; তাঁদের মৃত্যুর ৬০/৭০ বছর পর এই তথ্য বের হল। তাহলে যারা এই গল্পটা বলছে তাঁরা দেখলই বা কোথায় থেকে আর জানলই বা কোথায় থেকে?
তৃতীয়তঃ সিরাত গুলোতে বলা হচ্ছে যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যাইনাব (রাঃ) কে সংক্ষিপ্ত পোশাকে দেখে আল্লাহর কাছে তাঁর (যাইনাবের) মন তাঁর (রাসুলের) দিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য দোয়া করলেন (প্রাগুপ্ত)। কিন্ত এই প্রার্থনার তো মোটেই কোন প্রয়োজন ছিলনা কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অনেক আগেই তো রাসুলের সাথে যাইনাবের বিয়ের কথা রাসুলকে জানিয়ে দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে তাঁকে নির্দেশনা দিয়েছেন। সহজ ভাষায়, যায়নাবকে তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাসুলুল্লাহকে দিয়েই দিয়েছেন; সুতরাং তাঁকে আল্লাহ কর্তৃক পাবার পর আবারও তাঁরই জন্য কি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার কোন যুক্তি আছে? এসব কি উন্মাদদের কথা বার্তা নয়?
চতুর্থতঃ এ হাদিস বর্ননাকারিরা বলছেন যে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কোন এক কারনে যায়েদ (রাঃ) এর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। যায়েদ (রাঃ) বাসায় ছিলেন না এবং পরে তিনি রাসুলুল্লাহর কাছে গিয়েছেন এবং কথা বলেছেন। একটা মানুষ যদি কোন কাজের জন্য আরেকটা মানুষের বাসায় যায় এবং ঘটনা যাই ঘটুক সে যদি বাসায় না থাকে এবং পরে তাঁদের দেখা হয় তাহলে তাঁরা অবশ্যই বাসায় যাবার উদ্দেশ্যের ব্যাপারে কথা বলবে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যদি যায়েদ (রাঃ) এর বাসায় কোন কাজে যেতেন তবে তার কারণটাও অবশ্যই তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই হাদিস বর্ননাকারিরা মৌলিক এ বিষয়ে আমাদের কিছুই জানাচ্ছেন না অথচ রাসুলুল্ললাহ (সাঃ) এবং যাইনাব(রাঃ) এর একে অপরকে দেখার অসার গল্প ঠিকই বলছেন। এটা কি করে সম্ভব যে তাঁরা এত কিছু জানলেন অথচ তিনজন ব্যাক্তির একজনের কাছ থেকেও তাঁদের বাসায় রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর যাবার কারণ জানতে পারলেন না এবং আমাদের জানাতে পারলেন না। এতে কি বুঝা যায় না যে তাদের মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর রাসুলের চরিত্রে কলংক আঁকা?
পঞ্চমতঃ যাইনাব(রাঃ)এর সামনে যদি এই ঘটনা ঘটে থাকে তবে একজন রাসুল কিভাবে অন্যের স্ত্রীর দিকে এভাবে নজর দেয়, বিশেষ করে তিনি যখন তাঁর পালকপিতার স্ত্রী এবং এই কারণে তো রাসুলের প্রতি তাঁর ক্ষিপ্ত হবার কথা, সম্মান কমে যাবার কথা কিন্তু তা না হয়ে, গল্পকারদের মতে, তিনি রাসুলের প্রতি আরও দুর্বল হচ্ছেন। এটা কি করে মেনে নেওয়া যায়? এর অর্থ হলো এই গল্পকাররা পরোক্ষভাবে যাইনাব(রাঃ)এর চরিত্রেও কলংক আঁকতে চায়। অন্য দিকে যাইনাব(রাঃ)যদি তাঁর প্রতি রাসুলের দুর্বলতার গল্প তাঁর স্বামী যায়েদ (রাঃ)কে বলেও থাকেন তবুও এটা কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না যে তিনি তা আল্লাহ্র রাসুল (সাঃ)কে তাঁর স্ত্রী যায়নাবকে বিয়ের প্রস্তাব দিবেন, কারণ তখনও সবাই এটাই জানে যে পালকপুত্র নিজ পুত্রের মত, তাঁর স্ত্রী পালকপিতার পুত্রবধূ এবং তাঁর স্ত্রীকে পালকপিতার জন্য বিবাহ করা হারাম। তাহলে যায়েদ (রাঃ)এটা হারাম বা নিষিদ্ধ জানা সত্বেও একজন রাসুলকে এই হারাম কাজ করার জন্য প্রস্তাব দেবেন বলে কি মনে হয়? এটা কি অকল্পনীয়, অর্থহীন এবং অবাস্তব নয়?
সুতরাং এ গল্প যে অসার, বানোয়াট এবং এডিশন এ ব্যপারে আর কোন সন্দেহের অবকাশ আছে কি?
এই সমালোচকরা মুলতঃ মনগড়া জাল হাদিসগুলোকে রেফারেন্স হিসাবে নেয়। যেগুলো বাতিল এবং যা কিনা কিছু বিভ্রান্ত অতি উৎসাহীরা খুবই সচেতন ও সুচতরতার সাথে মুল হাদীসের সাথে যুক্ত করে দিয়েছে। জাল বা মিথ্যা হাদিস সনাক্তের অনেক উপায় আছে; এ ব্যাপারে এ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম প্রফেসর ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাংগীরের ‘হাদীসের নামে জালিয়াতিঃ প্রচলিত মিথ্যা হাদীস ও ভিত্তিহীন কথা’ নামে (আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ঝিনাইদহ) একটি চমৎকার বই আছে। যায় হোক, মিথ্যা বা জাল হাদীস চেনার অনেক উপায়ের মধ্যে খুব সহজ বুদ্ধি হল এই যে, যে কোন জাল হাদীস স্পষ্টভাবে কোরআনের বিরুদ্ধে যাবে। আমরা বিস্তারিত বর্নণায় না গিয়ে এই মানদণ্ডের ভিত্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকব এবং রেফারেন্স সহ এই বিষয়টি আপনাদের সামনে তুলে ধরব ইন-শা-আল্লাহ।
৫. রাসুল (সাঃ) আল্লাহর নির্দেশ পালনে কেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন?
রাসুল (সাঃ)-এর মনে যদি যাইনাব(রাঃ)-কে বিয়ে করার বাসনাই থাকত তাহলে তো তাঁকে পালকপুত্রের সামাজিক সংস্কৃতি সংক্রান্ত ওহি নাজিল হওয়ার সাথে সাথেই তিনি বিয়ে করতে পারতেন। যায়েদ (রাঃ) যিনি তাঁর পরিবারের ক্রমাবর্ধমান অশান্তির কথা রাসুলকে বার বার বলছেন -তাঁকে পরামর্শ দিতে পারতেন যাইনাব(রাঃ)-কে তালাক দিতে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে এই নির্দেশই দিয়েছিলেন । কিন্তু আমরা কি দেখছি? তিনি আল্লাহর নির্দেশ পাওয়া সত্বেও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন এবং কিছুতেই চাচ্ছেননা যে হযরত যায়েদ (রাঃ) এবং যাইনাব(রাঃ)-এর সংসারটা ভেঙ্গে যাক। রাসুল এটা করেছেন কারণ “প্রথমতঃ তালাক দেওয়া যদিও শরীয়তে জায়েয; কিন্তু পছন্দনীয় এবং কাম্য নয়। বরং বৈধ বস্তুসুমূহের মধ্যে নিকৃষ্টতম ও সর্বাধিক অবাঞ্ছনীয়। আর পার্থিব দিক থেকে কোন কার্য সংঘটিত হওয়া শরীয়তের হুকুমকে প্রভাবান্বিত করে না। দ্বিতিয়তঃ নবীজীর (সাঃ) অন্তরে এমন ধারণা সৃষ্টি হয় যে, যদি হযরত যায়েদ তালাক দেয়ার পর তিনি হযরত যায়নবের পাণি গ্রহণ করেন, তবে আরববাসী বর্বর যুগের প্রচলিত প্রথানুযায়ী এই অপবাদ দেবে যে তিনি নিজ পুত্রবধূকে বিয়ে করেছেন” (তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, পৃ-১০৮৩)।
আর এরই ফলশ্রুতিতে তিনি প্রথম জনকে সবর করতে বলছেন এই আশায় যে সময়ের প্রয়োজনে হয়ত এসব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা জেনেছি যে পরিস্থিতি দিনে দিনে অবনতির দিকেই যাচ্ছিল। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন-আলিমুল গায়েব- তিনি তো সবই জানতেন। আর সে জন্যই তিনি তাঁর রাসুলকে কি করতে হবে তা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যা করবেন তা তো করবেনই। এবং তিনি সে কথাই বলছেন যে হে নবী আমি যা করব তাতো আপনাকে আগেই প্রকাশ করে দিলাম এবং নির্দেশ দিলাম এটা করেন কিন্তু আপনিতো তা করলেন না অথচ আমি তো এটা হওয়াবোই, আমি তো এটা সবার সামনে প্রকাশ করবই; আর আমি যা প্রকাশ করব তা আপনি লোকজনের ভয়ে গোপন করছেন কেন? সুতরাং এই ‘গোপন বিষয় প্রকাশ’ বলতে রাসুলের কামনা-বাসনাকে বুঝানো হয়নি। এটা বলতে বুঝানো হয়েছে সেই নির্দেশ যা তাঁকে অনুসরন করতে বলা হয়েছিল কিন্তু লোকনিন্দার ভয়ে তিনি তা করা থেকে বিরত থেকেছেন।
আরও সহজ করে বলতে হলে, তাঁর মনে যদি যাইনাব(রাঃ) এর প্রতি দুর্বলতা বা কামনা বাসনা থেকেই থাকত, তবে আল্লাহর নির্দেশতো ছিলই। তাঁকে বিয়ে করতে তাঁর তো কোন বাধা ছিল না। আর সেটা করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে এভাবে “শাসনের” (তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, পৃ-১০৮৩) সুরে কথা বলতেন না। কোরআনের ভাষা অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং সোজা। এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে বিষয়টা প্রকাশের কথা বলছেন এবং রাসুলকে যে বিষয়টা গোপনের কথা বলছেন তা হল সেই কথা যা তিনি ইতিমধ্যেই তাঁর রাসুলকে করতে বলা সত্বেও তিনি করেননি।
মূল কথা হলঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসুলকে দরদমাখা শাসন করছেন। কেন করছেন? কারণ, রাসুল লোকনিন্দার ভয়ে অন্তরে এমন একটি বিষয় গোপন করছিলেন (সুরা আল আহযাবঃ৩৭) যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে প্রকাশ করতে বলেছিলেন। পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করলে লোকজন আপবাদ দিবে- এই ভয় নিরসন করার জন্য ঐ একই সুরার ৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসুলকে আগেই বলে দিয়েছেন পালক পুত্ররা কক্ষনোই পুত্র নয়; তাঁরা ভাই এবং বন্ধু। সুতরাং গোপন করার বিষয়টি কামনা বাসনার নয়; বিষয়টি হল হযরত যায়েদকে হযরত যায়নাবের সাথে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ না বলা এবং তালাকের মাধ্যমে এর ফায়সালা না করা।
৬. অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ভ্রান্তিটা এসেছে সীরাত লেখকদের কাছ থেকে। কিভাবে?
সীরাত লেখকদের একটি সমস্যা হল তাঁদের অনেকই রাসুলের জীবনী লিখতে গিয়ে কিছু বিষয় খুব একটা ক্রিটিক্যালি চিন্তা করেননি । তাঁরা বিভিন্ন বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা সংযোযন করেছেন মাত্র। অনেকেই বলতে পারেন সমালোচকের মত চিন্তা করা জীবনী লেখকদের কাজ নয়। কিন্তু স্ববিরোধী উপাস্থপনা, হোক তা তথ্যের ভিত্তিতে, যে কোন মহৎ কাজকেই কি অবিশ্বাসযোগ্য এবং সন্দিহান করে তুলে না? রাসুল (সাঃ) এর জীবনীর ক্ষেত্রে অনেক লেখকই কোনটি বানোয়াট বা এডিশন তা পরীক্ষা করে দেখেননি যদিও এটার জন্য সামান্য একটু সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিই যথেষ্ট ছিল। একটি উদাহরন দেওয়া যাক। আমি শুধু এখানে একটি বিখ্যাত সীরাতের কথাই আনব যাকে আমি একটি টিপিক্যাল কেস বা নমুনাস্বরুপ উপাস্থাপন করব।
মার্টিন লিংস তাঁর সীরাত গ্রন্থে বলছেন যে রাসুল (সাঃ) মদিনায় হিজরত করার পর তিনি তাঁর আপন ফুফু, ফুফাত বোন যাইনাব এবং আব্দুল্লাহকে মদিনায় হিজরত করার জন্য নির্দেশ দেন। লেখক এখানে একথা জানান যে যাইনাব ছিলেন অসাধারন সুন্দরী। তিনি আরও লিখেন যে ফুফাত ভাইবোন যাইনাব এবং আব্দুল্লাহর সাথে রাসুল (সা:) এর খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল; তাঁরা প্রত্যেকেই একে অপরকে খুবই পছন্দ করত (লিংস, পৃ-৪০)। তার মানে রাসুল (সাঃ) নিশ্চয়ই যাইনাব (রাঃ) দেখেছেন এবং তাঁর সৌন্দর্য্যের ব্যাপারে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। প্রশ্ন হল হিজরতের আগে বা ঠিক হিজরতের পর পরই রাসুল (সাঃ)যদি চাইতেন তবে কি তিনি যাইনাব (রাঃ) কে বিয়ে করতে পারতেন না বা বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন।কিন্তু তা তিনি করেননি কারণ যাইনাব (রাঃ)কে বিয়ের কোন বাসনাই তাঁর ছিল না।
লেখক ঘটনার আর এক বর্নণায় বলছেন যে হিজরতের বেশ পরে রাসুল (সাঃ) যখন হযরত যায়েদ (রাঃ) এর সাথে যাইনাবের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন তিনিসহ তাঁর গোটা পরিবার এর বিরোধিতা করলেন। তাঁদের আপত্তি ছিল যায়েদ (রাঃ) এর বংশ নিয়ে (মাআরেফুল ক্বোরআন, পৃ-১০৮৩)। বিয়ের জন্য তাঁরা এমন এক বংশের কথা বলছিলেন স্বয়ং রাসুল (সাঃ) ছিলেন যেই বংশের একজন সদস্য এবং যাইনাবসহ তাঁর পরিবারের সবাই রাসুলকে অসম্ভব রকমের পছন্দ করতেন এবং ভালবাসতেন। প্রশ্ন হল, রাসুল (সাঃ) তখনও চাইলে কি যাইনাব (রাঃ) কে বিয়ে করতে পারতেন না বা বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতেন না? লেখক এরপরে বলছেন যে হযরত যায়েদের সাথে হযরত যাইনাবের বিয়ের পরে কোন একদিন রাসুল (সাঃ) যায়েদের বাড়িতে যাইনাবকে কে দেখে তাঁর সৌন্দর্য্যে অভিভূত হন এবং আল্লাহর কাছে তাঁর (যাইনাবের) মন তাঁর (রাসুলের) দিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য দোয়া করেন। একই বর্ননা আরও বাজেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর সিরাতে। এটার বাংলা অনুবাদ বাজারে সহজপ্রাপ্য।
দেখুন, যাইনাব (রাঃ)এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এক সাথে লালিত পালিত হয়েছেন এবং যায়েদ (রাঃ) এর সাথে বিয়ে হবার আগে অনেকবার তাঁকে দেখেছেন (সালাবি, পৃ-১৪৩০)। এমনকি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজে যায়েদ (রাঃ)এর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছেন এবং যাইনাবের সাথে কথা বলেছেন। এই দীর্ঘ ৪০ বছরে তিনি যাইনাবের সৌন্দর্য্যে পাগল হলেন না আর যায়েদ (রাঃ) বিয়ে করার পর তিনি মুগ্ধ হলেন? ভাবখানা এই রকম যে রাসুল এই প্রথম যাইনাব (রাঃ) কে দেখলেন, তাঁর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হলেন এবং বিয়ের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন এবং আল্লাহ বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। কি আজীব গল্প! এ কথা তো কোন পাগলে ও বিশ্বাস করবে না।
কিছু সীরাত লেখকরা বলছেন যে রাসুলুল্লাহ যাইনাব (রাঃ) এর সৌন্দর্য্যে অভিভূত হবার পর যায়েদ (রাঃ) বাসায় ফিরলে যাইনাব (রাঃ) তাঁকে রাসুলের এই ভাল লাগার কথা বারবার বলতে থাকেন। (ঐ একই সিরাতে বলা হচ্ছে যে) যায়েদ (রাঃ) এটা সহ্য করতে না পেরে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে আসেন এবং যাইনাবকে তালাক দেবার কথা বলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তালাক দেবার পরিবর্তে তাঁকে সবর করার পরামর্শ দেন। প্রশ্ন হল রাসুলের মনে যদি তাঁকে বিয়ে করার বাসনাই থাকত তবে কেন তিনি যায়েদ (রা) কে তালাক দেওয়া থেকে বিরত রাখলেন এবং অপেক্ষা করার পরামর্শ দিলেন এই আশায় যে সময়ের পরিক্রমায় হয়ত এসব মীমাংসা হয়ে যাবে। এই সাধারণ প্রশ্নটাও আমাদের লেখকদের মনে আসেনি।
সমস্যা কি শুধু সীরাত লেখকদের? অনেক তফসীরকারকও কি এই দোষে দোষী নয়? কিছু তফসীরে এটা বলা হয়েছে যে আল্লাহর রাসুলের মনে যাইনাব(রাঃ) কে বিয়ের জন্য যে বাসনা ছিল আল্লাহ সেই বাসনা প্রকাশ করে দেওয়ার কথাই বলছেন। এটা একটা ব্যাখ্যা যা তিনি বা তাঁরা মনে করেন; এর জন্য অন্যদের রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে কিন্তু কোরআন বা হাদিসের কোন রেফারেন্স আনা হয়নি। কিন্তু আমাদের সাধারণ জ্ঞান এবং কোরাআন হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে সহজেই প্রমাণ করা যায় যে এই ধারণা অমূলক, ভারসাম্যহীন এবং আল্লাহর রাসুলের চরিত্রের উপরে এক চরম জুলুম। ধরেই নিচ্ছি এটা সেই নিয়তে করা হয়নি কিন্তু পাঠকরা এতে বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং নিন্দুকেরা এর সুযোগ নিচ্ছে।
এভাবেই কল্প কাহিনী দিয়ে রাসুলের চরিত্রকে উপস্থাপন করে তাঁকে একজন দুর্বল চরিত্রের মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। লেখক হয়ত সেটা চাননি বা এসব কিছুকেই তিনি তাঁর ঈমান দিয়ে বিশ্বাস করেছেন এবং মেনে নিয়েছেন। কিন্তু পাঠকরা তো চিন্তা করবে, তাঁরা তাঁদের আকল বা সাধারণ জ্ঞান দিয়ে এসব বিচার করবে। আর রটনাকারীরা তো এসবের অপেক্ষায়ই থাকে।
এখন কথা হলঃ যাইনাব (রাঃ) কে দেখে রাসুলুল্লাহর মুগ্ধ হওয়া যে একটা এডিশন বা বানোয়াট গল্প এটা কি লেখকের বুঝা উচিৎ ছিল না? তাঁর মনে কি একটি বারের জন্য হলেও এই প্রশ্ন আসা উচিৎ ছিল না যে, যার সাথে তিনি শৈশবকাল থেকেই পরিচিত, একসাথে বড় হয়েছেন এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে , তাঁর আচার আচরন এবং সৌন্দর্য্যে সমন্ধে তিনি খুব ভাল করেই জানতেন। তাঁর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হতে হলে সেটা তো তিনি আগেই হতেন কেন তাঁকে (রাসুলকে) তাঁর বিয়ের (যাইনাবের) পরে মুগ্ধ হতে হবে?
এই ভাবনাটা তাঁদের মনে একটি বারের জন্যও আসল না যে যাইনাব(রাঃ) এর মত বোধশক্তিসম্পন্ন, সম্ভ্রান্ত, ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন এবং হিজরতকারি একজন সাহাবী স্বামীর অনুপস্থিতিতে এবং অসময়ে কক্ষনই এমন পোশাকে বের হবেননা যাতে তাঁর শরীরের সৌন্দয্যগুলো প্রকাশ হয়ে পড়ে। তাঁরা একটি বারের জন্যও এটার সত্যতা প্রমাণ করার প্রয়োজন মনে করলেন না যা রাসুল (সাঃ) তাঁর বেঁচে থাকাকালীন সময়ে বলেননি; তাঁর মৃত্যুর পর যাইনাব বা যায়েদ (রাঃ) এটা বলেননি এমনকি কোন সাহাবি আজমাঈন (রাঃ)ও এটা বলেননি। কে বলেছেন এবং কখন বলেছেন? বলেছেন কিছু প্রমাণিত জাল হাদিস বর্ননাকারি এবং তাও আবার রাসুলের মৃত্যুর ৭০ বছর পর। এই সকল সিরাত লেখক এবং তাফসিরকারক এর মনের মধ্যে এই সাধারণ ভাবনাটাও আসেনি যে আল্লার রাব্বুল আলামিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে যে বিয়ের জন্য নির্দেশ এবং অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন সেখানে কেন তিনি আল্লাহর কাছে সেই একই বিয়ের জন্য আবার প্রার্থনা করতে যাবেন?
এই সব সাধারণ প্রশ্ন একজন লেখকের কি আসা উচিৎ ছিল না? এবং এর উত্তরগুলো কি খুব কঠিন ছিল?
৭. হাদিস বর্নণাকারীদের বিভ্রান্তি
যে কোন হাদিসেরই একটি মুল সোর্স বা উৎস থাকে। সেই মুল উৎস থেকেই চেইনের মত যাওয়া হাদিস অনেক যাচাই করে বর্ননা করা হয়। যে কেউ মনগড়া কিছু বললেই সেটা হাদিস বা সুন্নাহ হয় না। এক্ষেত্রে হাদিস বর্ননাকারির আমল, ইলম, বর্ননার গ্রহণযোগ্যতা, রেফারেন্সের সত্যতা পুঙ্খানুপুঙ্খতার সাথে বিচার করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর এই সুন্নাত বর্ননা করার ব্যাপারে আমরা মূলতঃ দুই ধরণের বর্ননাকারি পাই। এবং এখানে মুল সোর্স বা উৎসের (primary data) সাথে পরবর্তি বর্ননাকারিদের সময় এবং মুল কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর এক বিশাল তফাৎ বা ফারাক দেখা যায়। আসুন দেখি সেটা কি?
মুহাম্মাদ বিন উমার (আল ওয়াকিদি) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর এই (জাল) হাদিসটি বর্ননা করছেন মুহাম্মাদ বিন ইয়াহইয়াহ বিন হাব্বান থেকে। অর্থ্যাৎ এখানে এই হাদিসের উৎস হল ইয়াহইয়াহ বিন হাব্বান। দেখুন, আল ওয়াকিদি বর্ননা করছেন আব্দাল্লাহ বিন আমির আল আসলামি থেকে এবং আলাআসলামি বর্ননা করছেন মুহাম্মাদ বিন ইয়াহইয়াহ বিন হাব্বান থেকে (চিমা, ২০২১)। এই বিন হাব্বানে এসেই থেমে যাচ্ছে; বিন হাব্বান কোথায় থেকে হাদিসটি সংগ্রহ করল তার কোনই উল্লেখ নাই। আমরা জেনেছি বিন হাব্বানের জন্ম হয়েছে যথাক্রমে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং যাইনাব(রাঃ) এর মৃত্যুর ৫০ এবং ৩০ বছর পরে (প্রাগুপ্ত)। হাদিস বর্ননা কালে যদি হাব্বান এর বয়স কমপক্ষে ৩০ বছরও ধরি তবে দেখা যায় যে সে এই হাদিসটি তিনি বর্ননা করছেন যথাক্রমে রাসুল (সাঃ) এবং যাইনাব(রাঃ) এর মৃত্যুর ৮০ এবং ৬০ বছর পর। অর্ধ যুগেরও বেশী পরে হাদিস বর্ননাকালে তিনি কোন উৎস বা সূত্রের উদ্ধৃতি দিচ্ছেন না এবং বলছেন না তিনি কার কাছ থেকে এ হাদিসটি সংগ্রহ করেছেন । তার মানে কি? তার মানে কি এটা দাঁড়ায় না গল্পটি এখান থেকেই শুরু হয়েছে?
অথচ রাসুল (সাঃ) এর জীবদ্দশাকালে মুল সোর্স বা উৎস হিসাবে যে দু জন সাহাবী, হযরত আনাস এবং কাতাদা (রাঃ), এই হাদিস বর্ননা করেছেন তাঁদের কারো বর্ননাতেই এই কথা নেই যে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কক্ষনও হযরত যায়েদ (রাঃ) এর বাসায় গিয়েছিলেন এবং হযরত যাইনাব(রাঃ) কে দেখেছিলেন (চিমা, ২০২১)। এসব বিশ্লেষণ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, হযরত যায়েদ (রাঃ) এর অনুপস্থিতিতে তাঁর বাসায় যাওয়া এবং হযরত যাইনাব(রাঃ) কে দেখার গল্প বানোয়াট এবং এডিশন; এর কোন বাস্তব ভিত্তি নেই।
৮. সে সময়ের সমাজ কাঠামো বদলানোর সংগ্রাম
দেখুন একটি জাহেল ও জুলুমে ভরা সমাজে ইসলাম কিভাবে তার অবকাঠামো গড়েছিল সে সম্পর্কে না জানলে আমরা অনেক কিছু মিস করব। সে সময়টাই ছিল জাহেলিয়াতকে ভেঙ্গে চুরে ভারসাম্যপূর্ন নতুন এক সুখী এবং শান্তিপূর্ন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
বিয়ে সম্পর্কিত সেই সময়ের অনেকগুলো বিপ্লবী ঘটনার দুএকটি আমাদেরকে সেই সময়ের সামাজিক রীতিনীতি বুঝতে সহয়তা করবে। রাসুল (সাঃ) নিজের পরিবারের এমনকি নিজ কন্যার বিয়ের মাধ্যমে কুসংস্কার, কু-বিশ্বাস এবং কাফেরদের মূর্খতাপূর্ন প্রথাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে এক নতুন ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেছিলেন। কিভাবে? দেখুন, আলী (রাঃ) ছিলেন তাঁর আপন চাচাত ভাই। নিজ কন্যা ফাতিমা (রাঃ)-কে তিনি তাঁর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন অথচ এখনও আমাদের এই জামানায় একটি মেয়েকে তাঁর বাবার আপন চাচাত ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়াকে খুব ভাল চোখে না দেখার এক অন্ধ কুসংস্কার বলবৎ আছে। আবার ফাতিমা (রাঃ)কে বিয়ের জন্য হযরত আবু বক্কর এবং ওমর (রাঃ) বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন (লিংস, পৃ-১৬৭) অথচ তাঁরা দুজনেই ছিলেন বয়স্ক এবং রাসুল (সাঃ) এর শ্বশুর এবং এই প্রস্তাবের কারণে আল্লাহর রাসুলের সাথে তাঁদের মোটেই কোন কোন মনোমালিন্য বা সম্পর্কের অবনতি হয়নি। এ প্রশ্ন আসেনি যে আপনারা এত বয়স্ক মানুষ হয়ে কিভাবে অল্প বয়স্কা ফাতিমাকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব করলেন? মুল কথা হল, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেইটার বাইরে কোন কিছু হচ্ছে কিনা। মদীনার ইসলামিক সামাজিক অবকাঠামোটাই ছিল সংস্কারমূলক এবং কুসংস্কারমুক্ত। আর একটি উদাহরন দিলেই বিষয়টা আরও খোলাসা হবে। মদিনায় হিজরত করার পর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা থেকে আসা এক একেকজন হিজরতকারীর সাথে মদিনায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী এক একেকজন আনসারের সাথে একটি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন করে দিয়েছিলেন। হিজরতকারীদের সাথে আনসারদের ভ্রাতৃত্ব এমন এক উচ্চতায় এবং সমতায় পৌঁছায় যে তাঁরা তাঁদের (আনসাররা) সব সম্পদ হিজরতকারীদের সাথে ভাগ বাটোয়ারা করে নিত (Khalid, page-332)
এখন ঘরবাড়ী-ছাড়া (Homeless), কর্পদকহীন, অপরিচিত হিজরতকারীদেরকে বিয়ের জন্য কেউ কন্যা দেবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এবং সম্পর্ক এতটাই গভীর হয়ে গিয়েছিল যে কারো দুইজন স্ত্রী থাকলে একজন রেখে আরেকজনকে বৈধ পক্রিয়াই হিজরতকারীকে দিয়ে দিত। এমনই এক সহযোগিতা এবং ভালবাসার বন্ধন তৈরী হয়েছিল হিজরতকারী আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) এর সাথে আনসার সা’দ ইবনে আরাবি (রাঃ) এর। প্রথম যখন আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) মদিনায় আসলেন, তখন সা’দ ইবনে আরাবি (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ ‘আনসারদের মধ্যে আমি সবচেয়ে ধনী; আমার ধন-সম্পদের অর্ধেক তোমাকে দিয়ে দেব। তুমি আমার দুজন স্ত্রীকে দেখতে পার। এদের মধ্যে যাকে তোমার পছন্দ হয়, তাঁকে আমি ছেড়ে দেব এবং ইদ্দত শেষ হবার পর তুমি তাঁকে বিয়ে করতে পার’ (প্রাগুপ্ত, পৃ-৩৩২)। যেনা-ব্যভিচারপূর্ণ একটি সমাজে এভাবেই ‘আইন, ভালবাসা, সমতা, রুচিশীলতা এবং শান্তি’- এসবকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনা হয়েছিল।
অন্যের পুত্রকে পালকপুত্র হিসাবে গ্রহণ করে এ প্রথার মাধ্যমে মক্কার মুশরিকরা অনেক হারামকে হালাল এবং হালাকে হারাম করার এক শক্ত সামাজিক নিয়ম এবং কাঠামো গড়েছিল। বৈধ এবং অবৈধকে তারা একাকার করে ফেলেছিল। পালকপুত্রের আরবিয় এই সামাজিক প্রথাকে বাতিল এবং যাইনাব (রাঃ) কে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বিয়ের মাধ্যমে তা মূলোৎপাটন এবং চিরতরে বন্ধ করে এক নতুন সমাজের যাত্রা শুরু করা হয়েছে।
৯. মুল বার্তা বা মেসেজ
সে সময় মুক্ত দাসদেরকে (হোক সে পালকপুত্র বা অন্য কেউ ) সব সময়ই নিচু চোখে দেখা হত এবং যত যোগ্যতার অধিকারিই হোক না কেন তাঁদেরকে অভিজাত শ্রেণী থেকে নিচু ভাবা হত এবং তারা ছিল সমাজে উচ্চ শ্রেণীর দয়া এবং অনুগ্রহের পাত্র (সালাবি, পৃ-১৪২৩)।
মুলতঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং যাইনাব(রাঃ) এর বিয়ের এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এর ঘোষণা দিয়েছেন। প্রথমতঃ বিয়ের ক্ষেত্রে সাদা-কালো বলে কোন কথা নেই। শরীয়ত সম্মতভাবে একজন আরবের সাথে অনারবের এবং অনারবের সাথে আরবের বিয়ে হতে পারে। অর্থ্যাৎ, সাদার সাথে কালোর এবং কালোর সাথে সাদার বিয়ে সম্পুর্ণ বৈধ । বরং যারা এর বিরোধিতা করবে তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের শক্র বলে গণ্য হবে। দ্বিতীয়তঃ পালকপুত্র কক্ষনই রক্ত-সম্পর্কীয় সন্তানের সমতুল্য নয় বরং তাঁরা হল ভাই এবং বন্ধু। নিজের ঔরসজাত সন্তানকে যেমন চাইলেই কেউ অন্যের সন্তান বলে চালিয়ে দিতে পারে না তেমনি কেউ চাইলেই অন্যের ঔরসজাত সন্তানকে নিজের সন্তান বলে ধারণ করতে পারে না। নিজ সন্তান এবং পালকপুত্র – পিতা-মাতার প্রতি তাঁদের হক বা অধিকার, দায়িত্ব-কর্তব্য, আবেগ-অনুভুতি এবং লেগাছি বা উত্তরাধিকার কখনই এক নয়।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যদি যাইনাব (রাঃ) কে বিয়ে না করতেন, তবে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত যে সত্যিই যায়েদ (রাঃ) ছিলেন তাঁর পালকপুত্র এবং যাইনাব (রাঃ) ছিলেন তাঁর পালক পুত্রবধূ। এক্ষেত্রে পালকপুত্র বাতিলের বিধান কার্যকরী হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ থাকত কারণ তখন প্রশ্ন আসত যে রাসুল (সাঃ) নিজেই যেখানে কোরআনের আয়াত নাজিল হওয়া এবং তাঁকে আল্লাহ কর্তৃক আদেশ দেওয়া সত্বেও পালক পুত্রকে বিয়ে করেননি সেখানে তাঁর উম্মতেরা কিসের উপর ভিত্তি করে এটা করবে।
১০. ভয় এবং বাসনাঃ দুটো বিপরীত বিষয়
মূলতঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যদি যাইনাব (রাঃ) কে দেখে মুগ্ধ হতেন আর তাঁকে বিয়ে করার গোপন ইচ্ছা মনে লুকিয়ে রাখতেন তবে দুইটি বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হতঃ ১) তিনি কেন একজন রাসুল হয়ে অন্যের স্ত্রীকে বিয়ে করার ইচ্ছে পোষণ করলেন এবং ২) যায়েদ (রাঃ) এর তালাকের পর যাইনাব (রাঃ) এর সাথে তাঁর বিয়েতে কোন সমস্যা নেই — আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের এই সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্বেও তিনি কেন লোকজন এবং যায়েদ (রাঃ) কে তা জানালেন না এবং তিনি কেন যায়েদ (রাঃ)কে তালাক দিতে বিরত রাখলেন । কিন্তু আমরা দেখতে পাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরাআনে সুস্পষ্টভাবে কেবলমাত্র একটি বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি অনুরাগ মিশ্রিত অভিযোগ করছেন। খেয়াল করুন, ‘অন্যের স্ত্রীকে বিয়ে করার বাসনা মনে গোপন রেখে আল্লাহর আদেশ না মানা এবং মানুষের ভয়ে আল্লাহর নির্দেশিত কোন হুকুম এড়িয়ে যাওয়া’ — দুটো বিপরীত এবং পরস্পর বিরোধী বিষয় যাদের অভিযোগ এবং প্রেক্ষাপট হবে আলাদা। কিন্তু এখানে আমরা শুধু একটি বিষয়ে অভিযোগ শুনতে বা দেখতে পাই যা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং সহজবোধ্যঃ “তুমি লোকদেরকে ভয় করছিলে, অথচ আল্লাহই সবচেয়ে বেশি এ অধিকার রাখেন যে, তুমি তাঁকে ভয় করবে (৩৩:৩৭)”
এখানে স্পষ্ট যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্বয়ং তাঁকে ভয় করার পরিবর্তে লোকদেরকে ভয় করার অভিযোগে রাসুলকে অভিযুক্ত করছেন। এবং যায়েদ (রাঃ) তাঁর স্ত্রী যায়নাবকে তালাক দেবার ব্যাপারে পরামর্শ চাইতে আসলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে যে আল্লাহর নির্দেশনা না বলে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকতে এবং আল্লাহকে ভয় করতে বলেন সেটাই ছিল এই অভিযোগের মুল এবং একমাত্র ভিত্তি। অন্যের স্ত্রীর প্রতি কোন কামনা-বাসনা লুকিয়ে রাখলে নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে তাঁর বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ আনা হত এবং এই অভিযোগ লোকদেরকে ভয় করে তথ্য লুকানোর অভিযোগ হত না। মুল কনফ্লিক্ট বা সংঘর্ষ হল আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশনা বনাম লোকজনের ভয়। আর আল্লাহ্র প্রিয় রাসুল এখানে আল্লাহ্র নির্দেশনার চেয়ে লোকদেরকে ভয় করেছিলেন যা আল্লাহ পছন্দ করেননি। কামনা-বাসনা এখানে কনফ্লিক্টের কোন অংশ নয়; কারণ তা যদি হত তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অবশ্যই তাঁর রাসুলকে অন্যের স্ত্রীর প্রতি এমন দুর্বলতার ব্যাপারে সংশোধন করতেন।
দুর্নাম আরোপকারীরা কি ভাবেন যে আল্লাহ দেখতে পাননা বা ভবিষ্যৎ ও গায়েবের খবর রাখেন না? কেন প্রশ্নটা করছি? দেখুন, এই ঘটনার কয়েকমাস আগেই যখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)যখন যাইনাব(রাঃ)এর বাসায় যায়েদ (রাঃ) এর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান, তখন এই প্রস্তাব তারা প্রত্যাখান করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসুলের পক্ষে আয়াত নাজিল করে বলেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী উক্ত নির্দেশের ভিন্নতা করার কোন অধিকার রাখে না। যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে অমান্য করে সে স্পষ্টতই সত্য পথ হতে দুরে সরে পড়ল (৩৩:৩৬)। এ আয়াত নাজিল হবার পর যাইনাব(রাঃ) বিয়েতে রাজী হন। লক্ষ্য করুন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসুলের উপর আয়াত নাজিল করে যায়েদ (রাঃ) এর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাইনাব(রাঃ)এর কাছে যেতে বলেননি; কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর প্রস্তাব প্রত্যাখান করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসুলের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর মনে যদি যাইনাব(রাঃ)এর জন্য নুন্যতম কামনা-বাসনা থাকত, তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যায়েদ-যাইনাব(রাঃ) এর বিয়েতে এইভাবে কি তাঁর রাসুলকে সমর্থন করতেন? আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত কি রাসুলের মনের খবর জানতেন না বা ছয় মাস একবছর পরে কি হবে তা কি জানতেন না? তিনি কি আলেমুল গায়েব নন?
কথা আসতে পারে যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যাইনাব(রাঃ) এর প্রতি দুর্বল হন তাঁর বিয়ের পরে যা অমূলক, মিথ্যা এবং বানোয়াট। কারণ এটা সম্পুর্নভাবে অযৌক্তিক যে আপনি ১৫-৪০ বছর ধরে কুমারী পুর্ণযৌবনা একটি সুন্দরী মেয়েকে বিয়ের সব ধরণের সুযোগ পেয়েও বিয়ে করলেন না অথচ যখনই কিনা ৪০ বছর বয়সে তাঁর আরেক জায়গায় বিয়ে হল আর আপনি তাঁর জন্য কামনা বাসনায় সিক্ত হয়ে উঠলেন। এমনকি যাইনাব(রাঃ)বিয়ের কয়েকমাস আগে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)নিজে যায়েদ (রাঃ) এর সাথে যায়নাবের বিয়ের ব্যাপারে তার সাথে সামান সামনি কথা বলেন। এ সময় যাইনাব(রাঃ)এর গোটা পরিবার এ বিয়েতে দ্বিমত করেন (মাআরেফুল ক্বোরআন, পৃ-১০৮১) এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) চাইলে সাথে সাথেই তাঁকে বিয়ে করতে পারতেন; এতে তাঁর কোন লোকজনকে ভয় করতে হত না। কিন্তু তিনি তাঁকে বিয়ের কোন চিন্তাই করেননি। প্রশ্ন হল, তখনও তিনি তার সৌন্দয্যে মুগ্ধ হলেন না আর বিয়ের পরে তাঁর সৌন্দয্যে তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন?
এটা কখনও সম্ভব নয় যে আপনি একই সাথে আপনার পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ের জন্য মুগ্ধ হবেন আবার সেই সাথে তাঁকে তালাক দেওয়া থেকে রক্ষা করবে্ন যেখানে তাঁকে বিয়ে করার ব্যাপারে আপনার প্রতি স্বয়ং আল্লাহর নির্দেশনা আছে। এটা কি কখনও আপনি মেনে নিবেন যে, আপনি আপনার সুন্দরী ফুফাত বোনের সাথে একসাথে মানুষ হয়েছেন, ৪০ বছর ধরে দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন, বিপদে আপদে একজন আরেকজনের পাশে দাড়িয়েছেন, বিয়ের সুযোগ পেয়েছেন এবং পরোক্ষভাবে আপনাকে বিয়ের প্রস্তাবও করা হয়েছে; শুধু তাই নয় আপনি তাঁর অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে তাঁর বিয়েও দিয়েছেন অথচ এখন আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে যে ঠিক তাঁর বিয়ের কয়েকদিন পরেই আপনি তাঁর সৌন্দয্যে মুগ্ধ হয়েছেন ।
এখানে অনেকের মনে হতে পারে যে তিনি বিয়ে করার বাসনা মনে রেখেছিলেন কিন্তু মান সম্মানের ভয়ে বিষয়টা এড়িয়ে গেছেন। এ প্রশ্নটা তোলা অবান্তর কারণ যায়েদ (রাঃ)এর সাথে বিয়ের আগে যাইনাব (রাঃ)কে বিয়ে করার জন্য রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কক্ষনই কোন বাধা ছিল না। এবং তখন বিয়ে করেল মক্কার মুশরিকরাও এটা নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলতো না এবং তাদেরকে তাঁর ভয় পাবারও কিছু ছিল না। এটা কি এটাই প্রমাণ করে না যে যাইনাব (রাঃ) এর প্রতি তাঁর কোন দুর্বলতাই ছিল না? বরং বিয়ের পাত্র হবার পরিবর্তে আমরা কি তাঁকে বরাবরই একজন প্রকৃত অভিভাবকের দায়িত্ব পালনকারি হিসাবেই দেখতে পাই না?
বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় যখন রাব্বুল আলামিন যায়েদ (রাঃ)কে দেওয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর এই পরামর্শের জবাবে বলেনঃ
আর স্মরণ কর, আল্লাহ যার উপর নিআমত দিয়েছিলেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলে, তুমি যখন তাকে বলেছিলে ‘তোমার স্ত্রীকে নিজের কাছে রেখে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর’(৩৩:৩৭)
খেয়াল করুন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ)এর উপরোক্ত ঐ কাজের প্রেক্ষিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলছেনঃ
তুমি তোমার অন্তরে লুকিয়ে রাখছিলে যা আল্লাহ প্রকাশ করতে চান, তুমি লোকদেরকে ভয় করছিলে, অথচ আল্লাহই সবচেয়ে বেশি এ অধিকার রাখেন যে, তুমি তাঁকে ভয় করবে। (৩৩:৩৭)
অসাধারণ নয় বরং সাধারণভাবে খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন যে এখানে আল্লাহ এবং লোকজন- এই দুই এর মধ্যে আল্লাহকে ভয় করার পরিবর্তে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মানুষকে ভয় করে অন্তরে কিছু লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর তিনি তাই লুকিয়ে রেখেছিলেন যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে আগেই প্রকাশ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবং সেটা প্রকাশ না করার কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলছেন যে তিনি তা প্রকাশ করতে চান।
বিষয়টি পরিষ্কার হয় যখন আমরা দেখি যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাসুলের লুকিয়ে রাখা বিষয়টা প্রকাশ করেন। সেটা কি? আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সেটা নিজেই বলছেনঃ
অতঃপর যায়িদ যখন তার (যাইনাবের) সাথে বিয়ের সর্ম্পক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম, যাতে মু’মিনদের পোষ্য পুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহ সূত্র ছিন্ন করলে সেই সব রমনীকে বিয়ে করায় মু’মিনদের জন্য কোন বিঘ্ন না হয়। (৩৩:৩৭)
সুতরাং এটা খুবই স্পষ্ট যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যা গোপন করে মনের মধ্যে রেখেছিলেন তা হল একটি নির্দেশনা এবং সেটা হলঃ যায়িদ যখন তার (যাইনাবের) সাথে বিয়ের সর্ম্পক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম। মুলতঃ তিনি তাঁর মনের মধ্যে যাইনাব(রাঃ) এর প্রতি ভালবাসা নয় বরং যাইনাব(রাঃ) এর সাথে তাঁর বিয়ে হবার ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দেওয়া তথ্য গোপন করেছিলেন(পৃ -১৪৩৫)।
একটি কথা বলে রাখা ভাল যে, এ বিয়ের পরে সামান্যতম মনোমালিন্যও দূরে থাক, হযরত যায়েদ (রাঃ) এর সাথে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ফায়সালা তাঁদের উভয়কেই সম্মানিত এবং মহিমান্বিত করেছে এবং তাঁরা দুনিয়া এবং আখিরাতে- উভয় জগতেই বিজয়ী হয়েছেন। তাঁদের উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর অফুরন্ত রহমত।
১১. শেষ কথা
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যে যাইনাব (রাঃ)সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করার বাসনা মনে লুকিয়ে রেখেছিলেন – এই ধরণের কোন রেফারেন্স বা ধারণা কোন প্রকারেই প্রমাণ করা যাবে না। বরং খোলা এবং মুক্তমনে রেফারেন্স, তথ্য এবং যুক্তিকে সামনে রেখে এ বিষয় নিয়ে আমরা যতই আলোচনা করব ততই দেখব যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নিজের অনিচ্ছাসত্বেও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশে একটি মুশরেকি, কুফুরি, অপসংস্ক্রতি এবং কুপ্রথাকে ভেঙ্গে এই বিয়ে করেছেন যা তাঁর চরিত্রকে আরও উজ্জ্বলতর এবং উচ্চতর করে। এ সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতগুলো পর পর দেওয়া আছে এবং যে কেউ চাইলেই এটা দেখতে পারে, মিলিয়ে নিতে পারে। এখানে জটিলতার কিছুই নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলছেনঃ
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন, আর তাতে কোন বক্রতার অবকাশ রাখেননি। (১৮ঃ১)
সুতরাং এখানে বক্রতার কিছু নেই। যারা বক্রতা খুঁজে পায় তাঁদের অন্তরের মধ্যে বক্রতা লুকিয়ে আছে। এই গাফিল, বধির, অন্ধ এবং কপটদের সম্পর্কে আল্লাহরাব্বুল আলামিন বলেই দিয়েছেন যেঃ
শপথ প্রজ্ঞাময় কুরআনের; তুমি অবশ্যই রসূলগণের অন্তর্ভুক্ত; এ কুরআন প্রবল পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু আল্লাহর কাছ থেকে নাযিলকৃত; যাতে তুমি সতর্ক করতে পার এমন এক জাতিকে যাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে সতর্ক করা হয়নি, যার ফলে তারা গাফিল। (সুরা ইয়াছিনঃ ২-৫)
নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে, তুমি তাদেরকে সতর্ক কর কিংবা না কর, উভয়ই তাদের জন্য বরাবর, তারা ঈমান আনবে না। ‘আল্লাহ তাদের অন্তর ও কানের উপর মোহর করে দিয়েছেন, আর তাদের চোখে আছে আবরণ আর তাদের জন্য আছে মহা শাস্তি।‘ (সুরা বাকারাঃ ৬-৭)
১২. রেফারেনসসমূহঃ
1. পবিত্র কোরআনুল করীম, হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ সাফী’ (রহঃ); মাওলানা মুহিউদ্দীন খান কর্তৃক অনূদিত এবং সম্পাদিত, খাদেমুল-হারামাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, ১৯৯২
2. আল্লামা ছাফিউর রহমান মোবারকপুরী, আর রাহিকুল মাখতুম (খাদিজা আখতার রেজায়ী কর্তৃক অনূদিত এবং প্রকাশিত)আল কোরআন একাডেমী লন্ডন, ঢাকা, ২০০৩
3. Lings Martin, Muhammad His life Based on the Earliest Sources, Inner Traditions, Cambridge 2006
4. Dr Ali Muhammad As Sallaabee. The Noble Life of the Prophet (peace be upon him) Translated by Faisal Shafeeq, Kallamullah.Com
5. Background to Prophet’s Marriage with Zainab Waqar Akbar Cheema, 2021 (https://icraa.org/muhammad-marriage-zainab-analysis-reports/)
6. Haykal Muhammad Husayn, Life of Muhammad (pbuh) Translated by Isma’il Razi A. al-Faruqi
7. Imam Mohibuddin Tabari, The Mothers of the Believers, Darul Ishaat, Karachi, 2010
8. ক্যারেন আর্মস্ট্রং, মুহাম্মদঃ আ বায়োগ্রাফি অব দ্য প্রফেট (অনুবাদঃ শওকত হোসেন), সন্দেশ, ২০০৮
9. প্রফেসর ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাংগীর, ‘হাদীসের নামে জালিয়াতিঃ প্রচলিত মিথ্যা হাদীস ও ভিত্তিহীন কথা’ নামে আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, ঝিনাইদহ
10. [Khalid Mohammad Khalid Man Around the Messenger (pbuh) Translated by Mohammad Mahdi Al-Sharif, Dar Al-Kotob Al-Ilmiyah, Beirut-Lebanon 2006]
(এ লেখার কোন অংশ লেখকের অনুমতি ব্যতীত বই আকারে ছাপান যাবে না। তবে লেখকের নাম সহ শেয়ার করা যাবে এবং রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। এই লেখা আরো পরিমার্জনা শেষে বই আকারে প্রকাশিত হবে ইন-শা-আল্লাহ)
Picture Courtesy: https://suwalls.com/…/dark-trees-hiding-from-the-sun-light
আমাদের অন্যান্য গবেষণা মূলক ব্লগ পোষ্ট দেখতে আমাদের ব্লগ পেইজ ভিজিট করুনঃ ব্লগ – Dr. Md. Azabul Haque
#Muhammad; #Muhammad SAW; #Muhammad Sallalahu Alaihi Assallam; #Muhammad ﷺ; #muhammad saw; # রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং হযরত যাইনাব (রাঃ) এর বিবাহ; #muhammad; #Jainab; #Muhammad PBUH; #Nabi Muhammad Sallallahu alaihi assallam; #Islam; #Muslim; #Muslims; #Ummah; #রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং হযরত যাইনাব (রাঃ) এর বিবাহ; #রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং হযরত যাইনাব (রাঃ) এর বিবাহ- একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ Marriage between Prophet Muhammad (pbuh) and Hazrat Zainab(ra): A Critical Analysis