রাসুল (সাঃ) এবং হযরত উম্মে হানি (রাঃ): একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

Share this post

( বিশ্লেষণমূলক লম্বা লেখা; সবাকে সময় নিয়ে পড়ার এবং সমালোচনা করার অনুরোধ রইল)

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এবং হযরত উম্মে হানি (রাঃ) কে নিয়ে সমালোচক, জ্ঞানপাপী এবং ইসলামের শক্রদের বাজে মন্তব্যের শেষ নেই। আসুন মুল বিষয়গুলো জেনে নিই অন্যথায় তাদের দ্বারা আমরা এবং আমাদের পরবর্তিরা বিভ্রান্ত হতে পারি ।

প্রথম পর্ব

প্রথমে প্রেক্ষাপটের উপর একটু সংক্ষপে আলোকপাত করা যাক।

রাসুল (সাঃ) এর বয়স যখন ছয় বছর তখন তাঁর মা হযরত আমিনা মারা যান এবং তাঁর দুই বছর পরে দাদা আব্দুল মুত্তালিব মারা যাবার পর তাঁর চাচা আবু তালিব তাঁকে লালন পালনের দায়িত্ব নেন। আবু তালিবের স্ত্রী ফাতিমা বালক মুহাম্মদকে এতটাই ভালবাসতেন যে তাঁর নিজের ছেলেদের উপোষ রাখলেও বালক মুহাম্মাদকে (সাঃ) কখনই না খাইয়ে রাখতেন না (লিংস, ২০০৬)।

আবু তালিবের তখন তিন সন্তান ছিলঃ তালিব, আকিক এবং জাফর। মেয়েদের মধ্যে ছিলঃ উম্মে হানি ফাকিতাহ, আতিকাহ এবং বারাহ (প্রাগুপ্ত)। বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) দায়ীত্বের সাথে তাঁর এই চাচাত ভাই বোনদের সাথে বড় হতে থাকেন । সংসারে অভাব থাকলেও স্নেহ মায়া মমতার কোন ঘাটতি ছিল না।

আবু তালিব দরিদ্র ছিলেন এবং সংসার চালাতে তাঁর বেশ কষ্ট হত। বালক মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর চাচাকে সংসার চালানোর ব্যাপারে যতটুকু পারতেন সাহায্য করতেন। এ কারণে তিনি বকরি বা মেষ চরানোর কাজ করতেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি মক্কার পাহাড়, এবং উপত্যকার ঢালু পথগুলোতে একা একাই নির্জনে দিনের পর দিন সময় কাটান। তাঁর বয়স যখন নয় বছর কার কারও মতে ১২ বছর, তখন ব্যবসায় সাহায্য করার জন্য তাঁর চাচার সাথে তিনি একদল ব্যবসায়ীর সাথে বসরা হয়ে সিরিয়া যান (লিংস, ২০০৬)। যদিও তাঁর চাচা তাঁকে নিতে রাজী ছিলেন না তবুও তাঁর অনুরোধে তাঁকে নিতে হয়েছিল। এ দলে তিনিই ছিলেন সর্ব কনিষ্ঠ। এ ঘটনা প্রমান করে যে বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) একদিকে যেমন তাঁর চাচার জীবিকা অর্জনে সাহায্যে ব্যস্ত থাকতেন অন্যদিকে তেমনিই পাহাড়, পর্বত এবং উপত্যকায় এক নিরব এবং আধ্যাত্বিক জীবনের সন্ধান করতেন।

তরুণ মুহাম্মাদ (সাঃ) অত্যন্ত চরিত্রবান, সত্যবাদী, বুদ্ধিমান এবং পরপোকারী হওয়াই তাঁর চাচা আবু তালিব তাঁকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। তাঁর আমানতদারিতা, ব্যবহার এবং লেনদেনে স্বচ্ছতার জন্যই মক্কার বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, মুশরিক সকলেই তাঁকে আল-আমীন উপাধি দিয়েছিল। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, মুজলুমের প্রতি ভালবাসা এবং প্রত্যেককে নিয়ে কাজ করার এক চরম চারিত্রিক উৎকর্ষতা থেকেই তিনি দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে হিলফুল ফুজল গঠন করতে পেরেছিলেন। তিনি যেমন আবু তালিবের ঘরে ছিলেন শান্তি এবং ভালবাসার নিদর্শন ঠিক তেমনি বাইরে ছিলেন সবার জন্য এক আশার আলোক বর্তিকা।

সমালোচক এবং মুনাফিকদের প্রথম অভিযোগ উম্মে হানির (রাঃ) সাথে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সম্পর্ক নিয়ে, তারা এটা নিয়ে প্রায়ই বাজে কথা বলে থাকে। বেশ, তাঁর যদি কোন চারিত্রিক ক্রটি থাকত, তবে কি তিনি কখন আবু তালিব, তাঁর স্ত্রী ফাতিমা, তাদের অন্যন্য কন্যা এবং তালিব ও জাফরের চোখ এড়াতে পারতেন? তাঁর চাচী এবং চাচার মন এতটা জয় করতে পারতেন? এটা একাধিক সিরাত থেকে প্রমাণিত যে আবু তালিব এর গোটা পরিবার মুহাম্মাদকে (সাঃ)—শুধু আবু তালিবের ভাই আব্দুল্লাহর সন্তান হবার কারণে নয় বরং তরুণ মুহাম্মাদকে (সাঃ) তাঁর চারিত্রিক সৌন্দযের কারণেই তাদের সন্তানদের চাইতেও বেশী ভালবাসতেন। এর প্রমাণ আমরা কিছুক্ষণ পরেই দেব ইন-শা-আল্লাহ। মুহাম্মাদের (সাঃ) চারিত্রিক সততার ব্যাপারে কোন সন্দেহ তো দুরের কথা, বরং চরম আস্থা ছিল বলেই সকল শ্রেণির লোকই তাঁকে তাদের ভালবাসা এবং বিশ্বাসের সর্বোচ্চ মনিকৌঠায় স্থান দিয়েছিলেন। সে সময় যদি তাঁর চারিত্রিক কোন সমস্যা থাকত তবে প্রথমত সেটাতো শুধু তাঁর চাচাত বোন উম্মে হানির প্রতি না হয়ে অন্যদের প্রতিও থাকত এবং তা কোন না কোন প্রকারে প্রকাশ পেয়ে যেত। আর যদি অত্যন্ত গোপনে শুধু উম্মে হানির সাথে তাঁর কোন অনৈতিক সম্পর্ক (নাউজুবিল্লাহ) থাকত তবে এই রকম একটি ঘন বসতিতে তা প্রকাশ পেয়ে যাওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়? অন্ততঃ উম্মে হানির মা এবং তাঁর অন্য তিন ভাই এবং দুই বোনদের চোখ এড়ানো কোন প্রকারেই সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে উম্মে হানি বা তাঁর অন্যান্য ভাই এবং বোন সারা জীবনে একটি বারের জন্যও তরুণ মুহাম্মাদ বা রাসুল মুহাম্মাদ (সাঃ) এর বিরুদ্ধে কোন কথা বলেননি; এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও না; বরং তিনিসহ তাঁর পরিবারের সবাই আল্লাহর রাসুলকে (সাঃ) তাঁর মৃত্যুর আগে ও পরে সর্ব্বোচ্চ সম্মান করেছেন, ভালবেসেছেন, নিরাপত্তা দিয়েছেন এবং তাঁদের জান এবং মাল কোরবান করেছেন। এমনকি উম্মে হানির স্বামী হুবাইরাহ সারা জীবনে কখনই উম্মে হানি বা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সম্পর্কের ব্যাপারে কখনই কোন নেতিবাচক কথা বলেননি।

তাহলে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? আল্লাহর রাসুলের চরিত্রের ব্যপারে উম্মে হানি, উম্মে হানির মা, বাবা, বোন, ভাই, স্বামী, পাড়া, প্রতিবেশি, আত্মীয়,স্বজন, সমাজ সবাই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে সে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী আর তাঁর মৃত্যুর ১০০০ থেকে ১৫০০ বছর পরে জ্ঞানপাপীরা তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এটা জানা দরকার যে, রাসুল (সাঃ) এবং উম্মে হানি বা আলি (রাঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশধর যারা হযরত ইবরাহিম (আঃ) এর উত্তরাধিকারী এবং তাদের বংশে বিবাহযোগ্য ছেলে মেয়েদের মধ্যে শালীনতা বজায় রাখা ছিল পারিবারিক নিয়ম এবং ঐতিহ্য।

তাঁর নৈতিক চরিত্র নিয়ে এমনকি সে সময়ে মক্কায় তাঁর চরম শক্ররাও এই অভিযোগ করেনি। তিনি যখন কোরানের কথা বলেছেন তাঁকে ইসলামের শক্ররা জাদুকর বলেছে, পাগল বলেছে, সমাজ-বিদ্রোহী বলেছে, কিন্তু তাঁর চরিত্র নিয়ে কখনই কথা বলেনি। কিন্তু আজকের কাফের, মুশরিক, মুনাফিক, সংশয়বাদী আর সমালোচকরা তাদেরকেও ছাড়িয়ে গেছে। একটি চারিত্রিক সত্য যখন কোন এক যুগে শক্র মিত্র সবার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, সেটা নিয়ে আর বিতর্কের কোন সুযোগ থাকে না। অথচ আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) সর্বোচ্চ নৈতিক চরিত্র এবং সততা তাঁর যুগের সবার দ্বারা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য হলেও এটা নিয়ে সভ্য এবং শিক্ষিত নামধারী জ্ঞানপাপীদের কুৎসা থেমে নেই।

মুহাম্মাদ (সাঃ) আট বছর বয়সে আবু তালিবের পরিবারে লালিত পালিত হতে শুরু করেন। পরিবারের অনান্য সদস্যদের মধ্যে আকিলের বয়স ছিল তের কি চৌদ্দ, তালিব ছিল মুহাম্মাদের সমবয়সী, আর জাফরের বয়স ছিল চার বছর। মুহাম্মাদ বাচ্চাদের খুবই প্রিয় ছিলেন এবং তিনি তাদের সাথে খেলতে ভালবাসতেন (লিংস, ২০০৬)। বুদ্ধিমান এবং সুদুর্শন জাফরের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল সবচেয়ে বেশী যা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত টিকে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই, অন্যান্য চাচাত ভাই বোনদের মতই উম্মে হানির সাথে তাঁর স্নেহ, মমতা এবং আন্তরিকতা গড়ে উঠেছিল (প্রাগুপ্ত)।

সমালোচকদের দ্বিতীয় প্রশ্ন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর উম্মে হানিকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া নিয়ে? যদিও আসলেই তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিনা এ ব্যাপারে মতভেদ আছে এবং আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ থেকে আমরা জানতে পাই যে এই হাদিসটিকে অনেকেই ছহী বলে স্বীকার করেন না। যায় হোক, আমরা জানি যে, তিনি একই পরিবারে তালিব,উম্মে হানি, আতিকাহ, বারাহ, জাফর এবং আকিকের সাথে ভাই-বোনের মত বড় হয়েছেন। বিয়ের জন্য প্রয়োজন উন্নত স্বভাব, ভাল বংশ, শাররিক সামর্থ্য এবং বিয়ের বয়স। তরুণ মুহাম্মাদের ছিল সর্বোত্তম চরিত্র, সর্বোত্তম বংশ, সবচেয়ে সুদর্শন চেহারা এবং বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স। আবু তালিবের কন্যাদের মধ্যে উম্মে হানির বিয়ের বয়স হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই তরুণ মুহাম্মাদ (সাঃ) চাচা আবু তালিবকে তাঁর সাথে উম্মে হানিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। উম্মে হানি ছিলেন পিতা মাতার অনুগত উন্নত চরিত্রের এক তরুণী আর মুহাম্মাদ (সাঃ) ছিলেন সর্বোত্তম নৈতিক চরিত্রের অধিকারী এক তরুণ । সুতরাং তাঁর বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটা একটি সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা এবং কৃতজ্ঞতাবোধের পরিচয়। বরং প্রস্তাব না দেওয়াটাই অস্বাভাবিক কারণ এতে পারিপার্শ্বিকতার প্রতি তাঁর এক ধরনের অসংবেদনশীলতা প্রমাণ হতো এবং তাঁর দায়িত্বশীলতার ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠত। হ্যাঁ, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা থাকাটা জরুরী; সেটা খুব ভাল না থাকলেও অন্ততঃ একটা সংসার চালানোর মত সামর্থ্য তাঁর ছিল। তিনি বনি সা’দ গোত্র ছাড়াও ‘কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কার বিভিন্ন লোকের বকরি চরাতেন’ (মোবারকপুরী, ২০০৩) এবং ব্যবসার কাজে অন্যদের সাহায্য করে কিছু রোজগার করতেন ।

আগেই বলা হয়েছে যে, উম্মে হানি ছিলেন চারিত্রিক দিক দিয়ে উন্নত, ভদ্র এবং বুদ্ধিমতি। তরুণ মুহাম্মাদের (সাঃ) উম্মে হানির এসব গুণের প্রতি সম্মান ছিল। পিতা-মাতার অবর্তমানে আবু তালিব মুহাম্মাদ (সাঃ) কে লালন পালন করেছেন এবং তিনি ছিলেন সেই পরিবারেরই একজন সদস্য। সুতরাং তাঁর চাচা, চাচী এবং চাচাত ভাই বোনদের সাথে ঘনিষ্ঠ আত্মিক সম্পর্কের কারণেই তিনি এই প্রস্তাব দিয়েছেন। এবং এটাই তো স্বাভাবিক। বরং অভাবের সংসারে নিজের বিবাহযোগ্য চরিত্রবতী চাচাত বোন থাকতে অন্য কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়টাই কি স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধে যায় না? এই প্রস্তাব দেওয়াটা যে কারোরই ভদ্রতার চিহ্ন এবং অধিকারও বটে। যেটা স্বাভাবিক, ন্যায় এবং হালাল সেটাকে অস্বাভাবিক, অন্যায় এবং হারাম বানানোর মনোবৃত্তিটা হল এই জ্ঞানপাপীদের অসুস্থ ও বিকৃত মানসিকতার লক্ষণ।

আবু তালিব এই প্রস্তাবে রাজী হন নাই এই কথা বলে যে তিনি অনেক আগে থেকেই উম্মে হানি ফাকিতাহর জন্য মাখজুম গোত্রে তাঁর ভাগিনা হুবাইরাহকে মনোনীত করে রেখেছিলেন যার প্রভাব এবং প্রতিপত্তির সাথে ছিল কাব্য প্রতিভা (লিংস, ২০০৬)। মুহাম্মাদ মৃদুভাবে এই সিদ্ধান্তে অনুযোগ করলে আবু তালিব বললেনঃ ‘তারা তাদের মেয়েকে আমাদের সাথে বিয়ে দিয়েছেন এবং একজন উদার মানুষকে উদারতা দিয়েই প্রতিদান দেওয়া উচিত’ (প্রাগুপ্ত)। বলে রাখা ভাল যে আবু তালিব স্বয়ং এই গোত্রে বিয়ে করেছিলেন। এ যুক্তি মুহাম্মাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না কারণ ইতিমধ্যেই আবু তালিব তাঁর দুই কন্যা আতিকাহ এবং বারাহকে মাখজুম গোত্রে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর চাচার এই কথাকে অত্যন্ত ভদ্রভাবে নিলেন যে আসলে বিয়ের মত অবস্থা তখনও তাঁর হয়নি। এর পর আবু তালিব উম্মে হানিকে হুবাইরাহর সাথে বিয়ে দেন। উম্মে হানি তাঁর বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নেন এবং বিয়ের পরে সুখে শান্তিতেই বসবাস করতে থাকেন। এ থেকে বুঝা যায় যে আবু তালিব তাঁর মেয়ের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন এবং যাতে করে তরুণ মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং উম্মে হানি কোন সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সজাগ ছিলেন, যদিও এ ধরণের সম্পর্ক মুহাম্মাদ এবং উম্মে হানির জন্য তা ছিল কল্পনাতীত। যায় হোক, এর কিছুদিন পরেই হযরত খাদিজার (রাঃ) সাথে তরুণ মুহাম্মাদের (সাঃ) বিয়ে হয়।

৬১৯ খৃষ্টাব্দে প্রথমে আবু তালিব এবং পরে হযরত খাদিজার (রাঃ) মৃত্যু হলে আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) জীবনে এক বিশাল ধাক্কা আসে (হাইকল, ১৯৩৩)। আবু তালিব তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে হেফাযত করতেন, তাঁর জন্য অন্যদের সাথে ঝগড়া বিবাদ করতেন এবং শক্রতার ঝুকি নিতেন (মোবারকপুরী, ২০০৩)। তিনি একজন বুদ্ধিমান, সম্মানিত, উঁচু বংশীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি।

(অধিকাংশের মতেই) আবু তালিব মুসলিম ছিলেন না এবং মুহাম্মাদের (সাঃ) এর প্রতি তাঁর দূর্বলতার কারণ ছিল যতটা না তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র হওয়া তাঁর চেয়ে তাঁর সর্বোত্তম চরিত্র। শুধুমাত্র ভ্রাতুষ্পুত্র হবার কারণে কি একজন অমুসলিম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে এভাবে আগলে রাখতে পারে? রাসুল (সাঃ) এর চরিত্রে কোন ক্রটি থাকলে তিনি কি এসব করতেন বলে মনে হয়? প্রমাণ? সীরাতে এবং হাদিসে অনেক প্রমাণ সহজেই পাওয়া যাবে। এখানে শুধু দুটো প্রমাণ দেওয়া যাক।

হযরত হামজা (রাঃ) এবং উমর (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণের পর মুসলিমদের সংখ্যা বিস্তার রোধে মক্কার মুশরিকরা বনু হাশিম তথা রাসুল (সাঃ) এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব এর বংশধরদের বিরুদ্ধে একতরফা কিছু চুক্তি করল যার সারমর্ম ছিল এই যেঃ ‘মুহাম্মাদকে তাদের হাতে মৃত্যুর জন্য হস্তান্তর না করা পর্যন্ত মুশরিকরা তাঁদের সাথে সকল প্রকার লেনদেন স্থগিত রাখবে’। এই চুক্তিগুলো তারা মন্দিরের ছাদের ভিতর দিকে বা সিলিং এর সাথে ঝুলিয়ে রেখেছিল। আবু তালিব এতে আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) বেঁচে থাকা নিয়ে ভয় পেয়ে যান। রাসুলের (সাঃ) নিরাপত্তায় তিনি তাঁর এবং তাঁর ছেলেদের বিছানায় মুহাম্মাদ (সাঃ) ঘুমাতে রেখে তারা এক এক জন এক এক দিনে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর বিছানায় রাত্রে ঘুমাতেন। তিন বছর এভাবেই মুসলিমরা ধৈয্যের পরীক্ষা দিতে থাকে। এক পর্যায়ে বনু হাশিম গোত্রের কিছু মানুষ এর বিরোধিতা করে বসে। তাঁরা এই চুক্তির কাগজপত্র খুলে ফেলে এবং দেখতে পায় যে পোকাতে এই চুক্তির সব তথ্য খেয়ে ফেলেছে। অন্য বর্নণায় এসেছে, খোদা পোকার মাধ্যমে তাঁর নামগুলো মুছে দিয়েছেন (ইবনে কাছীর, পৃ-২৮)। আল্লাহ তাঁর রাসুলকে (সাঃ) এই একতরফা দলিলের মধ্যে কি পরিবর্তন এনেছিলেন তা আগেই জানিয়েছিলেন এবং আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তাঁর চাচা আবু তালিবকে এই দলিলপত্রের নতুন ও পুরাতন বিষয়গুলোর কথা জানান (প্রাগুপ্ত)।

সংশয়বাদীরা বলে এটা মুহাম্মাদ বা তাঁর লোকজন রাতের আঁধারে গিয়ে লিখে এসেছিলেন। আর মক্কার মুশরিকরা বলেছিল এটা মুহাম্মদের একটা যাদু মাত্র। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় হলো মুহাম্মাদ (সাঃ) তাদের দলিলের লিখিত কথা ছাড়াও তাদের অলিখিত গোপন দুরভিসন্ধিসূমহ উন্মোচন করে দিয়েছিলেন যা শুধুমাত্র ঐ মুশরিকরাই জানত যা তাঁদের অন্তঃকরণের মধ্যে ছিল। কারণ তারাই প্রকাশ্যে এবং গোপনে এসব ষড়যন্ত্র করেছিল। যেমনঃ মুশরিকদের বিশ্বাসঘাতকতার রেফারেন্স বা সূত্র, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার তথ্য এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্যায় গণবিক্ষোভ এর বিষয়গুলো (প্রাগুপ্ত)।

যায় হোক, আবু তালিব এটা শুনে মক্কার মুশরিক এবং তাঁর গোত্রের মুহাম্মাদ-বিরোধীদের কাছে গেলেন এবং বললেনঃ ‘আমি তোমাদের কাছে সুবিচারের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, যে কখনই আমাকে মিথ্যা বলেনা, আমাকে বলছে যে তোমাদের দলিল বা চুক্তিতে আল্লাহর কোন অংশ নেই; আল্লাহ তাঁর নাম সেখান থেকে মুছে দিয়েছেন এবং তিনি তোমাদের বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার তথ্য এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্যায় গণবিক্ষোভ এর বিষয়গুলো প্রকাশ করে দিয়েছেন (প্রাগুপ্ত)। যদি আমার ভ্রাতুস্পুত্র সত্যি বলে তবে আমাদের শেষ ব্যাক্তির মৃত্যু পর্যন্ত আমরা তাঁকে রক্ষা করব; আর যদি মিথ্যা বলে তবে আমি তাঁকে তোমাদের হাতে তুলে দিব- তোমারা তাঁকে খুন অথবা ক্ষমা যা খুশী তাই করতে পার (ইবনে কাছীর, পৃ-২৯)’। আবু তালিবের এই শর্তে সবাই এক বাক্যে রাজী হল। এরপরে আবু তালিব তাঁদের সেই দলিল বা চুক্তি খুলতে বললেন এবং সেই একই দলিল খুললে দেখা গেল, মুহাম্মাদ (সাঃ) যে সব পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন দলিলে সবকিছু ঠিক সেভাবেই আছে। কিন্তু মক্কার মুশরিক এবং ইসলাম বিরোধীরা তখনই আল্লাহর রাসুলকে (সাঃ) জাদুকর বলে অভিহিত করল।

এই ঘটনার পরে এবার মক্কার কুরাইশের কমপক্ষে ৪০ জন নেতা (লিংস, পৃ-৯০) বনু হাশিম এবং বনু আবু তালিব – এই দুই গোত্র এবং বংশের ( ইবনে কাছীর, পৃ-৪৪) বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার একই রকম একতরফা দলিল তৈরি করল এবং তারা এবার এটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সবার সামনে কাবার ভিতরে সুরক্ষিত স্থানে রেখে দিল। উভয় গোত্রের লোকজন আবারও এর বিরোধিতা করলে মক্কার মুশরিকরা তাদের প্রতিহত করতে উদ্যত হল। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তাঁর চাচা আবু তালিবকে আগেই বলেছিলেন যে এই দলিলের অসৎ কথা, বয়কটের বিষয়সমূহসহ সকল মিথ্যা মুছে দিয়ে আল্লাহতায়ালা কেবল তাঁর সাথে যুক্ত নামগুলো রেখেছেন। আবু তালিব কুরাইশের এই নেতাদের আবারও একই কথা বললেন যে, তোমরা তোমাদের দলিল নিয়ে এসো এবং মুহাম্মাদ যদি মিথ্যা কথা বলে তবে আমি তাঁকে তোমাদের হাতে সমর্পন করব ( প্রগুপ্ত, পৃ-৪৫)। মুশরিকরা একবাক্যে সবাই রাজী হল, কিন্তু তারা তাদের দলিলগুলো বের করলে যখন তা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কথার সাথে দলিলের লিখা মিলে গেল তখন ইসলাম এবং আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) এর প্রতি তাদের শক্রতা আরো বেড়ে গেল ( প্রগুপ্ত, পৃ-৪৫)।

খেয়াল করুন, আবু তালিবের বিশ্বাসের গভীরতা যা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রতি তাঁর ভালবাসাকে প্রশান্ত মহাসাগরের মতই গভীর থেকে গভীরতর করেছে। এ বিশ্বাস এবং এ ভালবাসা এসেছে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর চরিত্র থেকে যিনি ছিলেন নিষ্পাপ এবং সত্যবাদীতার সর্বোচ্চ মাপকাঠি।

তৃতিয়তঃ, সমালোচক, মোনাফেক এবং কিছু জ্ঞানপাপীরা সবচেয়ে কুৎসিত প্রশ্ন তুলে রাসুলুল্লাহর (সাঃ) শবে মেরাজের রাত্রে উম্মে হানি (রাঃ)-এর বাড়ীতে রাত্রের কিছু অংশ থাকা নিয়ে। তারা তাঁদের বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের এক বানোয়াট গল্প তৈরি করে। আসুন সংক্ষেপে এ ঘটনার ব্যাকগ্রাউন্ড বা প্রেক্ষাপট নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। অন্যথায়, বিষয়টা স্পষ্ট হবে না।

আবু তালিবের মৃত্যুর পরে কি আগে তাঁর স্ত্রী ফাতিমা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং এর পরেই উম্মে হানি (রাঃ) ইসলামে দাখিল হন। আর তাঁর স্বামী হুবাইরাহ আল্লাহর একত্বের ব্যাপারে সম্পুর্নভাবে অসংবেদনশীল থাকেন । কিন্তু তা সত্বেও হুবাইরাহ আল্লাহর রাসুল (সাঃ) কে তার বাসায় স্বাগত জানাতেন এবং নামাজের সময় হলে বাসার সব মুসলিমরা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর ইমামতিতে জামাতে এক সাথে নামাজ পড়তেন।

দুই তিন মাসের ব্যবধানে আবু তালিব এবং হযরত খাদীজা (রাঃ) মারা যাবার পর আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়না যে এ দুটো পরিবার কেমন সমস্যার মধ্যে ছিল। আল্লাহর রাসুলের তিন কন্যা, বালক আলী এবং পালকপুত্র জায়েদ—এই ছয় জন বাচ্চাদের দেখাশুনা করার মত কোন মহিলা ছিল না । আবার, আবু তালিবের মৃত্যুর পর তাঁর সন্তান আকিল, তালিব এবং আবু তালিবের স্ত্রী ফাতিমা অনেকটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। দুটো সংসারের এই যখন অবস্থা ঠিক তখনই আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এবং তাঁর সাথীদের এর উপর অমুসলিমদের নির্যাতন এবং অপমান চরম মাত্রায় পৌঁছে। একদিন এক অমুসলিম পথচারী আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) দরজায় দাঁড়িয়ে তাঁর রান্নার পাত্রে পচানো গলিত আবর্জনা ছুড়ে মারলেন (মোবারকপুরী, ২০০৩)। উম্মে জামিল-আবু লাহাবের স্ত্রী প্রায়ই আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) দরজায় আবর্জনা ফেলে দিত আর আবু লাহাব তো একদিন আল্লাহর রাসুলের নিজের বাড়ীর বারান্দায় নামাজের সময় তাঁর দিকে রক্তমাখা পচা নাড়ি ভুড়ি নিক্ষেপ করল। এর পরে এই সময়েই আল্লাহর রাসুল (সাঃ) তায়েফে ইসলামের দাওয়াত দিতে গেলে সেখানকার গোত্র সর্দাররা তাঁকে পাগল সাজিয়ে উচ্ছৃঙ্খল বালক এবং দুর্বত্তদের উস্কানি দিয়ে তাঁর উপর লেলিয়ে দিয়েছিল। তাঁদের পাথরের আঘাতে আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) দুই পা রক্তাক্ত হয়ে তাঁর জুতো রক্তে ভরে গিয়েছিল (মোবারকপুরী, ২০০৩)।

আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) সহযোগীদের অবস্থা ছিল আরও খারাপ। মুশরিকদের হাত থেকে বাঁচতে প্রায় ৮০ জনের একদল মুসলিম দেশান্তরিত হয়ে আবিসিনিয়াই (বর্তমান ইথিওপিয়া) হিজরত করেন (লিংস, পৃ-৮৩)। হযরত উমর (রাঃ) এর মত সাহাবীদের জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। আর আবু বকর (রাঃ) তো অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হাবশা অভিমুখে হিজরত করার জন্য রওয়ানা হয়ে যান যদিও পথের মধ্যে বেদুইন গোত্র প্রধান ইবনে দাগানা নিজের নিরাপত্তায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন (মোবারকপুরী, পৃ-১৩৫)। আল্লাহর রাসুল (সাঃ), তাঁর সাহাবী এবং বনু হাশিম ও বনু তালিব গোত্রের কতিপয় সাহায্যকারীর জীবনের নিরাপত্তা একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে।

এরকম একটা পরিস্থিতিতে কোন একদিন সন্ধ্যারাতে (এশার নামাজ) একসাথে জামাতে নামাজের পর উম্মে হানি আল্লাহর রাসুলকে (সাঃ) তাঁর বাড়িতে রাত্রিতে থাকার জন্য দাওয়াত করেন। সেই দিন তাঁর বাড়ীতে তাঁর মা, দুই ভাই এবং তাঁর স্বামী ছিলেন। সবাই নামাজ সেরে খাওয়া দাওয়ার পর আল্লাহর রাসুল (সাঃ) অল্প সময়ের জন্য ঘুমিয়ে তাদেরকে না ডেকে মসজিদে যান কারণ তিনি রাত্রিতে কাবায় যেতে এবং সময় কাটাতে ভালবাসতেন। সেখানে যাবার কিছুক্ষন পরেই তাঁর ঘুম আসে এবং তিনি হিজরেই ঘুমিয়ে পড়েন। তাঁর ঘুমন্ত অবস্থাতেই অশ্বারোহী হযরত জিবরাঈল (আ:) এর আগমন ঘটে এবং সেই শব্দে তিনি ঘুম থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে পড়েন। এর পরে মেরাজ বা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত্যের ঘটনা ঘটে। সে ঘটনা আমরা তাঁর জীবনীতে বিস্তারিত জেনে নিতে পারব।

মুসলিম অথবা অমুসলিম লেখক কর্তৃক রাসুল (সাঃ)-এর যে কোন সিরাত থেকে আমরা একটি বিষয় খুব সহজেই দেখাতে পাব যে হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর সাথে রাসুলুল্লাহর (সাঃ) বিয়ের আগে, পরে এমনকি তাঁর [হযরত খাদীজা (রাঃ)] মৃত্যুর পরে—এই তিন সময়েই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আবু তালিবের পরিবারের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আর আবু তালিব এবং হযরত খাদীজা (রাঃ) প্রায় একই সময়ে মারা যাবার কারণে আবু তালিবের স্ত্রী, সন্তান, কন্যা এবং তাঁর স্বামী হুবাইরাহ মিলে যে পরিবার, সেই পরিবারে রাসুলুল্লাহও (সাঃ) ছিলেন একজন অনিয়মিত সদস্য এবং সেটা মোটেই নতুন কিছু ছিল না। মনে রাখতে হবে যে আবু তালিবের সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান হযরত আলী (রাঃ) লালিত-পালিত হতেন রাসুলুল্লাহর (সাঃ) পরিবারে। এমনকি উম্মে হানি এবং আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) আলাদা আলাদা যায়গায় বিয়ে হলেও আবু তালিব রাসুলুল্লাহকে (সাঃ) রাতের পর রাত নিজের কক্ষে রেখেছেন মুশরিকদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যা আমরা একটু আগেই বলেছি। তিনি নিজের এবং তাঁর ছেলেদের জীবন হুমকির মুখে রেখে তাঁকে নিরাপত্তা দিয়েছেন । এসব কি প্রমান করে না যে তাঁরা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং বিপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো এবং দুঃখ-কষ্টগুলো শেয়ার করা ছিল স্বাভাবিক পারিবারিক ব্যাপার? এসব কি তাঁদের দৃঢ় পারিবারিক বন্ধনের কথা স্পষ্ট করে তুলে না?

সুতরাং, চাচী, চাচাত ভাই, চাচাত বোন উম্মে হানি এবং হুবাইরাহকে নিয়ে যে পরিবার — সেই পরিবারে যাওয়া, তাঁদের খোঁজ-খবর নেওয়া এবং সেখানে কিছু সময় থাকা রাসুলুল্লাহর জন্য কোন দুর্ঘটনার ব্যাপার ছিল না। সমালোচক এবং জ্ঞানপাপীরা এই সহজ বিষয়টা কিছুতেই বুঝে না। এবং তারা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নিত্য নৈমত্তিক ও নিয়মিত দায়িত্ব পালনের মধ্যেও সব সময় অনিয়ম ও ভুল খোঁজে এবং দুর্নাম আরোপ করে।

চতুর্থতঃ, উম্মে হানি এবং রাসুল (সাঃ) পর্দা মেনে কথা বলছিলেন কিনা- এই ধরনের একটা উদ্ভট প্রশ্ন তারা করে থাকেন। প্রথমতঃ বিষয়টা এমন নয় যে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বিবাহিত উম্মে হানির সাথে পর্দা মানতেন আর অবিবাহিতা উম্মে হানির সাথে পর্দা মানতেন না। আসলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) শুধু উম্মে হানি (রাঃ) নয় সব নারীদের সাথেই যতটুকু পর্দা মানা ফরজ তা সব সময়ই মেনে চলতেন। সুতরাং, এটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। দ্বীতিয়তঃ তাঁরা নামাজ শেষে কথা বলছিলেন, সুতরাং তাদের মধ্যে একটা শালীনতা এবং দূরত্ব ছিল- এটা বুঝতে বেশী জ্ঞানের দরকার হয় না। তৃতিয়তঃ আল্লাহর মনোনীত একজন রাসুলকে (সাঃ) একজন নারী তাঁর স্বামী, আম্মা, ভাই, এবং সন্তানের উপস্থিতিতে দাওয়াত করবেন, এটা তাঁদের জন্য সম্মানের, আনন্দের এবং পুরস্কারের বিষয় এবং এই অধিকার তাঁর আছে। উম্মে হানি তাঁর স্বামী হুবাইরাহকে দিয়ে দাওয়াত করালেন না কেন? – এই ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে। আমরা জানিনা উম্মে হানি তাঁর স্বামীর সাথে বিষয়টা আলোচনা করেছিলেন কিনা। কিন্তু এতে উম্মে হানির বিচক্ষণতা এবং সততাই প্রমাণিত হয়। কারণ, তাঁর স্বামী হুবাইরাহ ছিলেন একজন মুশরিক এবং যেহেতু সে মুহাম্মাদ (সাঃ) কে নবী বা রাসুল হিসেবে অস্বীকার করতেন সেহেতু তাঁর জন্য আল্লাহর রাসুলকে (সাঃ) দাওয়াত করাটা তার জন্য কিছুটা বিব্রতকর ছিল যদিও সে আল্লাহর রাসুলকে (সাঃ) সম্মান করতো। অন্যদিকে, ওই পরিবারে হুবাইরাহ বাদে, মুসলিমদের মধ্যে উম্মে হানিই ছিলেন সবচেয়ে দায়িত্বশীল এবং পরিবারের প্রধান। সুতরাং, সে-ই দাওয়াত করবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এবং জিবরাইল (আঃ) যখন মেরাজ শেষে মক্কায় পৌঁছান তখনও রাত্রি। সেখান থেকে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) আবারও তাঁর চাচাত বোন উম্মে হানির বাসায় যান এবং তখন শুধু ‘তাঁকে’ নয় ‘তাঁদেরকে’ জাগান। উম্মে হানির ভাষায়ঃ “ প্রথম প্রভাতের একটু আগে তিনি আমাদেরকে জাগান এবং ভোরের নামাজ শেষে তিনি আমাদের বলেনঃ ও উম্মে হানি, তোমরা যেমনটি দেখছো গতকাল এই উপত্যকায় তোমাদের সাথে আমি রাত্রির নামাজ পড়েছি; এর পরে আমি জেরুজালেমে গিয়েছি এবং নামাজ আদায় করেছি এবং ঠিক তেমনটিই তোমরা দেখছ এখন আমি তোমাদের সাথে ভোরের নামাজ পড়ছি। এরপর তিনি যখন যাবার জন্য দাঁড়ালেন, তখন আমি তাঁর ঢিলা পোষাক এত জোরে ধরলাম যে এটা খুলে আসল যাতে তাঁর পেট বের হয়ে আসল কিন্তু তুলার তৈরি পোষাক তা ঢেকে ফেলল। আমি তাঁকে বললাম, ও আল্লাহর রাসুল, এটা লোকজনকে বলবেননা, তারা আপনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে এবং অপমান অপদস্থ করবে। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, আমি তাদেরকে সব কিছু বলব” (লিংস, ২০০৬) ।

উম্মে হানির বাসায় যাওয়া, দাওয়াত খাওয়া, ঘুমানো, কাবায় যাওয়া, আবার মেরাজ থেকে কাবা হয়ে উম্মে হানির বাসায় আসা, তাঁদেরকে ঘুম থেকে ডাকা, এক সাথে নামাজ পড়া, আল্লাহর রাসুলকে (সাঃ) কাবায় যেতে বিরত রাখতে তাঁর কাপড় ধরা – এসব কিছুই হয়েছে যখন উম্মে হানির সাথে তাঁর স্বামী ছিলেন। সেই সাথে ছিলেন উম্মে হানির মা ফাতিমা এবং তাঁর দুই ভাই (লিংস, ২০০৬)। উম্মে হানির স্বামী (শুধুমাত্র নামাজ ছাড়া) সহ তাঁরা সবাই এক সাথে (together) রাতের খাবার খেয়েছেন এবং এক সাথে (together) ভোরের নামাজ পড়েছেন (ইবনে কাছীর, ২০০৬), (লিংস, ২০০৬)।

পঞ্চমতঃ, সমালোচকরা এর পরে প্রশ্ন করে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) অন্য কোথাও না গিয়ে মেরাজ থেকে ফিরে উম্মে হানির বাসায় কেন গেলেন। এ আর এক উদ্ভট প্রশ্ন। আমরা জানি যে, তিনি উম্মে হানির বাসায় রাতের বেলায় কাউকে ঘুম থেকে না জাগিয়ে হারাম শরিফে এসেছিলেন (যেহেতু সবাই তখন ঘুমাচ্ছিল) এবং ফজরের আগে আবার তাঁদেরকে ডেকে একসাথে নামাজ পড়েছিলেন।

এখানে আমরা কয়েকটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে পারিঃ প্রথমতঃ উম্মে হানি (রাঃ), তাঁর স্বামী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যদি ঘুম থেকে উঠে দেখতেন যে ঘরে মুহাম্মাদ (সাঃ) নেই, এতে তাঁরা রাসুলের (সাঃ) জীবন নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়তেন কিনা এবং এটা একটা পেরেশানি কিনা; এবং যে কোন মেহমানের এটা উচিত কিনা মেজবানকে জানিয়ে তাঁর বাড়ী থেকে বিদায় নেওয়া ও তাদেরকে চিন্তামুক্ত করা। আর তিনি যদি হন একজন রাসুল, তবে তাঁর দায়ীত্ব এক্ষেত্রে আরো বেড়ে যায় কিনা। দ্বিতীয়তঃ সে সময় মক্কার মুশরিকদের দ্বারা রাসুলের (সাঃ) জীবননাশের চরম আশঙ্কা ছিল এবং কাবায় নামাজ পড়ার পরিবর্তে একটি নিরাপদ স্থানে অন্যান্য মুসলিমের সাথে নামাজ পড়া বেশী স্বস্তিদায়ক কিনা এবং তাঁর এই অধিকার আছে কিনা। তৃতীয়তঃ তিনি শান্তির মিশন নিয়ে কাজ করছেন এবং সবে মাত্র আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করে ফিরছেন যা তাঁকে অনন্য এক উচ্চতায় আসীন করেছে এবং এটা ছিল তাঁর জন্য এক চরম আনন্দ এবং পাওয়া। শান্তি মিশনের অংশ হিসেবে এই সুসংবাদ এবং আল্লাহর বাণী যার কাছে তিনি মায়ের আদর পেয়েছেন এবং যাদের সাথে তিনি একসাথে বড় হয়েছেন সেই চাচী, চাচাত ভাই, বোন, এবং তাঁর স্বামীকে পৌঁছানোর অধিকার তাঁর রয়েছে কিনা এবং এক্ষেত্রে তাঁদের হক বা অধিকারটাই প্রথমে আসে কিনা। চতুর্থতঃ উম্মে হানির (রাঃ)-এর সাথে রাসুলুল্লাহর (সাঃ) যদি অবৈধ কোন সম্পর্ক হয়েই থাকে (নাউজুবিল্লাহি মিন যালেক), আর আজকের অথবা সেই সময়ের সমালোচক ও মোনাফেকরা যদি জেনেই থাকে তাহলে তো তা উম্মে হানির (রাঃ) স্বামী, আত্মীয় এবং মক্কার মুশরিকদেরি সবার আগে জানার কথা। কিন্তু কই তারাতো কক্ষনই রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে একটি বারের জন্যও এই অভিযোগ আনল না?

কুৎসারটনাকারীরা আল্লাহর রাসুল (সাঃ) এবং উম্মে হানির (রাঃ) এই ঘটনাকে তাদের মত করে সাজিয়ে দুর্নাম আরোপ করে এবং সাধারণ মুসলমান এবং অমুসলমানদের মধ্যে প্রচার করে বিভ্রান্তি ছড়ায়। অথচ আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) প্রত্যকটি কথা এবং পদক্ষেপ ছিলো পুন্যময়, নির্ভুল এবং হক বা সুবিচার এর উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্বয়ং তাঁর চরিত্রের ব্যাপারে বলেনঃ

ইয়া-সীন, প্রজ্ঞাময় কোরআনের কসম, নিশ্চয় আপনি প্রেরিত রসুলগণের একজন, সরল পথে প্রতিষ্ঠিত। (সুরা ইয়া-সিনঃ ১-৩)

নক্ষত্রের কসম, যখন অস্তমিত হয়। তোমাদের সংগী (মুহাম্মাদ) পথভ্রষ্ট হননি এবং বিপথগামিও হননি। এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। (সুরা আন-নাজমঃ১-৩)

পরবর্তি শেষ পর্বে আমরা উম্মে হানির (রাঃ) সাথে তাঁর স্বামীর বিচ্ছেদ এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) এর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করব ইন-শা-আল্লাহ।

দ্বিতীয় পর্ব

রাসুলুল্লাহ (সা:) উম্মে হানিকে (রাঃ) দ্বিতীয়বার বিয়ের প্রস্তাব করেন হিজরতের পরে যখন রাসুল (সাঃ) মক্কায় আসেন। আবার মক্কা বিজয়ের আগে উম্মে হানি (রাঃ) রাসুলুল্লাহকে (সাঃ) বিয়ের প্রস্তাব দেন যা রাসুল (সাঃ) ফিরিয়ে দেন। আগে এই জন্য বলছি যে উম্মে হানির (রাঃ) সাথে সুরা আল-আহযাবের ৫০ নং আয়াতটির একটি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, যা নাজিল হয়েছে মক্কা বিজয়ের আগে। এ বিষয়েও মোনাফেকরা আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) চরিত্র নিয়ে নানা বাজে মন্তব্য করে। নিম্নের আলোচনা সমালোচকদের অনেক প্রশ্নের জবাব দিবে ইন-শা-আল্লাহ। উপরন্ত, রাসুলুল্লাহর (সাঃ) চারিত্রিক সৌন্দর্য্য এবং ভারসাম্য বুঝার জন্য এই ঘটনাগুলো জানা জরুরী।

রাসুলুল্লাহ (সা:) তায়েফে ইসলামের দাওয়াত দিতে যান ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে (মোবারকপুরী, পৃ- ১৪৩)। মেরাজ সংঘটিত হয় ৬২১ খ্রিষ্টাব্দে; আর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে [মেরাজের ১৬ মাস (ইবনে কাছীর ১ম খন্ড, পৃ-৬১) পরে সোমবার ২৭শে সেপ্টেম্বর (লিংস, পৃ-১২৬)] । ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে (সওয়াল মাসে ৭ম হিজরিতে) — হুদাইবিয়ার সন্ধির এক বছর পর, (মোবারকপুরী, পৃ-৩৯৩) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মক্কায় যান কাজা উমরা করতে । এই সাত বছর উম্মে হানির (রাঃ) এর সাথে রাসুলুল্লাহর (সাঃ) কোন দেখা সাক্ষাৎ নেই। হুদাইবিয়ার সন্ধির আগে বা পরে মুসলিম মেয়েদের হিজরত করতে কোন বাধা ছিল না এবং যদিও মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত অনেক মহিলা হিজরত করেছেন, তথাপিও উম্মে হানি (রাঃ) কোন কারনবশত হিজরত করেননি ।

যায় হোক, ইতিমধ্যে উম্মে হানির স্বামী হুবাইরাহ তাঁকে এবং তাঁর চার সন্তান-সন্ততি ত্যাগ করে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত নাজরান শহরে (লিংস, পৃ-৩১২) আশ্রয় নিয়েছে (ইবনে ইশাক, ১৯৫৫) । উম্মে হানির (রাঃ) বয়স বেড়েছে; ভাই জাফর এবং আলী (রাঃ) মদীনায় হিজরত করেছেন। অন্যদিকে মুসলিম হবার কারণে মক্কার মুশরিকদের কাছে প্রতিনিয়তই, অন্যান্যদের মত, তাঁকে চাপের মধ্যে থাকতে হতো কারণ মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত এ শহরে মুসলমানদের কোন ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না। এমনকি স্বাভাবিক ধর্মীয় ইবাদতগুলোও তাঁদেরকে গোপনে করতে হত (লিংস, পৃ-২৯১)। এমতাবস্থায় আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাচ্চাদেরকে নিয়ে কেমন কষ্টে তাঁর দিন কাটছিলো।

সমালোচকরা প্রশ্ন করে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এই বয়সে এসে কেন উম্মে হানিকে (রাঃ) বিয়ের প্রস্তাব দিলেন? আচ্ছা বেশ, আসুন দেখি এর মধ্যে কি হিকমাহ বা বিচক্ষণতা লুকিয়ে আছে?

সময় অনেক গড়িয়েছে। মুসলমানদের সংখ্যা, প্রভাব, প্রতিপত্তি, স্বাধীনতা আগের থেকে অনেক বেড়েছে । রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অবস্থান আগের থেকে অনেক সুসংহত, মুশরিকরা চাইলেই পূর্বের মত তাঁকে অপমান অপদস্থ করতে পারে না। তিনি ইতিমধ্যেই আবিসিনিয়া, পারস্য এবং কনস্টান্টিনোপলের মত দেশের দাপুটে রাজা বাদশাদের ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন এবং অনেকেই তাঁর সেই দাওয়াত গ্রহণও করেছেন। হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মদীনা নামক রাষ্ট্র; তিনি এখন এই রাষ্ট্রের প্রধান এবং মক্কা বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। উম্মে হানি (রাঃ) ছিলেন রাসুলুল্লাহর (সাঃ) আপন চাচাত বোন, তাঁরা একসাথেই বড় হয়েছেন এবং সেই সাথে তাঁর চরম দুর্যোগের সময়ে শবে মেরাজের মত ঘটনা সর্ব প্রথম তাঁদের সাথেই শেয়ার করেছেন। উপরন্ত, আবু তালিবের স্ত্রী ফাতেমা তাঁকে নিজ সন্তানের মত দেখাশুনা করতেন। সুতরাং, উম্মে হানিদের (রা) ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বেখবর ছিলেন না।

উম্মে হানির (রাঃ) এই চরম বিপদের মুহুর্তে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে কিছু বৈষয়িক সহযোগিতার প্রস্তাব করতে পারতেন। কিন্তু ক্ষমতা আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) দায়ীত্ব, কৃতজ্ঞতা বোধ এবং মায়া-মমতাতে ক্ষয় বা চিড় ধরাতে পারেনি। সেই সাথে উম্মে হানির প্রতি তাঁর যে কর্তব্য, সম্মান, মায়া এবং অনুরাগ (affection) ছিল, (লিংস, পৃ-৩৩) সময় এবং অবস্থার প্রেক্ষিতে তার কোনও নড়চড় হয়নি। কারণ এটা উম্মে হানির (রাঃ) প্রতি তাঁর নিছক কোন দৈহিক ভালবাসা ছিল না; এটা ছিল উম্মে হানির উন্নত চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, শিষ্টাচার,বাধ্যনুগততা, ধার্মিকতা এবং সদাচার এর প্রতি ভালবাসা। সত্য, সুন্দর এবং পবিত্রতার প্রতি মানুষের ভালবাসা চিরন্তন, এবং তা সময় এবং স্থানভেদে বদলে যায় না; দৈহিক খাঁচায় তা সব সময় আবদ্ধ করা যায় না। এ ভালবাসা এক ধরনের আত্মিক ভালবাসা যা প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ নিজের মধ্যে ধারন করতে চায়। আর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন ভালবাসার এমনই এক আধার যে তাঁর আপন চাচা হযরত হামজা (রাঃ)-এর কলিজা চিবিয়ে খাওয়া এবং তাঁর মরদেহ বিকৃতিকারীকেও ক্ষমা করে আপন করে নিয়েছেন। সবার প্রতিই রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর ভালবাসা ছিল অনুপম, অকৃত্রিম, দৃঢ়, ক্রমবর্ধনশীল, ঐশ্বরিক, নিঃস্বার্থ এবং কল্যাণময়। আর সেজন্য সাধারনভাবেই স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) উম্মে হানিকে (রাঃ) আগের মতই সম্মানিত করতে চেয়েছেন। এখানে উম্মে হানির (রাঃ) বয়স বা তাঁর সন্তান-সন্ততি রাসুলুল্লাহর (সাঃ) কাছে কোন বাঁধা তৈরী করতে পারেনি। বরং এসব সন্তান-সন্ততিদের দায়িত্ব নিয়ে উম্মে হানির (রাঃ) উদ্বেগ-নিরসন করে তাঁকে স্বস্তি দেওয়াটা আল্লাহর রাসুল (সাঃ) একটি ইচ্ছা বলে প্রকাশ পেয়েছে। অন্য দিকে, এটা ছিল উম্মে হানির (রাঃ) জন্য হিজরত করার এক অনন্য এবং সর্বশেষ সুযোগ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একদিকে যেমন তাঁকে উম্মুল মুমিনিন এর মর্যাদা দিতে চেয়েছেন অন্যদিকে আবার হিজরতের সুযোগ করে দিতে চেয়েছেন। এতে কি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায় না?

যায় হোক, উম্মে হানি (রাঃ) এই প্রস্তাবে দুঃখ প্রকাশ করে বলেনঃ ‘আল্লাহর কসম, জাহেলী যুগেও আপনাকে আমি পছন্দ করতাম। আর এটা কিভাবে সম্ভব যে আমি ইসলামে দীক্ষিত হবার পর আপনাকে পছন্দ করব না? হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ), এখন আমার বয়স হয়েছে; আর আমার ছোট ছোট বাচ্চা আছে- আমি চাই না তাঁরা আপনাকে বিরক্ত করুক’ (ইবনে কাছীর, পৃ-৪২৭), (তাবারী, পৃ-১৯৮)। স্পষ্টতই, উম্মে হানির (রাঃ) আশঙ্কা ছিল যে হয়তবা তিনি আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) হক আদায় করতে পারবেন না।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সন্তুষ্টিচিত্তে তা গ্রহণ করেন এবং বলেনঃ ‘কুরাইশের মেয়েদের মধ্যে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ যারা ধার্মিক এবং উটে চড়ে। তাঁরা সেই সব মেয়েরা যারা নিজেদের ছোট বাচ্চাদের অধিকতর ভালোবাসে এবং স্বামীর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে সর্বপেক্ষা সাবধানী বা মনোযোগী’ (ইবনে কাছীর, পৃ-৪২৭)।

‘আবু সালিহ থেকে বর্ণিত যে উম্মে হানির (রাঃ) বাচ্চারা বড় হলে, তিনি রাসুলুল্লাহর (সাঃ) সাথে দেখা করেন এবং তাঁকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন, কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন কারণ ইতিমধ্যেই ‘হিজরত করেনি এমন বিবাহযোগ্য আত্মীয়দের ব্যাপারে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা এসেছে (তাবারী, পৃ-১৯৮)’।

এ ব্যপারে মারেফুল কোরআনে চমৎকার একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। বক্তব্যটি হবুহু তুলে ধরলামঃ “রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর চাচা আবু তালেবের কন্যা উম্মেহানী (রাঃ) বলেনঃ আমি মক্কা থেকে হিজরত না করার কারণে আমাকে বিবাহ করা রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য হালাল ছিল না। আমি তোলাকাদের মধ্যে গণ্য হতাম। মক্কা বিজয়ের সময় রসুলুল্লাহ (সাঃ) যাদেরকে হত্যা অথবা বন্দী না করে মুক্ত করে দিয়েছিলেন, তাদেরকে “তোলাকা” বলা হত। (রুহুল মা’আনী, জাসসাস)।

রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে বিবাহের জন্যে হিজরতের উপরোক্ত শর্ত কেবল মাতৃ ও পিতৃ বংশীয়া কন্যাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল, সাধারণ উম্মতের মহিলাদের ক্ষেত্রে হিজরতের শর্ত ছিল না; বরং তাদের শুধু মুসলমান হওয়াই যথেষ্ট ছিল। পরিবারের মেয়েদের ক্ষেত্রে হিজরতের শর্ত আরোপ করার রহস্য সম্ভবতঃ এই যে, পরিবারের মেয়েদের মধ্যে সাধারণতঃ বংশগত কৌলিন্যের গর্ব ও অহমিকা বিদ্যামান থাকে। রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সহধর্মিণী হওয়ার জন্য এটা সমীচীন নয়। হিজরতের শর্ত আরোপ করে এই গর্ব ও অহমিকার প্রতিকার করা হয়েছে। কারণ হিজরত কেবল সে নারীই করবে, যে আল্লাহ ও রসুলের ভালবাসাকে গোটা পরিবার, দেশ ও বিষয় সম্পত্তির ভালবাসার উপর প্রাধান্য দেবে। এ ছাড়া হিজরতের সময় মানুষ নানাবিধ দুঃখ কষ্ট কর্ম সংশোধনে বিশেষ সহায়ক হয়ে থাকে (মাআরেফুল কোরআন, পৃ-১০৮৯)”।

আমরা খেয়াল করি যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) উম্মে হানির (রাঃ) সাথে এই আন্তরিকতাপুর্ণ সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত বজায় রাখেন। যেদিন মক্কা বিজিত হয়, সেদিন মাখজুম গোত্রের দুইজন মুশরিক উম্মে হানির (রাঃ) ঘরে আশ্রয় নিল যারা ছিল তাঁর স্বামী হুবাইরাহর দিক দিয়ে আত্মীয়। তারা মুলতঃ হজরত খালিদের (রাঃ) সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে উম্মে হানির (রাঃ) ঘরে পলায়ন করে। আলী (রাঃ) উম্মে হানিকে (রাঃ) দেখতে এসে এই দুইজনকে হত্যা করতে উদ্যত হলে উম্মে হানি (রাঃ) তাঁকে বাঁধা দেন এবং তাদেরকে একটি ঢিলা আলখেল্লা বা আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেন; কিন্তু তাদের জীবন হুমকির মুখে ছিল এবং যে কোন সময় তাদেরকে খুন করা হত। উম্মে হানি (রাঃ) বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে নিয়ে গেলে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাদের নিরাপত্তা দেন এই বলে যে যারাই উম্মে হানির (রাঃ) ঘরে আশ্রয় নিবে তারা নিরাপদ থাকবে (লিংস, পৃ-৩১৩)।

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর উপর অর্পিত সকল সাহাবী আজমাঈন, তাঁর স্ত্রীগণ এবং প্রত্যেক মুসলিম/অমুসলিমদের হক বা অধিকার পরিপূর্ণভাবে আদায় করেছেন । উম্মে হানি (রাঃ) এর কোন ব্যতিক্রম নন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন ভারসাম্য এবং পূণ্যময় সম্পর্ক-স্থাপনের এক অনন্য নজীর যিনি নিজে চরম জুলুমের স্বীকার হয়েও অন্যদের উপর সর্বোচ্চ ইহসান করেছেন ।

এভাবে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং উম্মে হানীর (রাঃ) সম্পর্ক নিয়ে যতই বিশ্লেষণ করা হবে, আমরা ততই আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) স্বভাব/প্রকৃতির আলোকিত এবং সংস্কারমূলক দিকগুলোই দেখতে পাব। তাঁর দায়িত্ববোধ, সততা, বুদ্ধিমত্তা,নিঃস্বার্থ ভালবাসা, চারিত্রিক পবিত্রতা, শক্র/মিত্রকে চরমভাবে আপন করে নেওয়া, কাউকে অবহেলা না করা, তরুণ অথবা বয়স্ক — কারো ভালবাসা বা পছন্দকেই না ভুলা ও ছোট করে না দেখা বরং গুরুত্বের সাথে মূল্যায়নকারী খোলা-মনের এক চেহারাই আমাদের সামনে বার বার ভেসে উঠবে। মহান রাব্বুল আলামিন নিজেই তাঁর সাক্ষ্য দিচ্ছেনঃ

যাঁরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্বরণ করে, তাঁদের জন্য রসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। (সুরা আল-আহযাবঃ ২১)

নুন-শপথ কলমের এবং সেই বিষয়ের, যা তারা লিপিবদ্ধ করে, আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহে আপনি উন্মাদ নন। আপনার জন্য অবশ্যই রয়েছে অশেষ পুরস্কার। আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। (সুরা আল-কলমঃ১-৪)

সুতরাং, রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর চরিত্র নিয়ে কথা বলার সময় সমালোচক এবং জ্ঞানপাপীদের খোলামনে সকল তথ্য পড়াশুনা করা উচিত । পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবহিতৈষী মানুষটির কুৎসা রটনার ক্ষেত্রে তাদের সতর্ক হওয়া উচিৎ অন্যথায় তারা নিজেরাই নিজেদের আগুনে প্রজ্বলিত হবে সন্দেহাতীতভাবে।

রেফারেন্সঃ

1. ইসাক মুহাম্মাদ ইবন, সিরাত ইবন হিশাম আল ফালাহ ফউন্ডেশন কায়রো ২০০০

2. হাইকল মুহাম্মাদ হুসেইন, মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জীবনী (১৯৩৩), ইসমাইল রাজী আ. আল ফারুকী কর্তৃক অনূদিত নর্থ আমেরিকান ট্রাস্ট পাবলিকেশন্স ২০০৫

3. ইবনে কাছীর, আল সিরাহ আল নাবিয়্যাহ, (প্রফেসর ট্রেভর লি গ্যাসিক কর্তৃক অনূদিত এবং ডঃ মুনির ফারিদ কর্তৃক রিভিউড) গারনেট পাবলিশিং লিমিটেড, ইউ.কে ২০০৬

4. Muhammad ibn Ishaq. Sirat Rasul Allah. Translated by Guillaume, A. (1955). The Life of Muhammad. Oxford: Oxford University Press.

5. Muhammad ibn Umar al-Waqidi. Kitab al-Maghazi. Translated by Faizer, R., Ismail, A., & Tayob, A. K. (2011). The Life of Muhammad. London & New York: Routledge.

6. তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ এবং সম্পাদনাঃ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, খাদেমুল-হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, মদীনা মোনাওয়ারা, ১৯৯৩)

(এ লেখার কোন অংশ লেখকের অনুমতি ব্যতীত বই আকারে ছাপান যাবে না। তবে লেখকের নাম সহ শেয়ার করা যাবে এবং রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। এই লেখা আরো পরিমার্জনা শেষে বই আকারে প্রকাশিত হবে ইন-শা-আল্লাহ)

picture courtesy: https://ilahipaigham72.files.wordpress.com/…/img_1674.jpg

Dr Md Azabul Haque

Share this post

Leave a Reply